রক্ত, ভয়, সংবেদনশীলতা
ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাদৃশ্যের এই ছবিটা আমার কাছে আছে, ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। তার মৃত্যুর এক বছর পুর্তিতে ছবিটা ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার হিসেবে পোস্ট করি। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফেসবুকে, বন্ধু ও কাছের মানুষদের কাছ থেকে এবং কর্মস্থলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হই। তাই কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহির প্রয়োজনবোধ করছি।
দুঃখী মানুষদের কেউ কেউ নিজেদের দুঃখ আশপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। আমিও তাই চেয়েছি। বাবু মারা গিয়েছিল ৩০ মার্চ, আর আমার জন্মদিন ৩১ মার্চ। জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেতে ভাল লাগে অনেক, কিন্তু সমমনা কারো মৃত্যুর শোক বুকে নিয়ে জন্মদিনের আনন্দটা কেমন যেন ফিকে হয়ে আসে। জানতাম আমার ফেসবুক বন্ধুরা ৩১ তারিখে আমার ওয়ালে আসবেন আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে, তাই আমার দুঃখ তাদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে কাজটি করেছি। প্রতিবছরই এমনটা করার ইচ্ছা আছে।
আমার এই কাজে আমার আশপাশের মানুষদের প্রতিক্রিয়ায় ছিল মূলত তিনটি কথা। এক. এরকম রক্তাক্ত দৃশ্য পাবলিকলি শেয়ার করা আমার উচিত হয়নি তাই ছবিটি আমাকে রিমুভ করতে বলেছেন কয়েকজন। দুই. কারো বক্তব্য হল আমি যেই উদ্দেশ্যেই ছবিটি দেই না কেন, এই ছবি ওয়াশিকুর বাবুর জন্য অপমানজনক। তিন. ছবিটি পাবলিকলি দেখিয়ে আমি আসলে ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গিদের উদ্দেশ্যই হাসিল করিয়েছি, তারা হত্যাদৃশ্য ধারণ করে প্রচার করে তাদের হিংস্রতা, তাদেরকে ভয় পেতে হবে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, আমি তাইই ছড়িয়েছি। হয়ত তারা ঠিক বলেছেন। এই নিয়ে আমারও কিছু বলার আছে।
ছবিতে ওয়াশিকুর বাবুর প্রতি অপমান-অশ্রদ্ধা কোথায়? তার মৃত্যু পথে হওয়ায়? তার মৃতদেহ পথে পড়ে থাকায়? আমাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকায়? মৃত্যু নাকি মৃত্যুর কারণ অশ্রদ্ধা বয়ে আনে? আসলে সত্য এবং কাল্পনিক বীরদের বিরোচিত সাহিত্যগাথা পড়ে পড়ে মৃত্যু নিয়ে আমাদের চিন্তাগুলো হয়তো স্টেরিওটাইপিক হয়ে গিয়েছে। সত্য হল বাবুর মতো যারা পথ তৈরি করতে করতে পথ চলে তাদের অধিকাংশের ভাগ্য তো এমনই, নিজের সময়ে তারা ব্রাত্য। সত্য হল মৃত্যুকালে প্রতিরোধ, প্রতিঘাত, পালানো কোনোটারই সুযোগ বাবুকে দেওয়া হয়নি, পেছন থেকে তাকে অতর্কিতে হত্যা করা হয়েছিলো। এরকম ঘটনা কোন পক্ষের জন্য অসম্মানের তা সকলে বোঝেন আশা করি। সত্য হল বাবু মরেছে তার আদর্শের জন্য। আদর্শের জন্য সবাই মরতে পারে না, বাবু পেরেছে। বাবু তাই সব অপমান-অসম্মানের ঊর্ধ্বে। কোনোকিছুতেই কোনো অসম্মান তাকে স্পর্শ করবে না।
মানুষের ভয় নিয়ে ব্যবসা হয় জানি। আগুন লাগার ভয় আছে তাই অগ্নিনির্বাপকের ব্যবসা হবে। এখানে আগুন লাগার ভয় একেবারেই না থাকা আর আগুন লাগার কারণ দূর না করে শুধু অগ্নিনির্বাপক মজুদ করা, দুটোই নির্বুদ্ধিতা। যদি অগ্নিকান্ড না ঘটতে দেওয়া যায় তাহলে অগ্নিনির্বাপকের প্রয়োজন নেই। ইসলামী জঙ্গিবাদ মৌলবাদের ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য নয়? ধর্মান্ধতা-মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই হবে যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান আর সুশিক্ষা দিয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে ধর্মীয় মৌলবাদ এখন বাস্তবতা। একে অস্বীকার করে, এর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সাময়িকভাবে একে ভুলে থাকা যেতে পারে, কিন্তু এর দূষণ থেকে বাঁচতে হলে এর মুখোমুখি হতে হবে, একে মোকাবেলা করতে হবে যথাযথ উপায়ে। আপনারা বাবুর মৃতদেহের দিকে না তাকাতে পারেন কিন্তু এতে করে আসন্ন মৌলবাদী আগ্রাসন যে আপনাদের ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে তার অস্তিত্ব কি নাই হয়ে যাবে?
এরকম রক্তাক্ত মৃতদেহ অনবরত দেখলে মানুষের মনের সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়, মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে, তাই অনেক গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ছবি প্রচার করতে চায় না। কিন্তু কোথায় আমাদের সেই সংবেদনশীলতা? হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, বাবু, অনন্ত, নিলয়, এর বাইরেও আরও কতজন, মৃত্যুর মিছিল তো চলছেই, এদের বেলায় আমাদের সেই অটুট সংবেদনশীলতা গেল কোথায়? আমাদের সংবেদনশীলতা কি তাহলে ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট? আমাদের সংবেদনশীলতা কি কেবল গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যম দিয়ে ট্রিগারড হতে থাকবে?
কাহলীল জিবরানের বহুচর্চিত সেই কবিতাটি মনে আছে?
"যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিলো,
আমি কোন কথা বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম,কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।"
ওয়াশিকুর বাবু কবিতাটির একটি সমকালীন সংস্করণ লিখেছিলো, সেটাও পড়ুন:
“প্রথমে তারা ধর্মবিদ্বেষী কতল করল
আমি হাততালি দিলাম। কারন আমারো অনুভূতি আছে।
তারপর তারা নাস্তিকদের কতল করল
আমি কলেমা পড়ে নিজের আস্তিকতার প্রমান দিলাম। কারন আমারো ঈমান আছে।
তারপর তারা বিধর্মীদের কতল করল
আমি লুঙ্গি উঁচিয়ে ঈমানদণ্ড দেখিয়ে দিলাম। কারন আমারো খৎনা আছে।
তারপর তারা মডারেটদের কতল করল
আমি দাড়ি-টুপি রেখে পাক্কা মুমিন হলাম। কারন আমারো হুরের লোভ আছে।
তারপর তারা ভিন্ন ফেরকার ধার্মিকদের কতল করল
আমি তাদের দলে ভিড়ে কতলে অংশ নিলাম। কারন আমারো জানের ভয় আছে।
তারপরও তারা আমার হাতের তালু কেটে নিল
কারন প্রথমে হাততালি দিয়েছিলাম, যা হারাম।”
বাবুর লাশের ছবি দেখে পেট গুলাচ্ছে, চোখ ফিরিয়ে নিন, ইন্টারনেট থেকে ছবিটি সরিয়ে নেওয়ার দাবিও তুলুন। কিন্তু এতে করেও কি বাঁচা যাবে শেষ পর্যন্ত? আপনার সংবেদনশীলতার স্বরূপ উন্মোচন করুন, জায়গামত সংবেদনশীলতা দেখান, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই। দেরি হয়ে গেলে আপনার অপ্রদর্শিত অব্যবহৃত সংবেদনশীলতাও একদিন ‘অসম্মানিত’ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে, পায়ের কাছে পড়ে থাকবে।
লেখক: অনলাইন এক্টিভিস্ট
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।