কাঁটাতারে প্রাণের উচ্ছাস
ডিজার হোসেন বাদশা
প্রিন্টঅঅ-অ+
দুই দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা কাঁটা তারের বেড়া প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে দুই বাংলার মানুষের আত্মীয়তা ও আত্মার মিলনে। যারা দেশ বিভক্তীর সময় ও স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরে ভারত বাংলাদেশ দুই দেশে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে বিভক্ত হয়েছে। তাদের ৪৫ বছরের দীর্ঘ শ্বাস অবসান ঘটিয়ে গত ৪ বছর থেকে পঞ্চগড়ের দশ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে নববর্ষের দিন বসছে অশ্রুভেজা দুই বাংলার মিলন মেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি, বাংলাদেশ ভারত দুই বাংলা ভাষীদের হয়েছে মিলন মেলা। নববর্ষের একদিন আগে বুধবার মায়া-মমতা আর ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে মিশে একাকার হয়ে যায় দুদেশের নাগরিকরা।
ভারতের খালপাড়া, চালহাটী, রাইজগঞ্জ এলাকার একাংশ ও বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের অমরখানা ও বোদা পাড়া, বিরাজোদ, পতিপাড়া, বন্দিপাড়া, মাগুড়মারী, মুহুরীজোদ এবং তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের খল্টাপাড়া, নন্দগছ, শুকানী ক্যাম্প সীমান্তে ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সীমান্তের মেইন পিলার ৭৭২, ৭৭৩, ৭৭৪ ও ৭৭৫ নম্বর আর্ন্তজাতিক সীমানা পিলারের এলাকায় দুই বাংলার হাজারো মানুষ জড়ো হয়। মোবাইলে যোগাযোগ করে দুই দেশের নাগরিকরা পহেলা বৈশাখের আগের দিন সীমান্তে এসে মিলিত হন। সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে। সকাল থেকেই দুই দেশের নাগরিকদের মিলনে বিজিবি ও বিএসএফ বাঁধা দিয়ে আসছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় দুই দেশের নাগকিদের ভালোবাসার কাছে কোনকিছুই আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
৪৭ সালে দেশবিভক্তির সঙ্গে ভাগ হয়ে যায় দুই দেশের হাজার হাজার পরিবার। দুটি দেশে বসবাস করলেও দীর্ঘদিন পর নাড়ির টানেই এই মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, চাচা-চাচি, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের সান্নিধ্য আর মনের মাঝে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অব্যক্ত কথাগুলো তারা এসময় বিনিময় করে।
এই মিলন মেলায় পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন। অপরদিকে, ভারতের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহারসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
কাঁটাতারের উভয় পাশে হাজারো মানুষ তাদের প্রিয়জনদের খুঁজছেন। যারা পেয়েছেন তারা কথা বলছেন। কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ছোটখাট জিনিসপত্র ছুড়ে মারছেন প্রিয়জনদের দিকে।
জানা যায়, মা-মেয়েকে, বাবা-ছেলেকে, ভাই-বোনকে দেখতে পেয়ে চোখের জল ফেলছেন কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারছে না। স্পর্শ করতে না পারায় কারও কারও চোখে অশ্রু, আবার দীর্ঘদিন পর বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পেরে কারও চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছিলো। কাঁটাতার তাদের আলাদা করলেও ভালোবাসার টানে প্রতিবছরই এই দিনে দুই দেশের মানুষ ছুটে আসেন এখানে। বেড়ার এপার-ওপার থেকেই শেষ হয় দুই বাংলার নাগরিকদের মিলন মেলা।
বাংলাদেশ-ভারতের নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক, কিশোর-কিশোরী আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উপচে পড়া ভিড়ে ছিল শুধুই উচ্ছাস আর আবেগ। সকাল থেকে সবাই সাইকেল, রিকশা-ভ্যান, ভটভটি-টেম্পু, কার-মাইক্রোবাস ও মিনিবাসে করে হাজির হয় সীমান্তে। এই মিলন মেলায় দুই দেশের নাগরিকরা একে-অপরকে নানা সামগ্রী উপহার দিচ্ছিলেন। এবারের উপহার সমগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইলিশ মাছ। এছাড়া আপেল-কমলা, শাড়ি-লুঙ্গি, বিস্কুট-চানাচুর, জুস, বিড়ি-সিগারেটসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও।
ভাই তুমি কেমন আছো, ‘মা কেমন আছে, বাড়ির সবাই কে কেমন আছে। কে কি করছে। সংসার পরিবার কেমন চলছে এই সব কথাবার্তা।
ঠাকুরগাঁও জেলার আওলিয়াপুর থেকে আসা রাজন সরকার মা-বাবা, ভাই, বোনসহ দেখা করতে এসেছেন ভারতে থাকা বড় বোনকে। সে জানায়, ৪০ বছর পর বড় বোন বাসন্তি রাণীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে বাবা ও মায়ের সঙ্গেও। ৪০ বছর আগে ভারতের মাটিগাড়া এলাকায় বিয়ে হয় বাসন্তি রাণীর। বাসন্তি রাণীর বাবা শুক্রু কাঁটাতারের এপার থেকে চিৎকার করে এসব প্রশ্ন করছিল মা তুমি কেমন আছো। প্রতি উত্তরে বাসন্তি রাণী শুধুই ভালো ভালো বলছিলেন।
ঠাকুরগাঁ জেলার গড়েয়া থেকে আসা মঙ্গলা, স্বামী বমিক এসেছেন ভারতে থাকা তিন সন্তানের দেখা করতে।
দেখা শেষে বিদায়ের সময় আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে যাওয়ার সময় বিচ্ছেদের কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অনেকেই।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।