চলেন হরতালটা করি

(১)
মেয়েটা খুন হয়েছে এক মাস পার হয়ে গেল। বাবা মা শখ করে নাম রেখেছিল সোহাগী জাহান তনু। ফুটফুটে মেয়েটা মরে গেছে আজকে এক মাসের চেয়ে বেশী সময় হয়ে গেল। খবরের কাগজেও এখন আর ওর ছবি আসেনা। বাংলাদেশে অনেক মানুষ, এখানে প্রতিদিন অনেক ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনা ঘটে। এক তনুকে নিয়ে ওরা আর কতদিন নিউজ করবে। আমরা এখনো হয়তো ভুলিনাই, কিন্তু কত জরুরী ইস্যু নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট লিখতে হয়। তনুর কথা চাপা পরে যায়। আবেগের তীব্রতা শিথিল হয়ে আসে। কতদিন আর আপনি তনুকে নিয়ে লিখবেন!
কিন্তু মাথা থেকে তো হতভাগী মেয়েটার ছবি মুছে যায়না। আমার বাসার চারপাশে বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আছে। বাসার সামনে থেকে শুরু করে বড় রাস্তায় ওঠা পর্যন্ত রাস্তা জুড়ে নানা রঙের কাপড় চোপড় পড়া উজ্জ্বল সব ছেলেমেয়েরা। রাস্তার পাশে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে এরকম একটা মেয়ে হয়তো খিলখিল করে হেসে ওঠে। বুকটা ধ্বক করে ওঠে। এরকমই আরেকটা মেয়ে ছিল তনু। মেয়েটার উজ্জ্বল সবুজ আর কমলা রঙের পোশাক পরা ছবিটা মনে পরে। কে তুলেছিল সেইসব ছবি? ওরই কোন বন্ধু হবে হয়তো।
হঠাত কখনো ওর বাবা মার কথাও চিন্তা করি। মেয়েটার বাবা, ছোট চাকরী করে, আমার বয়েসিই হবে। একটু অসচ্ছল হলে শরীরে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ একটু আগে আগেই চলে আসে। মেয়েটার মা, নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংসারের গৃহিণী। বিত্তবান ঘরে বিয়ে হলে ফিটনেস, বিউটি কেয়ার আর ফ্যাশনেবল বস্ত্রে এই মহিলা হয়তো এখনো রূপবতীই থাকতেন। ছবি দেখলেই বুঝা যায় অভাবের সংসারে খাটাখাটনিতে শরীর থেকে কবে যৌবন বিদায় নিয়েছে টেরই পাননি। এই দম্পতির ভালবাসাবাসির ফুল- ফুটফুটে মেয়েটা বেঘোরে মারা পরেছে।
কি হচ্ছে ওদের মনের ভেতর? তনুর বাবা মার মনের ভিতর? ওদের কান্না কি থেমেছে? ওরা কি এখন মেয়েটার চেহলাম করবে বলে টাকা জোগাড়ে ব্যাস্ত?
(২)
সাধারণ একটা মেয়ে। এরকম হাজার তনু আছে বাংলাদেশে। ছোট শহরের বড় কলেজে পড়ে। একটু গান বাজনা করে, বা কবিতা লেখে বা আবৃত্তি করে বা নাটক করে। এইরকম হাজার তনুর মধ্যে এই মেয়েটি আমাদের সকলের চেনা হয়ে গেল- মৃত্যু তাকে পরিচিত করেছে সারা দেশে। ওর ছবি মিছিলের ব্যানারে। ওর ছবি খবরের কাগজে। ওর ছবি ফেসবুকের ওয়ালে। মৃত্যু তাকে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই যে ছবিটা আমাদের মগজে ঢুকে পরেছে, সেটা কি কেবল তনুরই ছবি?
আমরা আতঙ্কিত হয়েছি। চমকে উঠেছি। গর্জে উঠেছি তনুর মৃত্যুতে। বিচার চাই বলে সভা করেছি, মিছিল করেছি। সে কি কেবল তনুর জন্যেই। না।
যে মধ্যবয়স্ক লোকটি তনুর বিচার চেয়ে চিৎকার করেছে, সে কেবল তনুর জন্যেই বিচার চায়নাই। সে বিচার চেয়েছে তার নিজের প্রয়োজনে, যে চায়না তনুর প্রতি যা হয়েছে সে যেন তার প্রাণের চয়ে প্রিয় কন্যাটির প্রতি না হয়। যে বয়স্কা মহিলা তনু জন্যে কেঁদেছে সে কি কেবল তনুর জন্যেই কেঁদেছে? না। সে তার নিজের কন্যার কথা ভেবে কেঁদেছে আর সেই সাথে যুক্ত ছিল তার নিজের নারী জন্মের লুকিয়ে রাখা যন্ত্রণা। যে যুবক কাঠ ফাটা রোদে হাওয়ায় মুঠো ছুড়ে দিয়ে শ্লোগান দিয়েছে, যে তরুণীটি তার সাথে শ্লোগান ধরেছে ওরা কেউই কেবল তনুর জন্যেই রাস্তায় নামেনি।
তনুর বিচারটা জরুরী কেবল তনুর জন্যেই নয় বা তনুর বাবা মায়ের জন্যেই নয়। বিচারটা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আমার মনে আছে সেদিন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচীতে খুলনায় নিহত তন্বীর মা শামিমা এসেছিলেন। ওরা যখন শামিমাকে ডাকলেন বক্তৃতা দিতে, ভদ্রমহিলা ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন। কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিলেন না। তার কান্না কি সেদিন শুধু তার নিজের মেয়ের জন্যে ছিল? বা সে কি শুধু তনুর জন্যে চোখের জল ছিল? না। তিনি শুধু তার নিহত কন্যার জন্যে বিচার চাইতে আসেননি, বা শুধু তনুর জনী বিচার চাইতে আসেননি। তিনি আমাদের সকলের- সকল পিতার কথা, সকল মায়ের মেয়ের জন্যে বিচার চেয়েছেন।
এই বিচারটা জরুরী। তনুর জন্যে জরুরী তো বটেই। আমাদের সকলের জন্যে জরুরী।
(৩)
আমরা আমাদের কন্যা সোহাগী জাহান তনুর জন্যে আমরা বিচার চাচ্ছি। একজন বলতেই পারেন যে মামলা তো হয়েছে, তদন্ত চলছে, তারপরও বিচার চাইবার কি আছে? আছে। আমরা চাইনা এই ধরনের নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডগুলি সাধারণ আর দশটা মামলার মত পুলিশের আর আদালতের লক্ষ লক্ষ নথীর ভিড়ে আরেকটা নথীতে মিলিয়ে যাক। আমরা চাই তদন্ত ও বিচার যেন দ্রুত হয়। আমাদের শোক মিলিয়ে যাবার আগেই যেন প্রকৃত অপরাধীরা চিহ্নিত হয়, ওদের যেন শাস্তি হয়। আর আপনারা তো জানেনই যে গণদাবীর চাপ যদি না থাকে তাইলে তদন্ত, বিচার ও শাস্তির জন্যে সরকার ও পুলিশের গরজটাও কমে যায়।
দ্রুত যদি বিচার কাজ শেষ করা যায় আর যদি কঠিন সাজা হয় তাইলে এই শাস্তিটা দেশের সকল মানুষের কাছে, যাদের মধ্যে সম্ভাব্য আরও ধর্ষক আর হত্যাকারীও লুকিয়ে আছে, সকলের কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে যাক যে হত্যাকারী বা ধর্ষক যেই হোক সাজা তাকে পেতেই হবে এবং সে সাজা হবে কঠোর কঠিন সাজা। এই বার্তাটা পৌঁছানো জরুরী কারণ এই বার্তাটা নিবারক হিসাবে কাজ করবে।
আর এই যে আন্দোলন বা দাবী জানানোর জন্যে কর্মসূচী এইগুলির প্রয়োজনীয়তা অন্যান্য কারণেও আছে। আজকে যদি আপনি তনুর জন্যে বিচার চেয়ে আন্দোলন করেন, এই আন্দোলনে একটা জনসচেতনতা তৈরি হবে। কি? যে না, নারীর প্রতি নির্যাতন ব্যাপারটা বাংলাদেশের মানুষ সহ্য করবে না। আজকে যদি আপনি আমি একটা সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি তাইলে আমাদের সমাজেই মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই চেতনাটা তৈরি হবে যে নারীও পুরুষের মতোই মানুষ।
না, এই আন্দোলনে হয়তো আপনি দেশে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু নারীকে কেবল ভোগের মাল হিসাবে না দেখে ন্যুনতম মর্যাদাটুকুও দেওয়ার বোধটাও যদি কয়েকজনের মধ্যে তৈরি হয় তাইলেও বলতে পারবেন যে এই আন্দোলনের একটা উপযোগিতা ছিল। নারীর চূড়ান্ত মুক্তি তো একটা বিপ্লবের ব্যাপার, সেটা তো কালকেই হবে না আরকি। কিন্তু এইরকম প্রতিবাদগুলিও যদি না হয় তাইলে নারীর প্রতি শতাব্দীপ্রাচীন পুরুষবাদী ধর্ষকামী দৃষ্টিভঙ্গিই সমাজে বিরাজ করতে থাকবে আর এইরকম অপরাধ হতেই থাকবে আর হতেই থাকবে।
(৪)
আগামীকাল ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্রদের দুইটি জোট তনুর জন্যে বিচার চেয়ে অর্ধ দিবস হরতাল ডেকেছে। চলেন, এই হরতালটা সফল করি।
আগামীকাল আমি অফিসে আসবো না। আমাদের এখন কোর্টের ছুটি চলছে বলে কোর্টে যাওয়ার এমনিতেও কোন দরকার নাই। পেশাগত কোন কাজও আমি আগামীকাল বিকাল পর্যন্ত করবো না। হরতালের সময়টাতে কাল আমি কোন মোটর গাড়ীতেও উঠবো না। কাল হরতাল। কালকের এই হরতালের ডাকে সাড়া দিয়ে আমি আমার মতো হরতাল পালন করবো। আপনারা যারা ভদ্রলোক আছেন, আর সচেতন আছেন, আপনাদেরকেও জোড়হাতে অনুরোধ করবো, চলেন হরতালটা করি।
কেউ হয়তো ছাত্র ইউনিয়ন বা এই দুইটা ছাত্র জোটের সমর্থন করেন না, বা রাজনৈতিকভাবে এদের সাথে হয়তো আপনার নানারকম মতপার্থক্য আছে। থাকুক। সেগুলি নিয়ে তর্কাতর্কি বা মারামারি বজায় রেখেও আমরা এই আন্দোলনে অংশ নিতে পারি। তাতে আপনার রাজনৈতিক পরাজয় হবেনা। এটা একটা যুক্তিসঙ্গত কর্মসূচী, ন্যায্য দাবীর জন্যে কর্মসূচী। প্রয়োজনে আপনি আপনার আলাদা ব্যানার নিয়ে আসেন। তবুও আসেন। কর্মসূচীতে এসে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদেরকে দুইটা গালি দেন, তবুও ওদের এই দাবীটার প্রতি আপনার সমর্থন জানান। কেননা এই দাবীর প্রতি তো আপনার নৈতিক সমর্থন আছেই। আপনিও তো ধর্ষকের আর খুনির বিচার চান।
আমরা সকলকে জানিয়ে দিতে চাই যে আমাদের মেয়েদের উপর অত্যাচার আমরা দেখতে চাইনা। আমরা আমাদের কন্যা সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমর চাই যে আমার দেশে আমাদের নারীদেরকে আমরা মর্যাদার চোখে দেখতে চাই।
(৫)
ছাত্র ইউনিয়ন এবং এই দুইটা যে জোট আছে যারা হরতাল ডেকেছে এরা খুব বেশী শক্তিশালী না। ইচ্ছা করলেই ওরা লক্ষ লোকের সমাবেশ করতে পারবে না। শহরের মোড়ে মোড়ে পিকেটিং করার মত লোকবলও ওদের নাই। আর এরা আপনার গাড়ীতেও ঢিল মারবে না বা আপনার দোকানেও লাঠি নিয়ে হামলা করবে না। এরা আপনাকে শুধু বিনীতভাবে আহবান জানাতে পারে হরতাল পালনের জন্যে।
হরতালটা আপনাকে আপনার নিজ দায়িত্বেই পালন করতে হবে। হরতাল করবেন আপনার কন্যার জন্যে, আপনার বোনের জন্যে, আপনার বান্ধবীর জন্যে আপনার প্রেমিকার জন্যে- আপনার জীবনে সকল নারীর জন্যে। বাকি আপনার ইচ্ছা।
ভাল থাকুন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।