বাংলার ঘুড়ি চীনের আকাশে
পুরনো ঢাকায় বড় হয়েছি। ঘুড়ির প্রতি বিশেষ ভালো লাগা তো থাকবেই। তবে ভেবেছিলাম শৈশবের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘুড়ির খেলাও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া শৈশবের আনন্দ নতুনভাবে ফিরে পেলাম চীনে গিয়ে। বেইজিংয়ে থাকার সময় দেখেছি পার্কে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন বয়স্ক মানুষরা। এইসব ঘুড়ির সঙ্গে যন্ত্র লাগানো থাকে। সেগুলো খেলনা বিমানের মতো ওড়ে। আবার যন্ত্র লাগানো ছাড়া ঘুড়িও দেখেছি অনেক। চীনের যেকোনো পার্কের সামনে ঘুড়ি বিক্রি হয় দেদার। বিশাল আকৃতির ঘুড়ি ওড়াতেও দেখেছি বাড়ির কাছের পাচিয়াও পার্ক এবং স্কালপচার পার্কে। ঘুড়ি উৎসব হয় এমনটাও আগেই শুনেছিলাম কিন্তু চীনে চাকরি করার সময় সেই উৎসব দেখার সুযোগ হয়নি।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের দলের সদস্য হয়ে আবার চীন গিয়ে সুযোগ মিলল ঘুড়ি উৎসবে অংশ নেওয়ার। এই উৎসবে গিয়ে বুঝলাম ঘুড়ি নিছক ‘ছেলেখেলা’ নয়। কেবল ‘ছেলেদের’ খেলাও নয়, ঘুড়ি উৎসবে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রচুর সংখ্যক মানুষ এই মনোমুগ্ধকর খেলাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।
বিশ্বে ঘুড়ির জন্মস্থান চীন দেশ এবং বিশেষভাবে ওয়েইফাং শহর। শান তুং প্রদেশের ওয়েইফাং শহরে প্রতিবছরই ২০ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে পাঁচদিন ধরে চলে ঘুড়ি উৎসব। ২০১৩ সালে সেই উৎসবে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশসহ প্রায় ৪০টি দেশের ঘুড়িপ্রেমীরা।
প্রথমে শোনাই এই উৎসবে আমার অভিজ্ঞতার গল্প। সে বছর হঠাৎ করেই দারুণ শীত পড়ল এপ্রিলের ১৯ তারিখে। অকালে তুষারপাত শুরু হলো। বেইজিং থেকে যখন শানতুংয়ের দিকে ট্রেন যাচ্ছে তখনি চারপাশে তুষারের চিহ্ন দেখে অবাক হয়েছি। কারণ এপ্রিলে কখনও চীনে তুষার দেখিনি। যাই হোক ২০ এপ্রিল সকালবেলা পৌঁছালাম উৎসব ভেন্যুতে। ওয়েইফাং শহরের প্রান্তে ফু-ইয়ান-শান আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উড্ডয়ন মাঠে এই উৎসবের আয়োজন করে চীনের রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় ওয়েইফাং ইন্টারন্যাশনাল কাইট ফেডারেশন।
২০ এপ্রিল সকাল ৮টা থেকেই বিস্তৃত প্রান্তরে ঘুড়িপ্রেমীকরা জমায়েত হতে থাকেন। ওয়েইফাংসহ চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে এর আগের দিন বিকেল থেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হওয়া তুষারপাত তখনও চলছিল। পুরো মাঠ ও আশপাশের এলাকায় তুষারের আচ্ছাদন। মেঘলাআকাশ ও তুমুল তুষারপাত উপেক্ষা করে ওয়েইফাংয়ের আকাশে ওড়ে শত শত বিচিত্র বর্ণের ও আকৃতির ঘুড়ি। বরফ ঢাকা মাঠে বিভিন্ন বয়সের শত শত ঘুড়িয়ালের পদচারণা। রঙিন মেঘ উড়িয়ে ঘোষিত হলো উৎসবের উদ্বোধন। বরফ ঢাকা মাঠে, মেঘলা আকাশে সেই বহু বর্ণের মেঘ সৃষ্টি করল চোখ জুড়ানো দৃশ্যের।
সকাল সাড়ে দশটায় উৎসবের উদ্বোধন হয়। চীনের ঐতিহ্যবাহী বেইজিং অপেরা শিল্পীদের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটে উদ্বোধনী সাংস্কৃতিক উৎসবের। পর পর পরিবেশিত হলো ড্রাগন নৃত্য, উশু এবং চীনের ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য নৃত্য। শিল্পীদের বর্ণিল পরিবেশনা ও মেঘলা আকাশে অসংখ্য বর্ণিল ঘুড়ির উপস্থিতি পরিবেশকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে। ঘুড়ির জন্মভূমি চীনের ওয়েইফাংয়ে। এই উৎসবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ির উড্ডয়ন চলছিল সেদিন।
বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মৃধা বেনুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বাংলাদেশ দলে ছিলেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, মাহমুদ হোসেন তওফিক বাবর, চীন আন্তর্জাতিক বেতারের সাংবাদিক শিহাবুর রহমান ও আমি। উৎসবের দ্বিতীয় দিন ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ দলের সদস্য মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আবদুস সামাদ ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় দিন ছিল প্রথম দিনের সম্পূর্ণ বিপরীত। ঝকঝকে রোদ। তুষারের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। চারদিকে ফাল্গুনের বাতাস বইছে। চীনের খামখেয়ালি আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচয় থাকায় আমি, শিহাব, বাবর ভাই এবং বেনু ভাই অবাক হইনি। কিন্তু ভীষণ অবাক হয়েছেন দলের দুই ঘুড়িয়াল। আগের দিন তারা পরে ছিলেন সাধারণ ফুলহাতা শার্ট। সঙ্গে কোনো সোয়েটারও তারা আনেননি। ভেবেছিলেন গ্রীষ্মকালে আবার সোয়েটারের দরকার কি? বরফের মধ্যে সারাটা সকাল তারা ঠকঠক করে শীতে কেঁপেছেন। শীতের ঘটা দেখে বিকেলে অনেক টাকা ব্যয় করে গরম জ্যাকেট কিনেছেন। আজ সেই গরম কাপড় পরে চৈত্রের রোদে তারা রীতিমতো ঘামছেন| সহানুভূতি জানানো ছাড়া আর কি করার আছে আমাদের।
সকাল ৮টা থেকেই মাঠে উড়ছে বৈচিত্র্যময় ঘুড়ি। রয়েছে প্রজাপতি, পাখি, অক্টোপাস, ড্রাগন, স্টিংরে, পুতুলসহ বিভিন্ন রকম ত্রিমাত্রিক ঘুড়ি
বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া দুই প্রতিযোগী
সকাল দশটায় শুরু হলো কাটাকাটি লড়াই। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে অত্যাধুনিক হুইল আর ঘুড়ির সঙ্গে লড়াইয়ে নামলেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। পুরান ঢাকার বংশালের যুবক তিনি। ছোটবেলা থেকেই ঘুড়ি উড়িয়েছেন, খেলেছেন কাটাকাটি খেলা। চীনের মাটিতে এসে নিয়মকানুন বুঝে নিতেও সময় লাগল কিছুক্ষণ। ভাষার সমস্যা তো রয়েছেই। তবু চীনের এক প্রতিযোগীর ঘুড়ি ভোকাট্টা করে পৌঁছে গেলেন তৃতীয় রাউন্ডে। বাংলাদেশের আরেক ঘুড়িয়াল আবদুস সামাদও বংশালের যুবক। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির ছাদে আর ধূপখোলার মাঠে ঘুড়ি উড়িয়েছেন। চীনে এত ধরনের ঘুড়ি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন তিনি। আগামীতে আধুনিক কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেন দুজনই। কাটাকাটি লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের এক ঘুড়িয়ালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলেন হংকংয়ের এক প্রতিযোগী।
ওয়েইফাংয়ে আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অংশ নিচ্ছেন শাহজাহান মৃধা বেনু। তিনি বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি উড্ডয়নের পথিকৃৎ। দেশজ ঐতিহ্য ঘুড়ি ওড়ানোকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্বের অধিকারী তিনি। তাঁর সংগ্রহে আছে শতাধিক রকম ঘুড়ি। তিনি শুধু ঘুড়ি সংগ্রহই করেন না, নিত্য নতুন নকশার ঘুড়ি উদ্ভাবনও করেন। ওয়েইফাংয়ে এসেই বেনুভাই নতুন ঘুড়ি সংগ্রহে মেতেছেন। সারা শহর চষে বেড়াচ্ছেন নতুন নকশার ঘুড়ি খোঁজে। এ দিকে আমি আর শিহাব দেখছি নানা রকম ঘুড়ির খেলা। দেখতে দেখতে শিহাবুর রহমানেরও ঘুড়ি ওড়ানোর শখ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ছোটবেলায় তিনিও তো কম ঘুড়ি উড়াননি। ব্যস, এক ঘুড়ি বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে নিয়ে তিনিও ভালোই ওড়ালেন কিছুক্ষণ।
ঘুড়ি উৎসবে অংশ নিয়ে আরেকটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো। রাতের বেলা ঘুড়ির মেলা দেখলাম তারাভরা বসন্তের আকাশে। উৎসবে প্রতি রাতেই ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন ছিল। এলইডি ঘুড়িও ছিল। তার মানে লাইট ইলেকট্রনিক ডিভাইস লাগানো ঘুড়ি। এগুলো আলো ঝলমলে ঘুড়ি। তাই অন্ধকার আকাশে দারুণ ভালো লাগে দেখতে। মনে হয় আকাশের তারারা নেমে এসেছে আমাদের কাছে। পাখি, প্রজাপতি, ড্রাগন, সাইকেল, লন্ঠন, পিরামিড, স্টিংরে, আরও কত আকৃতির আলো ঝলমলে ঘুড়ি যে দেখলাম রাতের আকাশে তা বলে শেষ করা যায় না।
দিনের বেলা আরেক ধরনের ঘুড়ি প্রতিযোগিতা হলো। সেটা দলবদ্ধভাবে ঘুড়ি ওড়ানোর লড়াই। তিন, চারজন থেকে শুরু করে দশ বারোজন মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই নিজের নিজের লাটাই হাতে সমান তালে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। একেকটি ঘুড়ির দল আকাশে সমান তালে নাচছে বাজনার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে। এ ঘুড়ি ওড়াতে কেমন লাগে জানি না। তবে দেখার অনুভূতি অসাধারণ। একে নাকি বলা হয় ঘুড়ির ব্যালে। সত্যিই ঘুড়ির নাচ।
ঘুড়ির মাঠে শুধু যে ঘুড়ি উড়ছে তা নয়, মেলাও বসেছে। কেনাবেচা হচ্ছে হরেক রকম ঘুড়ি। ইচ্ছে করছিল দেশে নিয়ে যাই বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি। কিন্তু বয়ে নিতে হবে ভেবে মাত্র একটি ঘুড়ি কিনলাম। এদিকে বেনু ভাই ঘুড়ির কারখানা থেকে কিনে এনেছেন বেশ কিছু নতুন ধরনের ঘুড়ি। এগুলো দেশে নিয়ে যাবেন তিনি। আমাদের সবাইকে উপহারও দিলেন সুদৃশ্য ঘুড়ি।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।