নড়াইল সদর হাসপাতালে সংকটের চাপে ‘সেবা নিহত’
নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সরঞ্জাম, অবকাঠামো সংকটসহ নানা সমস্যায় রোগীদের চরম দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে।
সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর এই জনপদের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সামান্য সমস্যা নিয়ে ডাক্তার অভাবে সদর হাসপাতাল থেকে পাঠানো হচ্ছে পার্শ্ববর্তী যশোর, খুলনা, মাগুরা অথবা রাজধানী ঢাকা জেলায়।
সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আশির দশকের শুরুর দিকে নড়াইল সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। জেলার ৩ উপজেলার প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল সদর হাসপাতালটি ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। এর এক বছর পরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে হাসপাতালের বারান্দায়, ওয়ার্ডের ভিতরে গাদাগাদী করে ১০০ শয্যা বসানো হলেও এর বিপরীতে ডাক্তার-কর্মচারী পদায়ন, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অন্যান্য অনুমোদন আজও হয়নি। ১০০ শয্যার উপযোগী অবকাঠামোর উন্নয়নে ৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া পুরাতন একতলা ভবনের উপর দ্বি-তলা ভবনের নির্মাণকাজ ওই বছরের ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও ২০১২ সালে এসে তা শেষ হয়। এদিকে হাসপাতালের নির্ধারিত ১০০ শয্যার সব সুযোগ সুবিধা সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকলেও তা কোন কাজেই আসছে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওর্য়াডবয়, আয়াসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে সিনিয়র সার্জারী কনসালটেন্ট, সিনিয়র মেডিসিন কনসালটেন্ট, এনেসথেসিয়া কনসালটেন্ট, নাক-কান-গলা কনসালটেন্ট, ইউনানী মেডিক্যেল অফিসার, রেডিওলজী কনসালটেন্ট, ৪ জন ইমারজেন্সী মেডিক্যেল অফিসার ও ২ জন মেডিক্যেল অফিসারের পদ। একজন সিনিয়র কার্ডিওলজী কনসালটেন্ট থাকলেও তিনি সপ্তাহে সবদিন আসেন না। দু’টি এ্যাম্বুলেন্স, আলট্রাসোনোগ্রাম, কম্পিউটার অকার্যকর হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন যাবত। ডায়াবেটিসসহ সাধারণ অনেক পরীক্ষায় হয় না এখানে। ১০০ শয্যার বিপরীতে এখানে মোট ৪২ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও নিয়োগ আছেন মাত্র ১১ জন ডাক্তার। হাতে গোনা দু’একজন বাদে যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে দায়িত্ব পালনে উদাসীনতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ।
নানা প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় অবস্থানকারী এসব ডাক্তার, নার্সরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভাল চিকিৎসা পেতে ক্লিনিকে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। যেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয় মোটা অংকের ফিস নিয়ে। হাসপাতালে যথাযথভাবে সময় না দিলেও এদের অনেকেই শহরের একাধিক ক্লিনিকে পালাক্রমে সময় দিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে এদেরকে জেলার অন্যত্র বদলী হলেও অল্পদিনের ব্যবধানে আবার এখানে ফিরে আসেন। বিভিন্ন সময় হাসপাতালে ভাল ডাক্তারের নিয়োগ হলেও দুই এক মাসের মধ্যেই তাদের বিদায় নিতে হয় অন্যান্যদের রোষানলে পড়ে। হাসপাতালে নিয়মিত ঘোরফেরা করেন বিভিন্ন ক্লিনিকের দালাল চক্র। এরা হাসপাতালে আসা রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তির জন্য মোটা অংকের কমিশন পান। হাসপাতালে ডায়াবেটিসসহ অনেক সাধারণ পরীক্ষাই হয় না।
অন্যদিকে অভিযোগ আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর যোগসাজসে হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসোনোগ্রাম, কম্পিউটার মাঝে-মধ্যে অকার্যকর করে রাখা হয়।
লোহাগড়া আর কালিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও সেখানকার অবস্থা একই রকম বলে স্বীকার করলেন জেলার সিভিল সার্জন। আবাসিক মেডিকেল অফিসার এর তথ্য অনুযায়ী ১’শ শয্যার হাসাপাতালে বিশেষজ্ঞ সহ চিকিৎসক থাকার কথা অন্তত ৪২ জন। সেখানে আছেন মাত্র ১১ জন। তাও আবার নিয়মিত নন। কোন কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সপ্তাহে ২ দিন মাত্র রোগী দেখেন। এছাড়া ৭৮ জন নার্সের মধ্যে আছে ৫৫ জন, আর টেকনিশিয়ান অ্যাসিসট্যান্ট সহ ৪র্থ শ্রেণির অন্তত ২০৮ জন কর্মচারীর স্থলে আছে মাত্র ৯২ জন। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসলে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে চিকিৎসা নিতে হয় হতভাগ্য রোগীদের। অধিকাংশ ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ থাকে বেশীরভাগ সময়। আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় বেশীর ভাগ রোগীকে স্থানান্তর করে দেওয়া হয় যশোর অথবা খুলনার হাসপাতালে। হাসপাতালের প্যাথলজিতে কাজ করেন মাত্র ১ জন। পরিচিত রোগী ছাড়া কেউই সেবা পায় না হাসপাতালের প্যাথলজিতে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েও বাইরে থেকে পরীক্ষা করে আসা রোগীর সংখ্যাই বেশী অথচ পরীক্ষা করার জন্য প্রযোজনীয় সকল যন্ত্রপাতি রয়েছে হাসপাতালে। প্যাথলজী বেলা ১২টার পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে এই হাসপাতালের টেকনিশিয়ানরাই বাইরের প্যাথলজী গুলোতে কাজ করেন। হাসপাতালের আধুনিক যন্ত্রপাতির প্যাথলজী বেলা ১২টার পরে বন্ধ হয়ে গেলে ও ডাক্তার, রোগী আর হাসপালের টেকনিক্যাল কর্মচারীদের উপস্থিতিতে জমজমাট হয় বিভিন্ন বেসরকারি প্যাথলজী সেন্টার।
১০০ শয্যার মধ্যে কিছু বেড খালি রাখা হয়। অসাধু কর্মচারীরা সুযোগ বুঝে দূর থেকে আসা রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বেডে জায়গা করে দেয়। প্রতিদিন অন্তত শ’খানেক রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা গেছে, চিকিৎসাসেবা নিতে এসে রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। গরমে তাঁদের নাভিশ্বাস অবস্থা। অপেক্ষা করতে গিয়ে অনেকে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সকাল ৯টায় এসেছেন লক্ষ্মীপাশার গোপীনাথপুরের চায়না বেগম (৪০)। তাঁর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় সাড়ে ১২টায়।
তিনি বলেন, ‘প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে টিকিট কেটে বসে আছি। ভিড়ের কারণে এখনো অপক্ষো করতে হচ্ছে।’ মল্লিকপুর গ্রামের সাহেরা বেগম তাঁর অসুস্থ ছেলে সাকিবকে (৯) নিয়ে বসে আছেন। অসুস্থু সাকিবকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছেন।
তিনি সাড়ে ১২টায় জানান, সকাল ১০টা থেকে এখানে বসে আছেন। ডাক্তার দেখাতে সিরিয়াল পাননি। এভাবে দিঘলিয়ার রহিমা বেগম (৬৭), পারমল্লিকপুরের সাবানা (৩৫), ঈশানগাতীর সাজেদা (৩০), রামপুররার সাবিনা (২৮), ইতনার মুক্তা খানমসহ (১৯) দুপুর সাড়ে ১২টায় অন্তত ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে বসে আছেন।
নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মুন্সী আসাদুজ্জামান রোগী দুর্ভোগের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, হাসপাতালে ৪২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও মাত্র ১১ জন ডাক্তারের পক্ষে ১০০ শয্যার চিকিৎসা সেবা প্রদান দুরূহ হয়ে পড়েছে। কর্মরত চিকিৎসকদের মধ্যে কয়েকজন অন্যত্র বদলীর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। একজন ডাক্তারকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ডিউটি করার ফলে তাঁরা হাঁপিয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় এখানে এসে ডাক্তাররা থাকতে চায় না। আর এ ডাক্তার স্বল্পতার কারণে জরুরী বিভাগে রোগী আসলে তাদেরকে চিকিৎসা না দিয়ে বলা হয় এখানে হবে না, তাড়াতাড়ি যশোর বা খুলনা নিয়ে যান।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।