‘জয় বাংলা তালেব’ আর এক দুঃখিনী মায়ের অনন্ত অপেক্ষার আখ্যান
সুনামগঞ্জ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নদীর অন্যপারের গ্রাম মঙ্গলকাটা। কৌশলগত কারণে 'বি' কোম্পানির কমান্ডার আব্দুল মজিদ মঙ্গলকাটায় জোর অবস্থান নেন। আবু হেনা চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাও এখানে এসে বাংকার করে স্থায়ী অবস্থান নেন। মঙ্গলকাটা হয়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গ।
তালেব নামের এক টগবগে যুবক দিনকয়েক পরে এসে যোগ দেয়। চমৎকার জয় বাংলা শ্লোগান দিতে পারায় এই তালেবের নামই হয়ে গিয়েছিল 'জয় বাংলা তালেব'।
হঠাৎ ২৭শে নভেম্বর পাকসেনারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের তীব্রতা এতই বেশি ছিল,মুক্তিযোদ্ধারা হতচকিত হয়ে যান। তিনদিক থেকে একযোগে আক্রমণ চালানোয় মঙ্গলকাটা ধরে রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তাঁরা কৌশলী হয়ে কিছুটা পিছু হটে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষই গোলাবারুদ সংকটে পড়ে যায়। হাতাহাতি যুদ্ধের উপক্রম হলে তালেবসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা চলতি নদীর বালুচরে পজিশন নেন।
কিন্তু নিয়তির নির্মমতম পরিহাসে একজন সঙ্গীসহ বালুচরে আটকা পড়েন তালেবউদ্দিন। মহান এই বীরকে হানাদাররা বেঁধে নিয়ে আসে পিটিআই এর টর্চার সেন্টারে। চলে অমানুষিক নির্যাতন।
হাজির করা হয় জুবিলী স্কুলের মাঠে। সেখানে উপস্থিত জনতার সামনে তাঁকে আরেকদফা অত্যাচার করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন,পাক বাহিনীর দোসর রহমান মিয়া জনসমক্ষে তাঁকে ভয়ানক মারপিট করে। তালেবকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল কী অমানুষিক নির্যাতনের শিকার তিনি হয়েছিলেন পিটিআই স্কুলে।
এই তালেবের পুরো নাম তালেবউদ্দিন আহমেদ। জন্ম দিরাইয়ে। হাইস্কুলে থাকতেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের ডাক এলে মহকুমার ছাত্র,যুবাদের সংগঠিত করতে নেমে পড়েন। প্রবল বিক্রমে লড়েছেন ডলুরার যুদ্ধে,মঙ্গলকাটা,ফেনী বিল,দিরাই অপারেশনে রেখেছেন অসম সাহসিকতার নজির।
সুনামগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। কাপুরুষের দল পালিয়ে যাওয়ার সময় আহসানমারা ব্রিজের কাছে লাইন ধরে ব্রাশফায়ার করে। গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত তালেবউদ্দিন গুলি লাগার আগেই পড়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। সহযোদ্ধাদের রক্তমাংসের স্তুপে পড়ে থাকেন। না,তালেবউদ্দিন বাঁচতে পারেন নি। ঘুরে এসে তাকে জীবিত দেখে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। লাশ ফেলে দেয় আহসানমারা ব্রিজের নিচে নদীতে। ভাসতে ভাসতে লাশ গিয়ে ঠেকে ভাটির এক গ্রামে। আট তারিখ তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
শেষবার মাকে দেখতে এসে কথা দিয়েছিলেন দেশ স্বাধীন করে ফিরবেন খুব শিগগিরই। তাজা রক্ত ঢেলে দেশ স্বাধীন করেছেন,কিন্তু মায়ের কোলে আর ফিরতে পারেননি বীর তালেবউদ্দিন। আক্ষরিক অর্থেই সেই দুঃখিনী মা আজো উঠোনের কোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন তাঁর তালেব ফিরবে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস,তালেব কথা দিয়েছিল,সে আসবেই।
দেশ স্বাধীনের পরে শহীদ তালেবউদ্দিনের নামে তাঁরই স্মৃতিবিজড়িত সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়। ছবিতে দেখুন জরাজীর্ণ সেই ছাত্রাবাস। ১৯৯১-১৯৯২সালে কলেজের ছাত্র সংসদের উদ্যোগে ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় শহীদ তালেব-গিয়াস-জগতজ্যোতি স্মৃতিফলক।
তালেবউদ্দিন শহীদ হওয়ার ৪৩ বছর পর একদল প্রতিবাদী তরুণ আমার চোখে জল এনে দিলেন। 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস তালেব জগৎজ্যোতি স্মৃতি পরিষদ' এর ব্যানারে দাবি তুলেন আহসানমারা ব্রিজের নাম করণ করতে হবে শহীদ তালেবউদ্দিন আহমদের নামে। আজ,বীর তালেবের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তারা স্ব-উদ্যোগে সেখানে বসিয়ে এলেন নামফলক। আমার চোখে পানি এসে গেল। না,অনেক দামে কেনা এই দেশের সব এখনো নষ্টদের অধিকারে যায়নি। এই মানুষগুলোই মন্ত্রের মত একাত্তরকে পৌঁছে দিবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সালাম আপনাদের।
বীর তালেব ঘুমিয়ে আছেন প্রাণ দিয়ে কেনা এই দেশের প্রিয় মাটিতে। বীর শান্তিতে ঘুমান,আপনার উত্তরসূরিরা আপনাকে ভুলতে দেয়নি। নষ্টদের অধিকারে যাওয়ার সময়েই এটুকুই বা কম কী!
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।