সামাদ আমার ভাই না, তনু আমার বোন না
শুভ্রা কর
প্রিন্টঅঅ-অ+
একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত যে, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এসব এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একটি মানুষকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হলেই প্রথম বক্তব্য হয় নাস্তিক ব্লগার খুন হয়েছে। কোন এক আনসারুল্লাহ আলকায়েদা কেউ এর দায় স্বীকার করে উল্লাস প্রকাশ করে আর সাথে সাথেই দেশের বিপুল জনগণ এক ধরণের সন্তোষ নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।
এই পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার পেছনে মনে মনে তাদের যুক্তি থাকে হত্যা করেছে জঙ্গিরা, এরা আসলে ধর্ম বুঝে না। আর দ্বিতীয় সন্তোষের কারণ হচ্ছে যে মারা গিয়েছে সে তো নাস্তিক ব্লগার। অথচ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কেউ সেই নিহত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন খোঁজই নেন না। সেই ব্যক্তি আসলেই কি ভাবতেন, কি চিন্তা করতেন, কি লিখতেন সেটাও তারা জানার চেষ্টা করেন না। যেহেতু তাকে জঙ্গিরা কুপিয়ে খুন করেছে তাই সে নিশ্চয়ই ধর্মকে গালিগালাজ করতো এটা ভেবেই চুপ করে থাকা আমাদের স্বভাব।
ছোটবেলায় ভাব সম্প্রসারণে পড়েছিলাম, ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি’। খুব মনে ধরেছিল কথাটা। আর সেজন্যই নিজেকে কখনো কোনকিছু জানা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি নাই। ভালোমন্দ, নিজের মতের পক্ষে বিপক্ষে সব ধরণের সবকিছুকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে পরখ করে দেখেছি তারপর নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনায় যেটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে সেই পথে হেঁটেছি। একটি নির্দিষ্ট আদর্শে কিংবা বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে বাধা নেই। কিন্তু সেটা সব ধরণের জ্ঞানের প্রতি নিজেকে উন্মুক্ত রেখে সব দেখে শুনে জেনে বুঝে তারপর করলেই ভালো।
নাজিমুদ্দিন সামাদকে আমি চিনতাম না। ফেসবুকে তিনি আমার বন্ধু ছিলেন না। কোনদিনই তার সাথে কথা হয়নি। তার মৃত্যুর পর আমি তার কিছু লেখা পড়েছি। ধর্মকে গালিগালাজ করে কিছু লিখেছেন তেমন কিছুও চোখে পড়েনি। তবে লিখেছিলেন ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধাপরাধী ও সরকারের আপোষকামী মনোভাব এর বিরুদ্ধে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কোন জঙ্গি গোষ্ঠী তাকে নাস্তিক ব্লগার বলে আখ্যায়িত করার সাথে সাথে এক বিশাল জনগোষ্ঠী তাকে ধর্মকে গালিগালাজ করা এক ব্যক্তি হিসেবেই ধরে নিয়েছেন। অথচ মৃত্যুর পর নাজিমুদ্দিনের কোন ব্লগই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন যদি ধরে নেই সামাদ ধর্মকে গালি দিয়ে কিছু লিখতেন তাহলেও কি এই হত্যা জায়েজ হয়ে যায়? আপনি কি আসলেই মনে করেন যে আপনার নিজের স্রষ্টার প্রতি, ধর্মের প্রতি বিশ্বাস এতই ঠুনকো যে তাকে রক্ষা করার জন্য আপনাকে এর বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষকে হত্যা করতে হবে? দুঃখজনক হলেও সত্য এই বিশাল জনগোষ্ঠীও এসব জঙ্গি সংগঠনকে সহি মুসলমান বলে মানতে নারাজ হলেও কেন জানি নাস্তিক হত্যার ব্যাপারে এরা যা বলে তাই সবাই খুব সহজেই মেনে নেন। এরা কেউ বড়ো গলায় বলতে পারেন না, সে যা খুশি লিখুক সেটা আমার স্রষ্টা দেখবে, এর জন্য তাকে শাস্তি দেয়ার তুই কে? এটা না করে এই বিশাল জনগোষ্ঠী যখন দুইপক্ষ ব্যালেন্স করা কথা বলেন তখন মূলত এই জঙ্গি শক্তিই লাভবান হয়।
ফেসবুকে একবার কারো একটা লেখা পড়েছিলাম, ঠিক মনে নাই কার, সেটাও খুব মনে ধরেছিল। বক্তব্যটা ছিল অনেকটা এরকম, তিন ধরণের ধার্মিক খুঁজে পাওয়া যায়, ১। যারা মনে করে স্রষ্টাকে অপমান করার শক্তি কারো নেই। তাই কে স্রষ্টা কিংবা ধর্মকে নিয়ে কি বললো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। তারা এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। বরং নিজের মতো করে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালন করে। ২। স্রষ্টা কিংবা ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বললে তারা কষ্ট পায়, তবে সেটা কাছের অল্প কিছু মানুষের সাথে শেয়ার করে আর এদের সুবুদ্ধির জন্য মনে মনে প্রার্থনা করে। ৩। স্রষ্টা কিংবা ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বললেই এরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে, হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। মানুষের চেয়েও এদের কাছে ধর্ম বড় হয়ে উঠে। বেশিরভাগই কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য।
যতই দিন যাচ্ছে কেন জানি মনে হচ্ছে এই ৩ নম্বর দলের মানুষের সংখ্যাই বেড়ে যাচ্ছে। স্রষ্টার প্রতি যাদের এতো বিশ্বাস তারা কখনো ভেবে দেখেন না যে মানুষটার বক্তব্যে স্রষ্টারই কোন ভ্রুক্ষেপ হচ্ছে না সেই মানুষটাকে হত্যার অধিকার তারা কিভাবে পায়? স্রষ্টা কি নিজেই নিজেকে এবং তার প্রচারিত ধর্মকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট নন? তাহলে কেন সেই স্রষ্টাকে রক্ষা করার জন্য মানুষকে চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়? এটাই কি স্রষ্টার প্রতি সবচেয়ে বড় বৃদ্ধাঙ্গুলি নয়??
তনুর ঘটনায় আসি। দেশে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের মহোৎসব চললেও তনু হত্যার পরে সারা দেশব্যাপী একটা আলোড়ন তৈরী হয়েছে। প্রথমে তনু ধর্ষিত হয়েছিল বলে পুলিশ জানালেও পরে অবশ্য তা অস্বীকার করা হয়েছে। যাই হোক, তনুর ঘটনা নিয়ে এতো আলোড়ন এর অন্যতম একটা কারণ হয়তো এটা ছিল যে সেনানিবাস এর মতো সুরক্ষিত এলাকায় এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। তবে এটাও সত্য এমন অনেকেই এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন যাদের যুক্তি ছিল যে হিজাব পড়ার পরেও কেন তনুকে ধর্ষণের শিকার হতে হলো? কথাটার অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় যে যদি তনু হিজাব না পরে শার্ট প্যান্ট পড়তো তাহলে আমরা তার ধর্ষণ কিংবা হত্যা মেনে নিতাম? সেনানিবাস এর মতো সুরক্ষিত এলাকায় কিভাবে এরকম হত্যাকান্ড সংগঠিত হয় এই প্রশ্ন যারা তুলেন তাদের এই প্রশ্নও তোলা উচিত যে পাহাড়ে এই সেনাবাহিনী করছেটা কি? কিন্তু পাহাড়ের সেই মেয়েটি আপনার জাতি কিংবা ধর্মের নয় বলে, কিংবা সে হিজাব পরে না বলে যদি তার উপর অত্যাচার নিয়ে আপনার কোন মাথাব্যথা না থাকে তাহলে কি আসলেই আপনি মানুষ তনুর প্রতি সমবেদনা নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন? নাকি আপনার সহানুভূতি সবই আপনার জাতি ধর্ম আর সেই ধর্মের পোশাক কেন্দ্রিক?
হত্যা হোক কিংবা ধর্ষণ, আমাদের সমাজে ব্যাপারটা আজ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে যে খুন হলো কিংবা ধর্ষিত হলো সে আমার মতের কিনা, আমার জাতির কিনা, আমার ধর্মের কিনা আগে সেটা আমি দেখবো তারপর বিচার চাইবো। ফিলিস্তিন, সিরিয়া কিংবা অন্য কোথাও যখন বোমা হামলায় মুসলিম মরে কেউ হিসেব করে না সেই হামলায় যারা মরলো তারা সবাই ব্যক্তিজীবনে ভালো ছিল নাকি মন্দ? তারা কেউ চুরি করতো কিনা, মিথ্যে বলতো কিনা, কাউকে গালি দিতো কিনা, দুর্নীতি করতো কিনা। এসবকিছু না ভেবেই আমরা সবাই তাদের পাশে দাঁড়াই, অন্যায়ভাবে হত্যা করার প্রতিবাদ করি। অথচ নিজের দেশে কেউ মরলেও আমাদের আগে হিসেব করতে হয় সে আস্তিক ছিল নাকি নাস্তিক, হিসেব করতে হয় ধর্ষিত মেয়েটি হিজাবধারী মুসলিম ছিল নাকি পাহাড়ি। সবসময়ই দেখি খুন কিংবা ধর্ষণের পর আমাদের চিৎকার করে বলতে হয় এই মেয়েটির জায়গায় আপনার বোনও হতে পারতো, এই ছেলেটির জায়গায় আপনার ভাই হতে পারতো। আমরা আজ মানুষ হিসেবে এতটাই নিচে নেমে গেছি, জাতি-ধর্ম-গোত্র ইত্যাদি নানা সীমানার ভেতর নিজেদের বন্দি করে আমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি যে খুন হওয়া কিংবা ধর্ষিত হওয়া একজন মানুষের জন্য বিচার চাইতে কিংবা তার পাশে দাঁড়াতে তার জায়গায় নিজেকে কিংবা নিজের ভাইবোনকে আমাদের কল্পনা করতে হয়, নইলে আমাদের মনুষ্যত্ব জাগে না!
সারা বিশ্বে যে হিংসা আর ঘৃণার মহামারী চলছে তার মাঝে কেউ হয়তো মুসলমান হিন্দু মারছে, কিংবা হিন্দু মুসলমান মারছে, কিংবা খ্রীষ্টান ইহুদি মারছে, কিংবা আস্তিক নাস্তিককে মারছে ইত্যাদি ইত্যাদি ভেবে ‘আমি তো করছি না’ এরকম এক ধরণের আত্মতৃপ্তি নিয়ে চুপ থাকতে পারেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, মানুষ মানুষকে মারছে, আর আমরা অনেকেই একে নানাভাবে নাম দিয়ে মূল ঘটনাকেই জাস্টিফাই করে দিচ্ছি। এর চেয়ে গ্লানির এই মানব সভ্যতার জন্য আর কি হতে পারে? যে মেয়েটি ধর্ষিত হচ্ছে আজ, এখন, এই মুহুর্তে সে আপনার বোন নয় কিংবা আপনার জাতি ধর্মেরও নয় এটা ভেবে হয়তো আপনি শান্তিতে ঘুমুতে পারবেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই মুহুর্তে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে পশুর মতো কিংবা তার চেয়েও হিংস্রভাবে খুবলে খাচ্ছে শুধু নিজের পেশীর জোরে।
কাল আমার ঘাড়ে কেউ চাপাতি বসালে কিংবা আমাকে কেউ ধর্ষণ করলেও হয়তো আমার পরিচিত অনেকেই হিন্দুকে জঙ্গিরা মেরেছে, কিংবা একটা নাস্তিককে উগ্রবাদীরা মেরেছে, কিংবা মেয়েটা কি যে কাপড় পরতো এজন্যই তো এই অবস্থা, এরকম নানাকিছু ভেবে আমার হত্যা কিংবা ধর্ষণকেও জাস্টিফাই করে দিবেন। কেউ কেউ হয়তো নিজের বোনের জায়গায় আমাকে কল্পনা করে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বিচার চাইবেন। কিন্তু এমন ক’জন আছেন যারা আমাকে নিজের প্রিয়জনের জায়গায় দাঁড় না করিয়ে, আমার জাতি, ধর্ম, পোশাক, বিশ্বাস, অবিশ্বাস কোনকিছুই চিন্তা না করে স্রেফ মানুষ হিসেবে আমার হত্যা কিংবা ধর্ষণের বিচার চাইবেন?
সামাদ আমার ভাই না, তনু আমার বোন না। এরকম হাজারো, লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা অন্যায়ভাবে খুন হয়, ধর্ষিত হয় এরা কেউ আমার ভাইবোন না, প্রিয়জন না। আমি কেবলই একজন মানুষ হিসেবে তাদের জন্য ভালোবাসা ও সহানুভূতি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই। নিজের হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যে এদের জন্য যতটুকু আওয়াজ তোলা সম্ভব হয় তাই তুলি। আর নিশ্চিত থাকুন, কাল আপনিও অন্যায়ভাবে খুন হলে কিংবা ধর্ষণের শিকার হলে আপনার জাতি, ধর্ম, পোশাক, বিশ্বাস, অবিশ্বাস আমাকে আপনার বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে পিছপা করবে না।
লেখক: সম্পাদক; জাগরণীয়া
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।