‘আন্দোলন ফান্দোলন রাইখা ঘরে বইসা মুড়ি চাবাইস’
(১)
এই ছেলেটা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় নিজের ওয়ালে বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিল,
"আমায় যদি এই আন্দোলনে হত্যা করা হয় তাইলে কেউ আমার জন্য হায় হায় করবি না, কান্না কাটি লাশ নিয়ে মিছিল করবি না। যদি আমার লাশের পাশে বসে নাকি কান্না করিস তাইলে থাপরাইয়া তোর দাঁত ফালাইয়া দিবো।
যদি পারিস তাইলে দেশের শত্রু মানবতার শত্রু জামাত-শিবিরের রক্ত দিয়া আমার শেষ গোসল করাইস নতুবা এইসব আন্দোলন ফান্দোলন রাইখা ঘরে বইসা মুড়ি চাবাইস। মরার পর তর কান্নাকাটি দিয়া আমি কি করুম! জামাত শিবির বাইচ্চা থাকলে এই দেশ বাচবে না আর তার মানুষও বাচবে না। তাই হুঁশিয়ার! সাবধান!!!"
মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে, ৩১শে মার্চে, একজন শুভানুধ্যায়ী ওকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলে তাঁর জবাবে সে লিখেছে, "ভয় আমার নিজেরও হয় স্যার। অকালে মরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কি করব স্যার। মাথা নত করে চুপ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এ মরাটাই বোধ হয় ভালো। smile emoticon"
গত বৃহস্পতিবার দিন এই ছেলেটা যখন লিখছে মাথা নত করে বাঁচার চেয়ে এই মরাটাই বোধ হয় ভালো, আর এই কথাটা লিখে সে যখন ঐ হাসির চিহ্নটা দিচ্ছিল, সে কি জানতো যে সপ্তাহ ঘুরে আসার আগেই সে আসলেই এরকম উত্তম মৃত্যু লাভ করবে?
(২)
এই ছেলেটার জন্যে আমি কোন শোকবার্তা লিখছি না। কেননা নাজিমুদ্দিন সামাদ ঠিকই বলেছিল এইসব অর্থহীন শোকবার্তার আসলে কোন অর্থ নাই। মৌলবাদের বিনাশ ছাড়া এঁদের জন্যে শোক করার আসলেই কোন অর্থ নাই। মৌলবাদের রক্ত দিয়ে ওর মৃতদেহ গোসল করাতে পারলে ভাল হতো।
না, মানুষ মেরে তো অবশ্যই নয়। মৌলবাদের রক্ত মানে মানুষ মেরে মানুষের রক্তে স্নান করা নয়। বরং মৌলবাদের বিপরীতে উদার মুক্তচিন্তার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই মৌলবাদের বিনাশ হবে। সেইটাই হবে মৌলবাদীদের রক্তে নাজিমুদ্দিন সামাদের মৃতদেহের গোসল।
(৩)
ওয়াশিকুর বাবুর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি যখন বলছিলাম নিজের আদর্শে অবিচল থেকে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাওয়া এইসব তরুণদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার কথা, তখন আমার বন্ধু দুরন্ত প্রশ্ন করেছিলেন, যেসব ধর্মান্ধ ছেলে আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়ে মানুষ মারে ওরাও তো নিজের বিশ্বাস থেকেই এইসব করে। ওদেরকেও কি তাইলে আমার শ্রদ্ধা করতে হবে?
তর্ক এড়ানোর জন্যে আমি সেদিন কিছু বলিনি। এখন বলছি। না। যে সন্ত্রাসী ছেলেটি নিজের অন্ধ বিশ্বাস বা জ্বেহাদি জোশ থেকে আত্মঘাতী হামলা করে নিরীহ মানুষের উপর তাদের সাথে ওয়াশিক বাবু বা নাজিমুদ্দিন সামাদের পার্থক্য আছে। ধর্মান্ধ জ্বেহাদিরা নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করে না। ওরা মানুষ মারে ভয় দেখিয়ে ওদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। ওরা যুক্তি তর্ক দিয়ে নিজের মতবাদের যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, ওরা চায় ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করতে।
একজন মৌলবাদীর লড়াই নিতান্তই একটি হত্যাকারীর মিশন ছাড়া আর কিছু না। কারণ মুক্তচিন্তার বা আদর্শিক সংগ্রামে অপরকে হত্যা করে ফেলার কোন প্রয়োজন হয় না- প্রয়োজন হয় চোখ খোলা রেখে প্রশ্ন তোলা, প্রশ্ন শোনা, ভিন্নমত শোনা আর সেগুলি বিবেচনা করার আর বিচার করার। মৌলবাদীদের সেই সুযোগ নেই। কেননা যুক্তি তর্কের লাইনে গেলে আপনাকে আপনার নিজের বিশ্বাসকেও নানারকম প্রশ্ন করে যাচাই করতে হয়। ধর্ম বিশ্বাসে তো প্রশ্নেরই সুযোগ নাই।
সেজন্যেই একজন মুক্তচিন্তার তরুণ যখন নিজের আদর্শ নিজের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) নিয়ে লড়াই করে সে কখনোই প্রতিপক্ষকে খুন করবে না। প্রতিপক্ষ না থাকলে তাকে প্রশ্ন করবে কে? নিজের প্রয়োজনেই সে ভিন্নমত খুঁজে বেড়ায়। এটাই তাঁর সংগ্রাম। আর অন্ধ বিশ্বাসের মিশন হচ্ছে উল্টা- ভিন্নমত পেলেই মেরে ফেলবো। সেটাকে আপনার পবিত্র মনে হতে পারে, কিন্তু আদর্শের লড়াই সেটা নয়।
একজন আমার ধারনাকে আক্রমণ করলে তার সাথে আমি সসম্মানে তর্কে লিপ্ত হতে পারি। কিন্তু যে আমার প্রশ্নকে আক্রমণ না করে আমাকে গলা কেটে প্রশ্ন বন্ধ করতে চাইবে, সে তো সংগ্রামী না, তস্কর।
(৪)
নাজিমুদ্দিন সামাদ ফেসবুকে আমার বন্ধু ছিলেন। অনেকদিন থেকেই ছিলেন সম্ভবত। আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে ওঁর কোন কথা হয়নাই- সামনাসামনিও না, ইনবক্সেও না। পরস্পরের কোন পোস্টে আমরা কখনো লাইক দিয়েছি কিনা বা মন্তব্য করেছি কিনা বা কোন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি কিনা মনে পড়েনা। সামাদ সম্ভবত আওয়ামী লীগ করতেন, আওয়ামী লীগের লোকজনের সাথে খুব একটা বাৎচিত আজকাল এমনিতেও হয়না।
কিন্তু ফেসবুকে সামাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। সাম্প্রতিক ইস্যুগুলিতে ওঁর সাথে মতেরর মিল ছিল এটাও একটা কারণ। কিন্তু ওকে কেউ হামলা করবে বা খুন করে ফেলবে সেরকম কোনদিন ভাবিনি। অনলাইনে নাস্তিক এক্টিভিস্ট হিসাবে যারা বেশী পরিচত ওদের দলে কি নাজিমুদ্দিন সামাদ ছিলেন? মনে হয় না। মাঝে মাঝে যেসব তালিকা প্রকাশিত হয় সেগুলিতেও কোনদিন ওঁর নাম দেখিনি।
তারপরেও নাজিমুদ্দিন সামাদকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হয়তো ওর পরিচিত লোকেরাই ওকে মেরেছে। পরিচত যারা ওর সাথে তর্ক টর্ক করতো, বা ওঁর মতামত সম্পর্কে সচেতন ছিল। পরিচত কেউ তো জড়িত আছ নিশ্চয়ই- নাইলে ওর অবস্থান, যাতায়াতের পথ, ঠিক সময়ে সেখানে থাকা এগুলি তো আর অপরিচিত কারো কাজ না আরকি।
এইসব কথা কেন বলছি। বলছি যেসব মুক্তমনা বন্ধুরা এখনো জীবিত আছেন ওদের জন্যে। জেনে নিন, এখনে কেউই নিরাপদ না।
(৫)
আপনার খ্যাতি হয়তো এখনো হয়নি, কিন্তু মৌলবাদীদের তালিকায় আপনার নাম ঠিকই চলে গেছে। কেননা আপনার আশেপাশেই আছে ওরা। আপনার সাথে হয়তো এমনিতে খুবই খাতির- প্রকাশ্যে হয়তো সে আপনাকে কখনো কটুবাক্যও বলে না। কিন্তু সেই বন্ধুটিই আপনার প্রকাশিত মতামতের খবর, গতিবিধির খবর, জীবনযাত্রার খবর পৌঁছে দিচ্ছে ঘাতকের কাছে।
মাঝে মাঝে যেসব তালিকা বের হয়, সেগুলিতে আপনার নাম নাই দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। বা পঙার ফলোয়ার সংখ্যা হাজার হাজার হয়নি বলে ভাববেন না যে আপনাএক কেউ লক্ষ্য করছে না। বা ফেসবুকে আপনাকে কেউ ভয়ংকর গালি দিচ্ছে না বলে ভাববেন না যে ওরা আপনাকে ভয় পায়না। আপনি আপনার মত সতর্কতা অবলম্বন করুন। ভয় পাওয়ার কিছু নাই, মৃত্যু ভয়ে ভিত আপনি নন, সতা হয়তো ঠিক। কিন্তু ভাই, আজকেই মরে যাওয়ার চেয়ে আর কিছুদিন বেশী বাঁচলে ভাল না?
আক্রমণ যে কোন সময় হতে পারে। যে কোন জনের উপর হতে পারে। মৌলবাদের পিত্তি জ্বালানোর জন্যে আপনার খুব বড় সেলিব্রিটি হওয়ার দরকার নাই। আপনি যদি বিশ্বাস নিয়ে বা ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেন বা রঙ রসিকতা করেন, আপনিও আছেন ওদের তালিকায়। কেননা ধর্ম কোন প্রশ্ন বা রসিকতা পছন্দ করেনা। ধার্মিকের দৃষ্টিতে আপনার একটি প্রশ্ন বা একটি রসিকতাই আপনাকে হত্যা করার যথেষ্ট কারণ হতে পারে।
নাজিমুদ্দিন সামাদকে দেখুন। নিজে সাবধান থাকুন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।