বরিশালের পুলিশ পুলিশত্ব ও পৌরুষ দেখিয়েছে
![বরিশালের পুলিশ পুলিশত্ব ও পৌরুষ দেখিয়েছে](https://archive.sahos24.com/assets/images/news_images/2016/04/25/imtiaz-mahmood_52358.jpg)
(১)
হরতালের সমর্থনে বরিশালে আজকে সকালে একটা মিছিল হচ্ছিল। মিছিলে ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র ফ্রন্ট এইসব সংগঠনের নেতা কর্মীরা ছিলেন আর শহরের সড়ক উজ্জ্বল করে সেই মিছিলে অংশ নিয়েছিল এক ঝাঁক স্কুলের মেয়েরা। আকাশী নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা স্কুলছাত্রী এই কিশোরীরা কেন মিছিলে এসেছে? কেননা ওদের মনে হয়েছে এই দেশেরই আরেক কোনায়, কুমিল্লায় আরেকটি মেয়ে সোহাগী জাহান তনুর প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিবাদ করা দরকার। আর তনুর ঘটনা তো এই আন্দোলনকে স্ফুলিঙ্গ দিয়েছে মাত্র- ওদের আসল প্রতিবাদটা নারীর প্রতি অন্যায় অত্যাচার নির্যাতন ও বৈষম্যের বিপরীতে।
আমাদের দেশে নারীকে কি দৃষ্টিতে দেখা হয় সেটা তো একটা নারী শিশু তার বুদ্ধি হবার আগেই জেনে যায়। এগারো বারো বা তের বছরের ক্ষুদ্র নারী জীবনে একটি কিশোরী পৃথিবীর আর কিছু জানুক বা না জানুক, আর কিছু শিখুক বা না শিখুক, একটা জিনিস ঠিকই শিখে যায় যে সে একজন নারী এবং সে পুরুষের সমান মানুষ না। একটি নারী শিশুর শরীর বিকশিত হবার আগেই আমরা ওকে শিখিয়ে দিই, তুমি একটি মাল মাত্র, পুরুষের ভোগের বস্তু। মানুষ হবের আগেই তাকে আমরা মেয়েমানুষ বানিয়ে দিই এবং মেয়েমানুষ থেকে জীবনে কোনদিন সে আর মানুষ হতে পারেনা।
সচেতনভাবে ওরা ভেবেছে কিনা জানিনা, কিন্তু যে মিছিলে ওরা অংশ নিতে এসেছিল সেই মিছিলটা নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের শতাব্দী প্রাচীন দীর্ঘ মিছিলেরই একটা অংশ মাত্র। শারীরিকভাবে না বটে, কিন্তু ওদের সাথে এই মিছিলে মেরী উলস্টোনক্রাফট ছিলেন, সিমন দ্য বুভোয়া ছিলেন, বেগম রোকেয়া ছিলেন এমনকি আমাদের হালের তসলিমা নাসরিনও ছিলেন। কেননা নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই তো সেই কবে থেকেই যে চলছে,এই প্রতিবাদটা তো তারই অংশ।
বরিশালের পুলিশ বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের এস্টাব্লিশমেন্ট নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই সহ্য করবে না।
(২)
বরিশালের পুলিশ পুলিশত্ব দেখিয়েছে, ওদের পৌরুষ দেখিয়েছে। মিছিলে আচ্ছামত লাঠিপেটা করেছে। মিছিলে একটা ছোট মেয়ে ছিল ক্লাস সিক্সে পড়া, হাফসা তৃষা ওর নাম, ওকেও আচ্ছামত পিটিয়েছে। মেয়েটা মুখে আঘাত লেগেছে। পায়ে হাঁটুর নিচে আঘাত লেগেছে। মেয়েটা এখন হাঁটতে পারছে না আর কথাও বলতে পারছে না। মিছিলে অন্যরাও আহত হয়েছে, কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।
আমাকে বলেন, যে মিছিলে বাচ্চা বাচ্চা এই মেয়েরা আছে সেখানে লাঠিপেটা করাটা পুলিশের জন্য কি এমন জরুরী ছিল? ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্র ফ্রন্টের মিছিল থেকে কি ওরা গাড়ী ভাঙছিল? সে তো হওয়ার কথা না। ওরা কি দোকানপাটে হামলা করছিল? অসম্ভব, সেকথা কেউ বললেও আমি বিশ্বাস করবো না। তাইলে? লাঠিপেটা করাটা কেন জরুরী হয়ে পরেছিল সেখানে? আপনি আমি সবাই জানি, ছাত্র ইউনিয়ন বা ফ্রন্টের এই ধরনের মিছিলে হাজার হাজার মানুষও হয়না। ওদের একটা মিছিল যে মহানগরীর জীবনযাত্রা অচল করে দিবে সেরকম হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। শহরের রাস্তাঘাট অচল করে দেওয়ার মত মিছিল করে কেবল সরকারী দল। ওদের কর্মসূচীতে শহরে ট্রাফিক থেমে যায়।
তাইলে পুলিশ বরিশালের সেই মিছিলটাকে কেন লাঠিপেটা করতে গেল?
আপনি মিছিলের কারণটাও চিন্তা রকে দেখেন। আজকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন আর কয়েকটা বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন মিলে হরতাল ডেকেছিল তনুর জন্য বিচার চেয়ে সেই সাথে সকল নারী নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে। আমার মনে হয়না শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষ ওদের দাবীর সাথে দ্বিমত করবেন। কর্মসূচী প্রশ্নে দ্বিমত থাকতে পারে, হরতাল কেন এই প্রশ্ন করতে পারেন কেউ কেউ, কিন্তু তনুর জন্যে বিচার চাইবে না এরকম লোক পাওয়া তো কঠিন আরকি। সুতরাং হরতালটাও এমন কোন দাবী নিয়ে না যে সেটাকে দমন করা সরকারের জন্য জরুরী ছিল।
আসলে আমাদের এস্টাব্লিশমেন্ট নারী অধিকারের পক্ষে না বলেই ওরা আঘাতটা করেছে।
(৩)
আপনি চিন্তা করেন, ক্লাস সিক্সে পড়ে একটা মেয়েকে পুলিশ কেন লাঠিপেটা করবে? পারে কি করে? পুলিশও তো মানুষ, নাকি? আরে, মিছিল যদি ওরা ভেঙেও দিতে চায়, তাইলেও তো বাচ্চাগুলিকে মারার দরকার হয়না। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেই হয়। বাচ্চা মেয়েটাকে এইভাবে মারার কি দরকার ছিল?
কেউ হয়তো বলবেন ক্লাস সিক্সে পড়ে একটা বাচ্চার মিছিলে যাওয়ার কি দরকার ছিল? কেন যাবেনা? আমি যখন প্রথম মিছিলে যাই তখন আমিও স্কুলে পড়ি। সেটা ছিল জিয়াউর রহমানের সময়। পাটের দাম সরকার অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দিয়েছিল বলে প্রতিবাদে কৃষকরা পাট পুড়িয়ে দিচ্ছিল সেবার। এরকমই একটা কৃষকদের কর্মসূচীতে সমর্থন জানাতে ছাত্র ইউনিয়নের একটা মিছিলের সাথে আমি নবীনগর বাজারে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে বলেন ক্ষুদিরাম যখন বোমা মারতে গিয়েছিল ওর বয়স কত ছিল?
নারীর প্রতি অন্যায় হয়েছে। তনুর জন্যে বিচার চেয়ে সবখানেই তো মেয়েরা অংশ নিচ্ছে। সব বয়সী মেয়েরাই আসবে এটাই স্বাভাবিক। স্কুলের মেয়েরা কেন যাবেনা। অবশ্যই যাবে। তাই বলে পুলিশ ওকে এইভাবে মারবে?
আপনার কাছে মনে হতে পারে আমি তিলকে তাল বানাচ্ছি, কিন্তু বরিশালের পুলিশের এই আচরণের মধ্যে আমি রাষ্ট্রের পুরুষবাদি পিতৃতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতা ছাড়া আমি আর কিছু দেখিনা। পুরুষ রাষ্ট্রের পুরুষ পুলিশ ওর পৌরুষ দেখিয়ে দিয়েছে ঐ শিশুটির উপর। এছাড়া ব্যাপারটা আর কিছুনা।
(৪)
আপনি চিন্তা করতে পারেন একটা ক্লাস সিক্সের মেয়েকে পুলিশ কেন এইভাবে মারবে? ওর বোনের জন্যে বিচার চাইতে গিয়েছে সেটা কি ওর অপরাধ? ধর্ষক আর খুনিদের ধরার বেলায় কোথায় থাকে পুলিশের এইরকম এজিলিটি?
আপনারা কেউ কি মেহেরবানী করে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করবেন- বরিশালের এই বীরপুরুষ পুলিশগুলির জন্যে তিনি কি পুরস্কারের ব্যাবস্থা করেছেন? পারলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে দেন, ঐ পুলিশগুলিকে যেন প্রেসিডেন্টের পুলিশ মেডেল দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দেয়। হাজার হোক ওরা আমাদের পুরুষ সমাজের মান রক্ষায় কাজ করছে। ওদেরকে পুরস্কার না দিলে হবে?
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।