পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে রেল সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে এ সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের পাশাপাশি রেল চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কাজ চলছে।
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক এস কে চক্রবর্তী জানান, ইতোমধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলার ৫৮৮ দশমিক ২৪ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরের শেষ দিকে এ প্রকল্পে রেললাইনের কাজ শুরু হবে। প্রকল্প অনুসারে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত হবে। এরপর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬১ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপন করা হবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেলপথের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে চীনের কোম্পানি ‘চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড’। যে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে থাকবে ঢাকার ৭১ দশমিক ৩২ একর, নারায়ণগঞ্জের ১৫ দশমিক ৮৫ একর, মুন্সীগঞ্জের ১৩৭ দশমিক ৮১ একর, শরীয়তপুরের ৩ দশমিক ৯৫ একর, মাদারীপুরের ২১৩ দশমিক ৮৮ একর ও ফরিদপুরের ১৪৫ দশমিক ৪৪ একর। বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার চারদিকে তাকালেই চোখে পড়ে নির্মাণযজ্ঞের এক বিশাল আয়োজন। ইতোমধ্যে ৬, ৭, ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলার এ চারটির পাইলিং চলছে একযোগে। ৭ নম্বর পিলারে ৬টি মূল পাইল বসানো প্রায় শেষ। ৬ নম্বর পিলারে ২টি মূল পাইল শেষ হওয়ার পথে। ৩৯ নম্বর পিলারে ট্রায়াল পাইল ও ৪০ নম্বর পিলারে টেস্ট পাইলের কাজ চলছে। প্রতিটি পিলারের কাজ চার স্তরের। প্রথমত, মাটি পরীক্ষা, এরপর ট্রায়াল পাইল যা হালকা ওজনের হ্যামার দ্বারা বসানো হয়, এরপর টেস্ট পাইল যা খানিকটা মূল পাইলের মতো। টেস্ট পাইল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই সবশেষে মূল পাইল বসানো হবে। এ কাজকে ত্বরান্বিত করতে এখানে শিফটভিত্তিক কাজ চলছে। ড্রেজিংসহ নদী শাসনের কাজও দ্রুত এগুচ্ছে। নদীর ভাঙনপ্রবণ দুই তীর এখন শান্ত। এই সুযোগে পরিকল্পিতভাবে চলছে নদী শাসন প্রক্রিয়া।
তদারকি সংস্থা : পুরো পদ্মা সেতুর কাজের ব্যবস্থাপনা তদারকি করবে ‘এইচপিআর’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের রয়েছে ব্রিটিশ, জাপানি ও বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ। এইচপিআর দায়িত্ব নিচ্ছে ১ মার্চ থেকে। তাদের সঙ্গে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৬৮ কোটি টাকায় চুক্তি হয়েছে। এরা সেতু নির্মাণকাজ ছাড়াও পরবর্তীতে টোল অপারেটর নিয়োগ এবং ব্যবস্থাপনাও তদারকি করবে। মূল সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, ত্বরিত গতিতে শুরু হয়েছে ফোর লেন সড়ক ও রেললাইন প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়া। নদী শাসনের জন্য দায়িত্বে রয়েছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন।
পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণ কাজের জন্য চীনের ‘চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন’ কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথভাবে বাংলাদেশের ‘আবদুল মোনেম লি.’ ও মালয়েশিয়ার ‘হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট’ কাজ করছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে’ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।
দেওয়ান আবদুল কাদের আরও বলেন, জার্মানির তৈরি ২৪শ’ কিলো ভার দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার দিয়ে ৬টি মূল পাইল স্থাপন করে একেকটি মূল পিলার স্থাপন করা হচ্ছে। এ রকম ৪২টি পিলার পদ্মাবক্ষে বসানো হবে। সেতুর উভয় পাড়ে ১২টি করে দুই পাড়ে ২৪টি পিলারসহ সর্বমোট ৬৬টি পিলার থাকবে। তবে উভয় পাড়ের পিলার দুটিতে ৬টি পাইলের স্থলে ১২টি করে পাইল থাকবে। পিলারের ওপর বসবে সেতুর স্ল্যাব ও ট্রাস। চীনে স্ল্যাব ও ট্রাস বানানোর কাজ চলছে। পিলার বানানোর কাজ শেষ হলে স্ল্যাব ও ট্রাসজুড়ে দেওয়া হবে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চার-লেনবিশিষ্ট মূল পদ্মা সেতু দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ও চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১টি স্প্যান থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। স্প্যান (অংশ) বড় হওয়ায় এগুলো রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে ইস্পাত দিয়ে।
তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবিলায় বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। ইতোমধ্যেই মূল সেতুর ২১ শতাংশ, নদী শাসনের ২০ শতাংশ, অ্যাপ্রোচ সড়কের ৬৫ শতাংশসহ সব মিলিয়ে গড়ে সেতুটির প্রায় ৩১ শতাংশেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কংক্রিট আর ইস্পাতের নিখুঁত গাঁথুনিতে তৈরি হতে যাচ্ছে দোতলা এ সেতু। সেতুটি পৃথিবীর অন্যতম একটি সেতু হিসেবে আন্তর্জাতিক বলয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। স্থাপন করবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
‘২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে’ : বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে সংসদীয় কমিটিকে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ২৯ শতাংশ এবং মূল সেতুর ভৌতকাঠামো নির্মাণ অগ্রগতি ১৯ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া সিএনজি চালিত অটোরিকশার ড্রাইভাররা মিটারে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কমিটি। একই সঙ্গে ড্রাইভাররা যাতে যাত্রীদের বাধ্য করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারির সুপারিশ করে কমিটি। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব তথ্য জানানো হয়।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এ কে এম আউয়াল (সাইদুর রহমান), রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, নুরুজ্জামান আহমেদ, ফয়জুর রহমান, নাজমুল হক প্রধান, মো. মনিরুল ইসলাম এবং লুত্ফুন নেসা বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে আরও জানানো হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৪৬৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৩২.৮৮ শতাংশ। বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। একই সঙ্গে চলমান প্রকল্প এলাকা সংসদীয় কমিটিকে সরেজমিন পরিদর্শনের সুপারিশ করে কমিটি। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে কোনো টেকনিক্যাল টিম বিদেশে প্রেরণের আগে সংসদীয় কমিটিকে অবহিত করার সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।