বছরব্যাপী ধর্ষিতা 'আয়েশা'র শরীরে এইচআইভি
বছর তিনেক আগের এক ডিসেম্বরের রাতে নির্ভয়া কাণ্ড ভারতের রাজধানী দিল্লিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সমালোচনার ঝড় উঠেছিল দেশটির সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এবার বাংলার মেয়ে আয়েশা (নাম পরিবর্তিত)-র বছরভর গণধর্ষণের ঘটনা চলতি ডিসেম্বরে প্রকাশ্যে এসে ফের সেই নির্ভয়া-স্মৃতি উস্কে দিল। আয়েশা-কাণ্ডের ভয়াবহতা বহু গুণ বেড়েছে মেয়েটির শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের অস্তিত্ব মেলায়।
বাংলার কিশোরীর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনায় নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রও। ওই ঘটনায় ধৃত আসলাম ওরফে জব্বারের বিরুদ্ধে এনএসএ বা জাতীয় নিরাপত্তা আইনের ধারা প্রয়োগের জন্য উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে ইতিমধ্যেই ধৃতের বিরুদ্ধে এনএসএ-র ধারায় অভিযোগ এনেছে গাজিয়াবাদ পুলিশ। এছাড়া অপহরণ, ধর্ষণ, খুনের চেষ্টার মতো রুটিনমাফিক ধারা তো আছেই।
গাজিয়াবাদের পুলিশ সুপার (শহর) অজয় পালের বক্তব্য, ঘটনাটি মর্মান্তিক। নির্ভয়া-কাণ্ডের মতোই এই ঘটনায় জনমানসে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ওই কিশোরীর উপরে লাগাতার পৈশাচিক অত্যাচারে সব স্তরের মানুষই উদ্বিগ্ন। তাছাড়া একাধিক রাজ্য ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে এই নারী পাচার চক্রের সম্ভাব্য সম্পর্কের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশি সূত্রের খবর, ডায়মন্ড হারবার থেকে মেয়েটিকে অপহরণ করে প্রথমে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।
সেখান থেকে উত্তরাখণ্ড, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বেঙ্গালুরু, ম্যাঙ্গালোর হয়ে তারা ফিরে আসে গাজিয়াবাদেই। জব্বারকে জেরা করে ওই গণধর্ষণে বাবু নামে অন্য একটি লোকের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা বাবু অপহরণের সময় জব্বারের সঙ্গেই ছিল। ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পশ্চিমবঙ্গ রওনা হয়েছে গাজিয়াবাদ পুলিশের একটি দল। গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতাল সূত্রের খবর, এইচআইভি ভাইরাস ঢোকায় ওই কিশোরীর সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিয়েছে। ধৃত জব্বার জেরার মুখে স্বীকার করেছে, সে এইচআইভি পজিটিভ এবং সে-ও আয়েশাকে ধর্ষণ করেছে বহুবার।
বিভিন্ন সময়ে পাচার হওয়া মেয়েদের দেহ-ব্যবসায় নামানোর অভিযোগ উঠলেও এইচআইভি-তে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি কোনও মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, এমন অভিযোগ বা প্রমাণ আগে মেলেনি। জব্বার নিজের রোগের কথা জেনেও মেয়েটিকে ধর্ষণ করায় ঘটনাটির পৈশাচিকতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। এইচআইভি-র মতো মারণ রোগ ছড়ানো অপরাধ। মেয়েটিকে শুধু ধর্ষণই করা হয়নি, তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। খুনের চেয়ে কোন অংশে কম নয় এ অপরাধ।
এই অবস্থায় জব্বারের বিরুদ্ধে ওই নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্স (পক্সো) আইনে মামলা করারও সুপারিশ করা হচ্ছে। আয়েশার শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের অস্তিত্ব মেলার কথা হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়াল। দিল্লির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আয়েশাকে উদ্ধার করেছিল। ওই সংগঠন সূত্রের খবর, আয়েশার সংক্রমণ যাতে আর ছড়িয়ে না-পড়ে, চিকিৎসকেরা সেই চেষ্টাই করছেন। হাসপাতাল জানিয়েছে, মেয়েটিকে প্রথম ভর্তি করার সময় এমনই দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল যে, সামনে যাওয়াই যাচ্ছিল না। কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সংক্রমণ কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটির নিম্নাঙ্গ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, পা দু’টি অসাড় হয়ে গেছে। তার উপরে এইচআইভি ভাইরাস ধরা পড়ায় চিন্তার ভাঁজ বেড়েছে ডাক্তারদের কপালে। আয়েশার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। শুক্রবারেও এক দফা রক্ত দেওয়া হয়েছে তাকে।
আয়েশা পুলিশকে জানিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় বারবার বহু লোকের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ওষুধ খাইয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হতো। মেয়েটির শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ায় গত সপ্তাহে তাকে গাজিয়াবাদের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে পালিয়ে যায় জব্বারেরা। অবস্থার অবনতি হতে থাকায় সোমবার তেগবাহাদুর হাসপাতালে পাঠানো হয় আয়েশাকে। আয়েশা-নিগ্রহ যে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা মেনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও। তাদের বক্তব্য, গত দেড় দশকে নারী পাচার ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। এক কর্তার কথায়, ''উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও নেপাল হয়ে মেয়েরা প্রথমে আসছে পশ্চিমবঙ্গে। সেখান থেকে তাদের পাঠানো হচ্ছে দিল্লিতে। যারা দেখতে ভাল, তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মুম্বাই। সেখান থেকে দুবাই, এমনকী আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে পূর্ব ভারতের মেয়েদের।'' আয়েশার উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে ঋষিকান্ত বলেন, ''গত দু'বছরে পশ্চিমবঙ্গের শ'খানেক নাবালিকাকে উদ্ধার করেছি। যাদের গড় বয়স ১৪-২০ বছর। আয়েশার মতো বহু মেয়েকে দিল্লিতে আটকে রাখা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।'' তাদের মধ্যে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর আর দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আসা মেয়ের সংখ্যাই বেশি বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
উত্তরবঙ্গের মেয়েদের মূলত শিশু শ্রমিক ও যৌন ব্যবসায় নামানো হচ্ছে। আর দক্ষিণবঙ্গের মেয়েদের মূলত বেচে দেওয়া হচ্ছে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানে। যে-সব রাজ্যে পুরুষের অনুপাতে নারী কম, সেখানে একাধিক ভাইয়ের একমাত্র স্ত্রী হয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ওই মেয়েরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশে পাচার চক্রের শিকার হয়েছেন ৪০ হাজার নারী। শিশুদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ১৬ হাজারের কাছাকাছি। তবে বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে এ হার আরও বেশি হবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।