- হোম
- >
- বায়োগ্রাফি
- >
- হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল, ২০১৬
প্রিন্টঅঅ-অ+

ছবি : কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে ডিরোজিওর আবক্ষ মূর্তি
ডিরোজিও। পুরো নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (এপ্রিল ১৮, ১৮০৯ – ডিসেম্বর ২৬, ১৮৩১) একজন ইউরেশীয় কবি, যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ ও শিক্ষক। ডিরোজিওর জন্ম কোলকাতার এক মিশ্র পর্তুগিজ পরিবারে হলেও নিজেকে আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালিই ভাবতেন। সে কথা তাঁর লেখা একটি ইংরেজী কবিতায় ফুটে উঠেছে-
My Country! In the days of Glory Past
A beauteous halo circled round thy brow
And worshipped as deity thou west,
Where is that Glory, where is that reverence now?
আপনাদের মধ্যে যারা কোলকাতায় গিয়েছেন, তারা জানেন যে কোলকাতায় এনটালি নামে একটা জায়গা আছে। ডিরোজিওর জন্ম সেখানেই হয়েছিল ১০ এপ্রিল ১৮০৯ সালে। বাবার নাম ফ্রান্সিস ডিরোজিও। সে সময়টায় কোলকাতায় বাস করত ড্রুমন্ড নামে একজন স্কটিশ। তিনি ছিলেন দারুন প্রগতিশীল এক মানুষ। তাঁর সম্বন্ধে লোকে বলত, “a dour Scotsman, an exile and a ‘notrious free thinker’ তিনি কোলকাতার ধর্মতলায় একটি স্কুল দিয়েছিলেন। স্কুলের নাম ছিল ধর্মতলা আকাদেমি স্কুল। সেখানেই ভর্তি হয়েছিল বালক ডিরোজিও। ড্রুমন্ড মুক্তচিন্তা ডিরোজিওর ভিতর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যাতে করে বালকের মন কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে। ড্রুমন্ড বালককে পাঠ দিতেন ইতিহাস দর্শন ও ইংরেজী সাহিত্যে।
তরুণ হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও মাত্র সতেরো বছর বয়সে কলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস পড়াতেন এবং তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল তাঁর ধ্যান-ধারণার মতোই গতানুগতিকতামুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ড শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্রদের আগ্রহ সৃষ্টিকারী যে-কোনো বিষয়ে তিনি তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে কলেজ প্রাঙ্গণের বাইরেও, প্রায়ই তাঁর নিজের বাসায়, আলোচনা করতে সদা-ইচ্ছুক ছিলেন। বাস্তবে, তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তুর পরিসীমা ছিল বহুবিস্তৃত সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং বিজ্ঞান।
কলেজে যোগদানের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ছাত্রদের মধ্যে এত উৎসাহের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাঁর সহায়তায় ১৮২৮সালে তাঁরা 'একাডেমিক এসোসিয়েশন' নামে তাঁদের নিজস্ব একটি সাহিত্য ও বিতর্ক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংঘ শ্রেণীকক্ষের বাধানিষেধের বাইরে ডিরোজিওর পরিচালনায় তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণকারী বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করার একটি সাধারণ মিলনস্থানের সংস্থান করে। 'একাডেমিক এসোসিয়েশন' ছিল এক সফল উদ্যোগ এবং মানিকটোলার এক বাগান বাড়িতে এর পাক্ষিক সভাগুলি অনুষ্ঠিত হতো। এ সব সভায় বহু ছাত্র এবং কিছু উদারমনা ও জনহিতৈষী ইউরোপীয় ব্যক্তি যোগ দিতেন। এর সাফল্য ছাত্রদের কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় একই ধরনের সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করেছিল। ডিরোজিও 'একাডেমিক এসোসিয়েশন' -এর সভাপতি হলেও সদস্য হিসেবে অন্য সংঘগুলির অধিকাংশের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন এবং সেগুলির কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে আগ্রহী ছিলেন।
ডিরোজিওর শিক্ষাবলী ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং তাঁরা বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেন। ডেভিড হিউম ও জেরেমি বেনথামের যুক্তিবাদী দর্শন ও টমাস পেইনের মতো প্রগতিবাদী চিন্তাবিদদের প্রভাবে তাঁরা সবকিছুই যুক্তির মাপকাঠিতে বিচার করতে শুরু করেন। ধর্মের প্রতি তাঁদের মনোভাব ছিল ভল্টেয়ারের মতো। হিন্দু ধর্মকে খোলাখুলিভাবে নিন্দা করতেও তাঁরা ইতস্তত করেন নি। ডিরোজিওর শিক্ষাবলী হিন্দু সমাজে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ডিরোজিওর বিরুদ্ধে গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে আগত ছাত্রদের অধিকাংশের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ বিশ্বাস সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়।
ব্যাপারটা রাধাকান্ত দেব-এর (১৭৮৪-১৮৬৭) নেতৃত্বে রক্ষণশীল হিন্দুদের কর্তৃত্ত্বাধীন হিন্দু কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিষদের নজরে আনা হয়। ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তাঁর পদচ্যুতি অবশ্য প্রগতিবাদী আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে ডিরোজিও এই ঘটনার পর নিজের মতামত প্রকাশে আগের চেয়ে বেশি স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। ইউরেশীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনের কাজেও ডিরোজিও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন। সে সময় তিনি তাঁর কিছু তরুণ হিন্দু শিষ্যকে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যবহার করে তাঁদের প্রগতিবাদী ধারণাগুলি প্রচার করতে উৎসাহিত করেন।
এভাবে ১৮৩১সালের মে মাসে কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় ‘দি ইনকোয়ারার’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং পরের মাসে দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণমল্লিক ‘জ্ঞানাম্বেষণ’ নামে বাংলায় (পরে ইংরেজিতেও) একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন। দৃশ্যত ডিরোজিওর নির্দেশনায় এসব পত্রিকার মাধ্যমে তরুণ প্রগতিবাদীরা হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালান।
এরপর সমাজ সংস্কার বিষয়ে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যাওয়ায় হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে ডিরোজিওকে অপসারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাব ৬-১ ভোটে অনুমোদিত হয়। বহিস্কৃত হবার পরে ডিরোজিও অর্থকষ্টে পড়েন।
১৮৩১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর তিনি কলেরায় মারা যান। গীর্জা ও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর অভিমতের কারণে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করতে বাঁধা দেওয়া হয়। গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
১৮৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিরোজিওর আকস্মিক মৃত্যু প্রগতিবাদীদের উদ্দেশ্য সাধনের পথে গুরুতর আঘাত হানে। তবুও এ অসামান্য শিক্ষক তাঁর তরুণ হিন্দু ছাত্রদের মনে সংস্কারমুক্তির যে চেতনা উদ্দীপ্ত করেছিলেন তা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।