ঝালকাঠির চরাঞ্চলের অধিকাংশ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে
শহর থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার সড়ক পেরিয়ে কিস্তকাঠি আবাসন প্রকল্প। সেখানে ঘুম থেকে জেগেই কান্না করা রুমার নিত্যদিনের কাজ। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলে একটি থালায় কটি ভাত দিয়ে তার মা কাজে মন দেন। বাড়ির সামনের উঠানে বসে নিজ হাতে সেই ভাত খায় রুমা। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে থাকে। আবারও তার কান্নার সময় হয়। কান্নাকাটির এক পর্যায়ে আবারও থালায় কটি ভাত দিয়ে যান তার মা। বিকেল গড়িয়ে রাতেও তার জন্য কটি ভাত বরাদ্দ থাকে। চার বছর তিন মাস বয়সী রুমার বাবা সিদ্দিকুর রহমান শ্রম বিক্রি করেন। মা নাজমা বেগম গৃহিণী। দরিদ্র বাবার পক্ষে পুষ্টির জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই রুমা 'ভাত দিয়েই ভাত খায়।
'রুমার মা নাজমা বেগম বলেন, 'মায় ছায় তিনজন। তিন বেলা ভাত খাওনে কষ্ট, গুরাগ্যারারে ক্যামনে অন্য খাওন কিন্না দিমু! চরের গুরাগ্যারা ভাত খাইয়াই বড় অয়। আস মুরায় ডিম পাড়লে বেইচ্চা চাউল কিনি।
সন্তানের লেখাপড়া সম্পর্কে নাজমা বলেন, খাইয়া লইয়া বাঁচলেই অইবে। মাইয়া মানুষ, বড় অইলে বিয়া দিয়া দিমু। স্কুলে গ্যালে যাইবে? অভাবের কারণে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের তেমন ভাবনা নেই।
তিনি জানান, ১৩ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। চরের মেয়েদের ১০-১৫ বছরের মধ্যে মা-বাবা বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠান। কোনো কোনো মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয় স্বামীর ঘরে গিয়ে। শহরের মধ্যেই রয়েছে সিটি পার্ক সংলগ্ন চর। গাবখান নদীর মোহনার তীরে রয়েছে কলাবাগান নতুন চর। যেখানে ঘনবসতি ও অনুন্নত এলাকা বলেই শহরবাসীর কাছে পরিচিত। এখানে লোকসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। যাদের বেশির ভাগই শিশু এবং হতদরিদ্র পরিবার। তাই শিশুরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের অভাব মেটাতে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে যায়। মৌসুম পরিবর্তনে ওই শিশুদের পেশারও পরিবর্তন হয়। এ কারণে অনেক শিশুর নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না। আবার স্কুলে গেলেও অভাবের কারণে নিয়মিত ক্লাস করা হয় না অনেকের।
অনেক শিশু ঝরে পড়ে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হওয়ার আগেই। কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প, সিটি পার্ক সংলগ্ন চর, নতুন কলাবাগান চর এলাকায় গেলে দেখা মেলে শিশু লিমা, ইমাম হোসেন, রাকিব ও ইউনুসের সঙ্গে। ওই শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুলে যাওয়ার পর পেটে ক্ষুধা লাগার কারণে বাড়ি চলে আসছে। কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্পের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী লিমা বলেন, বেয়ানে দুগ্গা ভাত খাইয়া ইস্কুলে গেছিলাম। প্যাডে খিদা লাগছে। ইস্কুল দিয়া আইয়া পড়ছি। মার ধারে ভাত চাইছি। মায় কইছে ভাত নাই, চাউল ভাজাও নাই। একই ক্লাসে অধ্যয়নরত শিশু রাকিব বলেন, মায় কইছে দুপুরে ভাত দেবে। অ্যাহন প্যাডে ব্যামালা খিদা লাগজে। একই ধরণের বক্তব্য ইমাম হোসেন, মাহবুবুল ও ইউনুসের।
শিশু ইমাম হোসেনের মা কোহিনূর বেগম বলেন, একজনের কামাই। পাঁচ পোলা-মাইয়া। কেমনে তিন অক্তের ভাত ছাড়া অন্য খাওন গুরাগ্যারারে দিমু। আমাগো মতো মাইনসের গুরাগ্যারারে তিন বেলা ভাত দেওনই কষ্ট। অরা স্কুলে যায়। খিদা লাগলে আইয়া পড়ে। পান্তাভাত খায়, মোয়ার দিনে মোয়া খায়। আমাগো পোলা-মাইয়ার দিন এইরোমই চলে।
চরের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধান কাটা মৌসুমে এ শিশুরা স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে সংসারের আয় বাড়াতে ধানের ছড়া কুড়ায়। বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে। ৭ থেকে ১০ বছর বয়সে ছেলে শিশুরা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। আর মেয়ে শিশুদের ১০ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সে পাত্রস্থ করা হয়। বেশির ভাগ শিশু বেড়ে উঠছে অধিকার বঞ্চিত অবস্থায়। ভুগছে তারা পুষ্টিহীনতায়। অভাবের কারণে লেখাপড়া হচ্ছে না। শিশু বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ওই শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন। চরের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির কবির।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।