সিলিকোসিস আতংক, বুড়িমারী যেনো মৃত্যু ফাঁদ
বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকায় গড়ে উঠেছে পাথর নির্ভর শিল্প। ‘কোয়াইট জাস্ট’ ‘হোয়াইট বোল্ডার’ ও ‘লাইম স্টোন’ নামের এসব পাথর আমদানী করা হয় ভারত ও ভুটান থেকে। এর মধ্যে কোয়াইট জাস্ট পাথর মেশিনে ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। যা ব্যবহার করা হয় মোজাইক পাথর হিসেবে। হোয়াইট বোল্ডার গুড়ো ব্যবহার করা হয় সাদা সিমেন্ট তৈরিতে। আর লাইম স্টোনের গুড়ো ব্যবহার করা হয় হাস-মুরগীর খাবার তৈরিতে। এসব পাথর বুড়িমারীতে ভেঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয় মূল ফ্যাক্টরিতে। ফলে এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক মেশিন। যার প্রত্যেকটিই অনুমোদনহীন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এসব মেশিনেরও প্রত্যেকটিতে ১০জন করে শ্রমিক কাজ করে।
জানা গেছে, উভয় শ্রেণির মেশিন গুলোতে কাজ করায় পাথর ভাঙ্গার সময় বের হওয়া ধুলা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে এখানকার শ্রমিকরা কিছুদিন পর ‘সিলিকোসিস’ নামের এক ধরণের ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হন। এরপর বেশ কিছু দিন এ রোগে ভুগে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জাতীয় বক্ষবাধী হাসপাতাল ছাড়া স্থানীয় ভাবে এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা না থাকায় গরীব শ্রমিকরা ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যায় বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বিলস্ নামক একটি এনজিও’র তথ্য মতে, এ পর্যন্ত পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী এলাকায় ‘সিলিকোসিস’ নামের এক ধরণের ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪২ জন মারা গেছে। আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু দিন গুনছে আরও অর্ধ শতাধিক রোগী। রোগটি ২০০২ সালে এক গবেষণায় ধরা পড়লেও ২০০৫ সাল থেকে এরোগে আক্রান্তরা মারা যেতে থাকে ।
সরে জমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন সড়ক ও আশপাশের জমিতে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত এক শ্রেণির পাথর ক্রসিং মেশিন চলছে। এসবে নাক-মুখে কোনো ধরণের মাস্ক না পড়েই শ্রমিকরা পাথর ভাঙছে। আর চারপাশ দিয়ে উড়ছে পাথরের গুড়া। প্রায় একই অবস্থা দেখা যায় বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকার ‘কোয়াইট জাস্ট’ ‘হোয়াইট বোল্ডার’ ও ‘লাইম স্টোন’ ভাঙার মেশিনগুলোতেও।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব মেশিনে পাথর গুড়া করা হয়। ফলে পুরো এলাকা জুড়ে পাথরের গুড়ার স্তুপ জমে যায়। ওইসব মেশিনের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা। সেখানাকার কয়েকটি মেশিনে গিয়ে অধিকাংশ মালিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, এসব মেশিনের মালিকরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে এখানে মেশিন বসিয়েছেন। আর সে গুলোতে কাজ করেন শুধু স্থানীয় শ্রমিকরা। ‘মেমার্স ফাতেমা ফিড প্রডাক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কথা হয় নিজেকে এর মালিক দাবি করা মজিবর রহমানের সাথে।
তিনি বলেন, এখানে ভাঙ্গা পাথরের গুড়া মুরগীর খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এ কাজ মানুষের স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর বৈধ কাগজপত্র আছে দাবি করলেও তিনি তা দেখাতে পারেননি।
বুড়িমারীসহ বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাথর ভাঙ্গার বিভিন্ন ধরণের মেশিনে কাজ করে তাঁরা প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে পান। পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে পাটগ্রামসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার অভাবী মানুষ এসব মেশিনে কাজ করেন।
বুড়িমারীর বাণিয়াপাড়া এলাকার অসুস্থ শ্রমিক সর্দার আজানুর রহমান (৩০) বলেন, তাঁর নেতৃত্বে একসময় ১০০ জন শ্রমিক পাথর ভাঙ্গার কাজ করতো। তবে কিছুদিন কাজ করার পর যখন শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে মরতে শুরু করে তখন তিনি এ কাজ ছেড়ে দেন। তবে দুই বছর আগে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিলেও পুরোপুরি সুস্থ হননি।
ওই এলাকার অসুস্থ আরেক শ্রমিক আজিজুল হকের (৩৫) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় অসুস্থ অবস্থায় তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। পুরো শরীর শুকিয়ে গেছে। তিনি জানান, তিনিও মেশিনে পাথর ভাঙ্গার কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
অসুস্থ শ্রমিকরা জানান, সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হলে শরীর ধীরে ধীরে শুকে যেতে থাকে। কিছুদিন পর পর শ্বাসকষ্ট, কাঁশি, খাওয়ার অরুচি, অলসতাসহ ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। বুড়িমারী এলাকায় এরকম শতাধিক শ্রমিক এখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
বাণিয়াপাড়ার বজলুর রহমান (২৮), রশিদুর (২৫) সহ একাধিক অসুস্থ শ্রমিক বলেন, ‘গরীব মানুষ কিছু না বুঝেই ওইসব মেশিনে কাজ করতে যায়। এতে মেশিন মালিকরা বড়লোক হলেও শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে মারা যায়। কিন্তু মালিকরা আর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা বা খোঁজ রাখেননি’। অপরদিকে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরাও কোনো দিন এ বিষয়ে খোঁজ রাখেনি বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও উপ কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারুল ইসলাম সাজু পাথরের গুড়া ও ধুলা থেকে সিলিকোসিস রোগ হয় জানিয়ে বলেন, এ রোগের চিকিৎসা নেই এখানে। তাই এ রকম রোগী এলে তাদের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন মোস্তফা কামাল জানান, আমরা এ রোগে আক্রান্তদের মার্কস্ ব্যবহারের জন্য বলছি। তাছাড়া আক্রান্তদের যোগাযোগ করে জাতীয় বক্ষবাধী হাসপাতালে পাঠনোর ব্যবস্থা করছি।
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল হক জানান, পাথর ভাঙ্গা মেশিন গুলোর সাথে স্থানীয় শ্রমিকরা জড়িত থাকায় আমরা অনেক সময় অভিযান চালাতে গিয়ে বাঁধা মুখে পড়ি। তারপরও নিয়মিত অবৈধ পাথর ভাঙ্গা মেশিন জব্দ করতে অভিযান চালাছি। স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা না করায় সফলতা আসছে না। পাশাপাশি এ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সাইফুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘পাটগ্রাম ও বুড়িমারীতে যে কোনো ধরনের পাথর ভাঙ্গার মেশিনের মালিকরা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।