- হোম
- >
- আইন-মানবাধিকার
- >
- শহীদদের স্বজনরা বিচারের আশায় দিন গুণছেন
শহীদদের স্বজনরা বিচারের আশায় দিন গুণছেন
১৯৭১ সালের ১৩ জুন। এদিন নীলফামারী জেলার অবাঙ্গালী বিহারী অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরতলীর গোলাহাটে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
পাক হানাদাররা স্থানীয় অবাঙ্গালী-বিহারীদের সহায়তায় প্রতারণার ফাঁদে ফেলে নারী-শিশুসহ ৪৩৭ জন মাড়োয়ারী এবং হিন্দু পরিবারের নর-নারীকে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়ে হত্যা করে। তারা লাশগুলোকে সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় গর্ত-খাল-খন্দকে পুঁতে রাখে।
দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে নিরপরাধ এসব শহীদদের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বেঁচে থাকা স্বজনরা ৪৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বর্ণনা দিতে আজো ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন। অনেকে স্বজন হারানোর সে স্মৃতি ভূলতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন।
এমনি শহীদ পরিবারের বেঁচে থাকা এক সন্তান মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের নিরঞ্জন কুমার আগরওয়াল নিজু (৫৩)। প্রজন্ম ’৭১-এর সৈয়দপুর শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিজু গোলাহাটে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।
তার ব্যবসায়ী বাবা রামেশ্বর লাল আগরওয়াল, বাবার তিন ভাই, চাচাতো-জেঠাতো ভাই ও তাদের বৌ-বাচ্চাসহ সেদিন নিজুর পরিবারের নয়জন সদস্য গোলাহাটের গণহত্যায় শহীদ হন। সৈয়দপুরের আরো অনেক পরিবারের সকল সদস্যকেই সেদিন হত্যা করা হয়।
গোলাহাট বধ্যভূমিতে সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একরামুল হক, সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সৈয়দপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র জিকরুল হকের উপস্থিতিতে নৃশংসতম এ গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
নিজু জানান, তখনকার মুসলিম লীগ নেতা এবং পিস কমিটির চেয়ারম্যান ইজাহার আহমেদ (গত মাসে সৈয়দপুরে মৃত্যুবরণ করে), তার ছোট ভাই নেছার আহমেদ (এখন পাকিস্তানে), তৎকালীন এনএসএফ নেতা তৌকির আহমেদ কেনেডি (বর্তমানে সৈয়দপুরে) এবং আরো যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে পাক বাহিনী ১ জুন ১৯৭১ সালে ১৮৫ জন মাড়োয়ারী-হিন্দু পুরুষকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর গুলের নির্দেশে তাদেরকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সংস্কার এবং মাটিকাটার কাজে লাগিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।
অবশেষে ১২ জুন এক প্রতারণামূলক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রেনযোগে সীমান্তবর্তী হলদিবাড়ী ষ্টেশনে নিয়ে গিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে নরঘাতক মেজর গুল তাদেরকে জানায়।
নিজু জানান, পরিকল্পনা মোতাবেক আটক ১৮৫ জন মাড়োয়াড়ী এবং হিন্দু পুরুষকে ৪-৫ টি ট্রাকযোগে ১৩ জুন সকাল ৫-৬ টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈয়দপুর রেল ষ্টেশনে নেয়া হয়।
ভারতে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজে বাড়ী গিয়ে পরিবার-পরিজনসহ দ্রুত রেল ষ্টেশনে ফিরতে বলা হয়। এসময় শংকিত আটককৃতরা কিছুটা ’আনন্দচিত্তে’ তাদের বাড়ী যান।
অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়ী থেকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-শিশু সন্তানসহ সকলকে নিয়ে তারা মোট ৪৪৭ জন রেল ষ্টেশনে আসেন।
অশ্রুসজল নেত্রে নিজু জানান, হানাদার বাহিনী এবং অবাঙ্গালী বিহারীরা তার সামনেই পুরুষদেরকে দু’টি এবং নারী-শিশুসহ মহিলাদেরকে ভিন্ন দু’টি বগিতে তুলে সকল জানালা-দরজা বন্ধ করে দেয়। ট্রেনটি সকাল ৬-৭টার দিকে ছেড়ে যায়।
নিজু জানান, “ধীর গতিতে ট্রেনটি রওনা দিয়ে ষ্টেশন থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে গোলাহাট নামক স্থানে রেললাইনের কালভার্টের ওপর থেমে যায়। আমি ট্রেনটির পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে কিছুটা দুরত্বে দাঁড়াই। এসময় আশেপাশের ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর স্থানীয় গ্রামবাসীরা লুকিয়ে পড়ে।”
নিজু দেখতে পান- বগির দরজা খুলে একজন করে আটককৃত নারী-পুরুষ-শিশুকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে হানাদার এবং তাদের দোসর বিহারীরা ধারালো অস্ত্র, রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংস ও বীভৎস গণহত্যা চালাচ্ছে।
নিজু জানান, ছোট শিশুরা এসময় চিৎকার করায় তাদেরকে রেল লাইনের ওপর আছাড় দিয়ে এবং ওপরে ছুঁড়ে ফেলে নীচে বেয়নটে ধরে যুদ্ধাপরাধীরা তাদেরকে হত্যা করে। সেখানে ৪৩৭ জনকে মেরে ফেলা হয়। এসময় ১০ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
তিনি বলেন, “আমার মা শান্তিদেবী (৭৮) সেদিন ট্রেনটি ফেল করায় এখনো জীবিত থাকলেও বিগত ৪৩ বছর ধরে জীবন্মৃত। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন। যুদ্ধাপরাধীদের এখনো ফাঁসি না হওয়ায় তার মা হতাশ।”
সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একরামুল হক, সাবেক কমান্ডার জিকরুল হক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সাবেক এমপি আলীম উদ্দিন, সমশের আলী বসুনিয়া, অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন আহমেদ, সামশুল হুদা কদমসহ অনেকে গোলাহাট গণহত্যার এরকম ভয়ংকর বর্ণনা দিতে গিয়ে আজো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহ উদ্দিন বেগ বাসস’কে জানান, তার শহীদ পিতা এসএম মাহতাব বেগ তৎকালীন পাশ্ববর্তী চিরিরবন্দর উপজেলার ফতেজংপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পাক হানাদার এবং বিহারীরা সৈয়দপুরে বাঙ্গালীদেরকে আটক করে ফেললে তার পিতা একমাত্র বন্দুকটি নিয়ে তাদেরকে উদ্ধারের লক্ষ্যে সৈয়দপুরের দিকে রওনা হন।
এ সময় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ইজাহার আহমেদের নেতৃত্বে তার পিতাকে হত্যার পর তার শিরোñেদ করে তা ঝুলিয়ে বিহারীরা সৈয়দপুরে উল্ল¬াস মিছিল করে। ইজাহার-সহ অনেক যুদ্ধাপরাধীর ৪৩ পর এখনও সৈয়দপুরে বিনা বিচারে টিকে থাকাটাকে সমগ্র জাতির জন্য এক কলংক বলে উল্লে¬খ করে তিনি এসব যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার এবং ফাঁসি দাবী করেন।
শহীদ পরিবারের সন্তান নিজু এবং সালাহ উদ্দিন বেগ জানান, দেরীতে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। এ প্রক্রিয়া সফলভাবে এগিয়ে চলছে। আমরা ন্যায় বিচারের অপেক্ষায় আছি, সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হতে দেখে মরলেও শান্তি পাবো।
এ ব্যাপারে বাসস’র সাথে আলাপকালে সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একরামুল হক ও সাবেক কমান্ডার জিকরুল হক জানান, সৈয়দপুরের অনেক চিিহ্নত যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুবরণ করলেও বছর তিনেক আগে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের নিকট বর্তমানে জীবিত ৮৪ জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা জমা দেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, তালিকা মোতাবেক এখনো কোন যুদ্ধাপরাধী আটক না হওয়ায় সৈয়দপুরের মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় বের হলে অজ্ঞাত লোকজন তাদের পিছু নিয়ে থাকে বলে তারা জানান।
যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিচারের আওতায় আনায় সরকারের প্রশংসা করে তারা রংপুরে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের দাবি জানান। দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদেরকে আটক , বিচার সম্পন্ন ও সাজা কার্যকর করার মাধ্যমে শহীদদের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানান তারা ।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।