রাজনীতিও ভানুমতির খেলের বাইরে না!
![রাজনীতিও ভানুমতির খেলের বাইরে না!](https://archive.sahos24.com/assets/images/news_images/2016/04/19/jiban-jayanta_51971.jpg)
‘অনেকেই বলেন একমাত্র ভরসার জায়গা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সরকার কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলের আর কারও ওপর ভরসা করা যায় না।’-আর তাই সবসময়ই বিভিন্ন সমস্যা-জাতীয় বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনের প্রশ্নে-স্বার্থে ব্যক্তিপর্যায়-সভা-সমাবেশ থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। যেমন- কাউকে হত্যা করা হয়েছে কিংবা ধর্ষণ করা হয়েছে অথবা রাষ্ট্রের অর্থ লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করা হয়। কেন এই প্রত্যাশা? এই প্রত্যাশাই প্রমাণ করে দেশে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি ক্ষমতা নির্ভর। এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর চাইতে বড় উপলব্ধি অন্য কারো আছে বলে মনে হয় না। কেননা জাতির জনক ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের জন্য আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিলো-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। এটি বলা বাহুল্য হবে না যে, শেখ হাসিনা বিহীন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার হতো কি না সেটিও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।
এই যে নাগরিক প্রত্যাশা তার সবকটিতে প্রধানমন্ত্রী কি সমান মনোযোগ দেন বা দিতে পারেন? কোনো কোনোটিতে দেন-এটা যেমন সত্য তেমনি উল্টো মনোযোগের ঘটনাও ঘটে। অবশ্য এজন্যই তিনি যেমন পুরান ঢাকার আগুনে পুড়ে যাওয়া পরিবারের নিঃস্ব সন্তানদের দায়িত্ব নিয়ে নন্দিত হন তেমনি হেফাজত বন্ধু ও নারায়নগঞ্জের অশান্তির নায়কদের পরিবারের সদস্য হিসেবে মনে করে সমানভাবেই নিন্দিত হন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত কিছু দিন থেকে ধর্ম এবং মুক্তচিন্তার নোংরামী নিয়ে কথা বলছেন। গত ১৪ এপ্রিল ২০১৬ বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-‘ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তা হয়ে গেল মুক্তচিন্তা। আমি এটাকে মুক্তচিন্তা দেখি না। আমি এটাকে দেখি নোংরামি। এত নোংরা নোংরা লেখা কেন লিখবে?’ পত্রিকাটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে আরো লিখেছে- ‘আমার ধর্ম আমি পালন করি, কিন্তু আমার ধর্ম সম্পর্কে কেউ যদি নোংরা কথা লেখে, বাজে কথা লেখে সেটা আমরা কেন বরদাশত করবো।’ আশ্চর্য হই- তিনিও মুক্তচিন্তাকে শুধু ধর্মের গণ্ডিতেই সংজ্ঞায়িত করলেন! এখানে কি শুধুই একজন ধর্মবোধ সম্পন্ন নাগরিক মানসিকতা নাকি অন্যকোনো হিশেব-নিকেশ? এই হিশেব-নিকেশের অর্থ মানুষ মাত্রই কমবেশি বুঝতে পারে।
দেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনতার পূর্বাপর বিভিন্ন সময়েই ছোট-মাঝারি কিংবা বড় সবভাবেই নিপীড়নের শিকার হয়েছে। খোদ আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও। ভোটের আগে কিংবা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কথা বলার জন্য এই নিপীড়নের ঘটনা উপাদেয় হিসেবে উপস্থাপিত-উচ্চারিত হয়, নিপীড়কদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি আসে, আবার সব মিলিয়ে যায়-বায়বীয় গ্যাসে রূপান্তরিত হয় সকল উচ্চারণ! কোনো একটি নিপীড়নের বিচার কি আজ পর্যন্ত হয়েছে? আওয়ামীলীগ ক্ষমতা থাকাকালে নিপীড়ন কি বন্ধ আছে? রাজনীতিও ভানুমতির খেলের বাইরে না!
যখন অন্যান্য অনেক বিষয় জোড়েশোড়ে আলোচনায় আসা উচিৎ তখন সংবাদ মাধ্যম এবং রাজনীতি বেশ সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্য নিয়ে। একজন শফিক রেহমান ইস্যু নিয়ে। ২০১৩-এর বাংলাদেশে যে ব্যক্তি সর্বস্তরে সহিংস পরিস্থিতি তৈরির জন্য যত ইন্ধন যুগিয়েছেন তার সমকক্ষদের সংখ্যা বাংলাদেশে নিতান্তই হাতে গোনা। সেই ব্যক্তিকে নিয়েও চলছে ভানুমতির খেল।
শফিক রেহমান ২০০১-এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সনাতন ধর্মের নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন, হত্যার ঘটনাকে বানোয়াট বলে সাফাই গেয়েছেন, ১/১১ কালে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে ইংল্যান্ড পালানোর চেষ্টা করেছেন, নিজের পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকদের দিনের পর দিন যৌন সুড়সুড়ি দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, কিংবা গণজাগরণ মঞ্চকে ফ্যাসিস্ট মঞ্চ আখ্যায়িত করে নিপীড়নে নিপীড়কদের উৎসাহিত করেছেন-নিরাপত্তাহীন করেছেন তরুণ প্রজন্মকে। এতকিছুর পরও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি; নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগণ ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছে। যদি প্রশ্ন করি এ সকল অপরাধে তাকে কেন গ্রেফতার করা হলো না? এর জন্য কি মার্কিন তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন প্রয়োজন ছিলো-যা তখন পাওয়া যায় নি? কিন্তু গত শনিবার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী তনয় ও তাঁর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনায় নিয়োজিত থাকার অভিযোগে। এই যে আয়োজন তা কি শুধু প্রধানমন্ত্রীর সন্তান কিংবা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে? না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?
অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তি হবে, না হলে ছাড়া পাবে খুবই সত্য। কিন্তু আরও যে ঘটনাগুলো ঘটেছে- যেগুলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুভুতিতে আঘাত করেছে-শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রান্ত করেছে, দেশে সংঘাত সৃষ্টি করেছে, আস্তিক্য-নাস্তিক্যবাদ তৈরি করেছে- সে অপরাধগুলো কি বিচারের আওতার বাইরেই থেকে যাবে? বা এতদিনেও এ সকল অপরাধে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার পেছনের উদ্দেশ্যই বা কি? তাহলে কি এটাই সত্য প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হলেই বিচার পাবে অন্য কারো সন্তান বঞ্চিত থেকেই যাবে? তাহলে কি ভানুমতির খেলার আরও অনেক রকমের বিনোদন সামনে অপেক্ষা করছে! তখন সবকিছুই হয়তো পরিস্কার হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ডাঃ ইমরান এইচ সরকারের বক্তব্য নিয়ে এত সমস্যা হওয়ার কি আছে? এটা কি অস্বীকার করার সুযোগ আছে যে, শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের জন্য নাটক তৈরি করা হয়নি? রাষ্ট্রযন্ত্রের মানুষ ইকবাল সোবাহান চৌধুরী কি তাকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেননি? রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে যখন শফিক রেহমানরা তৎপর ছিলো তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, কিন্তু যখন রাষ্ট্র নিজেই ক্ষতিরমুখে অবতীর্ণ তখন তাকে গ্রেফতার করে কি কোনো কিছুকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে? না কি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে? এগুলোই এখন ভাবনার বিষয়। এই গ্রেফতারেরও যে, কোনো ফজিলত থাকতে্ পারে- তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমরা ইস্যুগ্রস্ত দেশে বসবাস করি। ইস্যু পর ইস্যু আসে, আগের ইস্যু চাপা পড়ে। ৮শ কোটি না যেতেই তনু ইস্যুটি অনেক বড় হয়ে যায়, অনলাইন এক্টিভিস্ট হত্যা হয়, সংস্কৃতির আয়োজনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয়। এরপরও রাষ্ট্র ইস্যুর রাশ টেনে ধরেনা। পরিবর্তন প্রত্যাশায় আমরা উৎসুক হয়ে আছি আকাশমুখি।
এটা সত্য, আন্দোলন হয় প্রয়োজনে, সেখানে কাউকে ডাকতে হয় না। যোগাযোগকারী প্রাণীকে যোগাযোগ বন্ধ করার আহবান জানিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করা যায় না। তবে স্তাবকদের ভাবনায় সবসময়ই থাকে প্রতিবন্ধিতা, সে যোগাযোগকারী প্রাণী হওয়ার পরও। এগুলো নিয়ে যারা চিন্তিত নন তারা আর যাই হোক জাতির প্রত্যাশা পূরণে অক্ষম।
লেখক: আইনজীবী, সংগঠক; গণজাগরণ মঞ্চ।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।