বিপ্লবের জন্যে পার্টি দরকার হয়
(১)
আজকে কমরেড লেনিনের জন্মদিন। বুদ্ধি হবার পর থেকেই ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ নামক এই রুশ ভদ্রলোকে আমি কমরেড লেনিন হিসেবেই জেনেছি। বাংলায় বললে আমার সহযোদ্ধা লেনিন বলতে পারি। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন করার সময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম পেশাদার বিপ্লবী হবো, সেজন্যে ওইভাবেই বলতাম, 'কমরেড লেনিন'। কমিউনিস্টরা সারা দুনিয়াব্যাপি এঁকে অপরকে এইভাবেই সম্বোধন করে, আমি সেইভাবেই করতাম, এখনো বলি কমরেড লেনিন।
লেনিন শারীরিকভাবে মারা গেছেন আমার জন্মেরও চল্লিশ বছর আগে। কিন্তু শারীরিক মৃত্যু তাঁকে সভ্যতার বিকাশের সংগ্রাম নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আজকে ওর জন্মদিনে আমি কমরেড লেনিন সম্পর্কে স্তুতিবাক্য করবো না। তারচেয়ে বরং চলেন আপনাদেরকে বলি একজন রাশিয়ান বিপ্লবী কেমন করে বাংলাদেশের এক তরুণের সহযোদ্ধা হয়।
সহজ করেই বলি, কঠিন করে তত্ব বিশ্লেষণের বিদ্যা আমার নাই। আমার পাঠের দৌড় খুবই সীমিত।
(২)
পাঠের দৌড় প্রসঙ্গে মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে ফেসবুকে আমার একজন প্রিয় তরুণ বন্ধু, তিনি কিনা আবার কবিও বটে, বেশ কায়দা করে একটা স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন। ছোট স্ট্যাটাস, কিন্তু সেখানে ভ্রান্তিটা ছিল অনেক বড়। তিনি লিখেছিলেন- ছোটদের রাজনীতি আর ছোটদের অর্থনীতি পড়ে যারা রাজনৈতিক বুলি কপচায় ওরা বোকা। (বা এরকমই কিছু একটা, হুবহু মনে করতে পারছি না, কিন্তু মুল কথা ছিল এটাই)। পড়ে আমি হেসেছি। আমি নাকি বিবাদ এড়িয়ে চলতে চাই সেজন্যে কোন মন্তব্য করিনি। কিন্তু এই তরুণের কথাবার্তার গুরুত্ব এরপর থেকে আমার কাছে বেশ কমে গেছে কমে গেছে।
ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি দুইটা খুবই সহজ সরল কিশোরপাঠ্য ধরনের বই যে দুইটা বই আপনাকে দুনিয়া দেখার মার্ক্সবাদী দৃষ্টি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ইন্ট্রোডাকশন দেয়। শুধুই ইন্ট্রোডাকশন। কিন্তু এই ইন্ট্রোডাকশনটা খুবই জরুরী। কেননা প্রাথমিক এই ধারনাগুলি যদি আপনার জানা না থাকে তাইলে আপনি যতই মার্ক্সবাদী বা বিপ্লবী গ্রন্থমালা পাঠ করেন না কেন, সেগুলিকে আপনি দেখবেন আপনার স্কুল কলেজে পড়া চোখ দিয়ে। অন্যভাবে বললে, পশ্চিমা ধনবাদি দেশসমূহের ইন্টেলেকচুয়াল দৃষ্টিতে আপনি তখন মার্ক্সবাদকে দেখবেন। সেই দৃষ্টি ভ্রান্ত হতে বাধ্য।
আমরা স্কুল কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পৃথিবীতে দেখতে শিখেছি মার্ক্সবাদ সেই দৃষ্টিটাকেই নাকচ করে দেয়। এটা কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতির ব্যাপার না, ওয়ার্ল্ড ভিশন বলে যে কথাটা বলা হয়, বিশ্বের সবকিছুই আপনি যেভাবে দেখছেন মার্ক্সবাদ সেভাবে দেখবে না। এই ওয়ার্ল্ড ভিশন পরিবর্তনের সূত্রটা আপনাকে তুলে দেয় এই ধরনের সহজপাঠ্য প্রাথমিক গ্রন্থগুলি। বাংলায় এই দুইটা বই, সেই সাথে অনিল মুখার্জির সাম্যবাদের ভূমিকা, এই কয়েকটা বইই আপনাকে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে দুনিয়া দেখার জন্যে প্রাথমিক ভিতটা তৈরি করে দিবে।
আমি আপনাকে বলতে পারি যারা এই দুই তিনটা বই না পড়েছেন, ওরা মার্ক্সের পুঁজি ইত্যাদি গ্রন্থ নানাবিধ গ্রন্থ পাঠ করেও সেই দৃষ্টিতে দুনিয়ে দক্ষতে পারেন না। ব্যাতিক্রম তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু শতকরা পঁচাশি ভাগ ক্ষেত্রেই এই কথাটা লেগে যায়।
(৩)
যেহেতু মার্ক্সবাদ দুনিয়াকে দেখার একটি নতুন স্বতন্ত্র এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি, আর দশটা সীমিত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এরকম রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতামতের মত মার্ক্সবাদ আর প্রচলিত ওয়ার্ল্ড ভিশন একসাথে চলে না। পৃথিবী মার্ক্সের ব্যাখ্যাত পথেই অগ্রসর হবে, আজকে একধাপ হবে তো কালকে না হোক পরশু না হোক তেত্রিশ দিন পরে হলেও আরেক ধাপ এবং এইভাবে একসময় সারা দুনিয়া একটি সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হবে। মার্ক্সবাদ আপনাকে কেবল রাষ্ট্র চালনোর জন্যে বা একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের জন্যে সীমিত কিছু দিক নির্দেশনা দেয়না। মার্ক্সবাদ আপনাকে বলে দেয় মানব সভ্যতার ইতিহাস কিভাবে দেখবেন, বর্তমান কিভাবে দেখবেন এবং সেটাকে ভবিষ্যতে কিভাবে নিয়ে যাবেন।
মার্ক্সবাদকে এইরকম দুনিয়া দেখার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে না দেখে একটা সীমিত রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দর্শন হিসাবে দেখার পশ্চিমা ব্যাধি সম্পর্কে আমার সম্যক ধারনা কিন্তু আমি ছাত্র ইউনিয়ন করার সময়ে হয়নাই। আমি যখন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ডিগ্রীর জন্যে পড়ছি তখন আমার সিলেবাসের অংশ হিসেবে মারক্সিজম পরতে হতো। সেখানে আমরা পশ্চিমা লেখকদের বই পড়তাম। তখন অবাক হয়ে দেখেছি পশ্চিমের ওরা মার্ক্সবাদের প্রকৃত ব্যাপকতা দক্ষতেও পায়না, বুঝতেও পারেনা। ওরা এটাকে কেবল আরেকটা সীমিত প্রয়োগের সোশ্যাল থিওরি হিসাবেই দেখে।
এবং সেই ভ্রান্তি থেকেই ওরা সমালোচনাগুলি করে, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে মিলিয়ে বলতে চেষ্টা রকে যে মার্ক্সবাদ তো গেছে, এর আর প্রয়োগ নেই। আমাদের এখানেও আমি লোকজনকে মাঝে মাঝেই দেখি, বিজ্ঞের মত মাথা ঝালিয়ে বলে, 'না না না, টেকনোলজি এখন এত অগ্রসর হয়েছ, বিশ্ব পরিস্থিত এত পাল্টে গেছে যে এখন আর ঐসব মারক্সিজম ফারক্সিজম চলবে না।
ও ভাই, টেকনোলজির বিকাশের সাথে সাথে তো আমি শ্রমের আন্তর্জাতিক রূপ আরও দৃশ্যমান দেখতে পাই। শ্রেণী কি বিলোপ হয়েছে? না শ্রেণী সংগ্রাম মিটে গেছে? পুঁজির বিশ্বায়নের সাথে সাথে তো আমি 'দুনিয়া মজুর এক হও' শ্লোগানের যথার্থতার দেখতে পাই। মার্ক্সবাদ বাতিল হল কি করে?
(৪)
কমরেড লেনিন মার্ক্সবাদী ছিলেন, তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন। সাম্যবাদের দিকে যাত্রার অংশ হিসাবে তিনি রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই বিপ্লবের নেতা তো আমারও নেতা। কেননা সাম্যবাদের পথে যাত্রা তো একটা দেশ একটা সমাজ বা একটা মহাদেশে আলাদা করে হয়না। সাম্যবাদের পথে যাত্রায় পৃথিবীর যে কোনাতেই হোক যখন একজন সংগ্রামে নামে সে তো আমার মুক্তির জন্যেই সংগ্রামে নামে।
না। বিপ্লবের জন্যে পার্টি দরকার হয়, পার্টিগুলি একেক দেশের আলদা আলাদা পার্টি হতে পারে। পার্টি ছাড়া তো আর বিপ্লব হবে না, পার্টি দরকার, পেশাজীবী বিপ্লবী দরকার। পার্টির গুরুত্বও কমরেড লেনিন তাঁর কি করিতে হইবে গ্রন্থে বেশ করে ব্যাখ্যা করেছেন। তো এই পার্টিগুলির ভিন্নতা যতই থাকুক, এদের চূড়ান্ত লক্ষ্য তো হচ্ছে সারা দুনিয়ায় প্রচলিত ধারার রাষ্ট্র ইত্যাদি ভেঙে দিয়ে একটা সাম্যবাদী সমাজ তৈরি করা।
পুঁজিবাদ তো শ্রমকে একটা পণ্যে পরিণত করে। আর পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণের সাথে সাথে শ্রম শোষণও আন্তর্জাতিক হয়েছে। আপনি আলাদা করে হিসাব করতে হয়তো কঠিন হবে, কিন্তু উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের কায়দাটাও তো এখন আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়েছে। এখন তো মার্ক্সবাদ আরো প্রাসঙ্গিক মনে হবার কথা। এখন তো বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণীর একজন নেতা তাঁর কাজের ক্ষেত্রে আরেকটি দেশের আরেকজন বিপ্লবীর সাথে আরো বেশী আপন ভাববেন।
একারণেই সোভিয়েত দেশের নেতা লেনিনকে আমার আরো স্পষ্টভাবেই আমারও নেতা মনে হয়। একারণেই কমরেড লেনিন এখন আমার আরো আপনজন।
হ্যাঁ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। ওদের পার্টির ভুল ভ্রান্তি হয়তো ছিল, সেই সাথে বৈরি পুঁজিবাদী দুনিয়ার ষড়যন্ত্র ইত্যাদিও ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি টিকতে পারেনি। তাতে সেইসব দেশের মানুষের যে খুব একটা কল্যাণ হয়েছে সেটা তো আমার মনে হয়না আরকি। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা যেটা, সাম্যবাদের জন্যে লড়াইটা যে জরুরী সেটা কি ভুল প্রমাণিত হয়েছে? না তো। বরং উল্টাটা।
(৫)
তরুণ বন্ধুদের বলি, আমি হয়তো সোজা করে বলতে গিয়ে সরলীকরণ করেছি। আপনারা পাঠ করুন। নিজে থেকে উপলব্ধি করুন। নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারলে সে তো ভাল কথা, কমরেড লেনিন আছেন আপনাদের সাথে। অসংগঠিত থেকেও যদি চিন্তার জগতে স্পষ্টতা চান, তবুও কমরেড লেনিন আমাদের সাথে আছেন। পাঠ করুন, চিন্তা করুন।
ছোটদের অর্থনীতি দিয়েই শুরু করুন। বইয়ের নাম 'ছোটদের' দেখে তাচ্ছিল্য করবেন না। ইংরেজিতে এইরকম বই কোনটা আছে জানিনা, থাকলে সেটাই নাহয় পড়ুন। বিরোধ করতে চাইলেও পড়ে করাই ভাল। অনিল মুখার্জির সাম্যবাদের ভূমিকা পড়ুন। পুরনো বই বটে, কিন্তু টেক্সট বই হিসাবে ভাল। পড়ুন। দেখবেন, কমরেড লেনিন আপনার সাথে আছেন। সাম্যবাদ ছাড়া চূড়ান্ত মুক্তি তো নেই। না পড়লে তো লড়াইয়ের বাইরেই থেকে গেলেন।
আরেকবার বলি, খোঁচা দিয়েই বলি, রাগ করলে করেন- বাগাড়ম্বর করা সোজা। সেটা আপনি সহজেই করতে পারবেন। পাঠ না করে বুঝতে পারবেন না।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।