- হোম
- >
- ইতিহাস-ঐতিহ্য
- >
- তালে ঠিক !!
তালে ঠিক !!
সর্বনাশ !
তড়িঘড়ি মিটিংয়ে বসল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৩ সালে। বাংলায় নয়, সেই লণ্ডনে। কত বিশ্বাসঘাতকতা ষড়যন্ত্র করে, ওয়াদা খেলাফ খুনজখম করে স্বর্ণময়ী বাংলার সিংহাসনটা হাতানো গেছে (‘পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য দেশে প্রভুত্ব করার সৌভাগ্যে ইংল্যাণ্ড ভাগ্যবান’ - লর্ড কার্জন)। ঐশ্বর্য্যময়ী লক্ষ্মীর স্বর্ণশকট যখন একেবারে ঘরের দরজায় ঠিক তখনই লক্ষ্মীমন্ত বাংলাটা হাত থেকে প্রায় ফসকে যাবার জোগাড়। না না, বাঙালিরা নয়, বাঙালিরা ঠিকই আছে। আসলে গত সাত-আটশ’বছর পরাধীন থেকে জাতটা মোটামুটি বোকা হয়ে গেছে। সমস্যা অন্যত্র।
ব্যবসা করার সরকারি লাইসেন্স রিনিউ করার সময় হয়ে এসেছে। (সেই সময়ে প্রতি ২০ বছর অন্তর)। রুটিন একটা ব্যাপার কিন্তু দরখাস্ত করতে গিয়েই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির চক্ষুস্থির। লাইসেন্স অফিসে স্বর্ণময়ী বাংলার পরিমল লোভে অনেক অলিই এসে জুটেছে। বাঘা বাঘা কোম্পানি সব। নামে, প্রতিপত্তিতে, পয়সায় এবং আকারে সুবৃহৎ রাঘব বোয়াল, দু’চারটে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পনিকে পাঠানদের নেশোয়ার-এর মতো দাঁতের ফাঁকে গুঁজে রাখতে পারে। “যাদের মূলধন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির চেয়েও অনেক বেশি এবং যাদের সমগ্র বিশ্বব্যাপী শাখা অফিস রয়েছে” (কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী - এম. আর. আখতার মুকুল)।
“নো প্রবলেম। লাইসেন্স আমরাই পাব।“’
“কি-ঈ”?? ঘুরে তাকালো সভার সদস্যরা বাংলার বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিসের দিকে।
“কিভাবে ? আইন অনুযায়ী তো ওদেরই পাবার কথা”!
“লিখিত আইন অনুযায়ী। যেটা সর্বদাই অলিখিত আইনের কাছে পরাজিত হয়”।
“কিন্তু নানাদিক দিয়ে ওদের এত জোর ........”।
“মামার জোর সবচেয়ে বড় জোর। প্রাইম মিনিস্টার উইলিয়ম পিট আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পিট-এর সাথে কথা হয়ে গেছে আমার, লাইসেন্স আমরাই পাব ”।
হলোও তাই, সব জোরকে পরাস্ত করে মামাই জয়ী হল - সবার ওপর টেক্কা মারল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি।
বাংলার রঙ্গমঞ্চে তখন ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল-এর খেলা শুরু হয়েছে। সন্তর্পণে, অতি সন্তর্পণে সাম্রাজ্যবাদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। রাজ্যটা সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে কাড়া হয়েছে,তাই কিছুকাল মুসলমানদের কোণঠাসা করে রাখা খুব দরকার। ((যেন বিস্তীর্ণ গ্রাম-বাংলার তাবৎ মুসলমান সিরাজউদ্দৌলার জ্ঞাতি-গুষ্ঠি ছিল আর কি ! ))। হিন্দুদেরকে দুধকলা দিয়ে কোলে টানার সময় এখন। ওদের চটানো তো দূরের কথা ওদের শান্তির তিলমাত্র ব্যাঘাত ঘটানো চলবে না।
ল্যাঠা লেগে গেল। পাদ্রী উইলিয়ম কেরি মহা গণ্ডগোল বাধিয়ে দিলেন লণ্ডনে। ওদের বাণিজ্য ওরা করুক, আমি শান্তির ধর্ম বাইবেল প্রচার করব বাংলায়। অনুমতি চাই। মাথায় বাড়ি পড়ল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির। বলে কি পাদ্রীটা ! সবেমাত্র ১৭৫৭ সালে সিংহাসনটা বাগানো গেছে, পায়ের নিচে মাটি এখনো শক্তই হয়নি, এরই মধ্যে বাইবেল কেন রে বাপু! বাংলার হিন্দু-মুসলিম অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, এখনই পাদ্রী-টাদ্রী দেখলে আমরা আবার ওদের ধর্ম নষ্ট করে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রতিষ্ঠা করছি কিনা তাই ভেবে ওরা একত্রিত হয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাবে সে যে একেবারে ভারি নিশ্চয়! আগে লক্ষ্মী তো ঘরে উঠুক, যীশু-টিশু পরে দেখা যাবে।
“তাহলে লক্ষ্মীর জন্য প্রভু যীশুকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে”? - জ্বলন্ত চোখে প্রশ্ন করলেন কেরি।
“না, না, তা কেন – মোটেই তা নয়।যীশু তো সাক্ষাৎ প্রভু কিন্তু টাকা-পয়সার ব্যপারটা
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিনা...।’
“ধুত্তোরি গুরুত্বপূর্ণ! এই আমি চললাম বাংলায়। তোমাদের ভণ্ডামী তোমরা কর, প্রভুর বাণী আমি প্রচার করবই”।
জাহাজে ক’রে কেরি এসে নামলেন বাংলায়। হৈ চৈ পড়ে গেল কোম্পানির দপ্তরে, বেচারি পাদ্রী চালান হয়ে গেলেন বৃটিশ বাংলার বাইরে শ্রীরামপুরে, ডেনমার্কের সওদাগরদের আস্তানায়। ওদিকে প্রস্তাব পাশ হলো লণ্ডনের সংসদে, প্রভু যীশু তো ধৈর্যের অবতার, সহিষ্ণুতার প্রতীক। বছর বিশেক অপেক্ষা করতে তাঁর বিশেষ কষ্ট হবে না। এদিকে টাকাপয়সার কোনো ভরসা নেই, তার দেবী লক্ষ্মী বেজায় অস্থির - এই আসেন আর এই উধাও হন। কাজেই হাতে ছাই মেখে লক্ষ্মীকেই আগে জাপটে ধরা দরকার যাতে পিছলে বেরিয়ে যেতে না পারেন। কাজেই ২০ বছরের জন্য বাইবেল প্রচার বন্ধ করা হলো।
একখানা সাগরকলা পাশের দিক থেকে খাওয়া যাবে এমন দু’কান ছোঁয়া হাসি ফুটে উঠল কোম্পানির মুখে। ওগো হিন্দুরা, দেখ দেখ আমরা তোমাদের কতবড় বন্ধু। দেখ না বছরে ৫৩ দিন সরকারি ছুটির তালিকায় দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে রটন্তী অমাবস্যা, মৌনী সপ্তমী, উত্থান একাদশী সব ঢুকিয়ে দিয়েছি। আর আমাদের ক্রিসমাস? গুড ফ্রাইডে ? কোনো দরকার নেই। মুসলিমদের বড় ঈদ, কোরবানী ঈদ? দূর দূর ! ওগুলো আবার ছুটির দিন হবার যোগ্য নাকি ?
হতভম্ব হয়ে গেলেন কেরি। মুসলিমদের প্রতি একি অন্যায়! প্রভু যীশু হলেন ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক, আর এরা নিজেদের খ্রীষ্টান বলে দাবি করে! জুড়ে দিলেন চিৎকার।
((প্রমথনাথ বিশী-র বিখ্যাত ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’ উপন্যাসে উইলিয়ম কেরির গোমস্তা মুন্সী রামরাম বসুর বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিত্র চমৎকার ধরা আছে। একবার গ্রামের মানুষের কাছে প্রিয় হবার জন্য জনসভায় কেরি সাহেব "লেডিজ-অ্যাণ্ড জেণ্টলমেন"-এর বাংলা করে “উপস্থিত মাগী ও মিনসেবৃন্দ” বলায় মহা হট্টগোল হয়েছিল))।
কাদায় পড়ল কোম্পানি। হাজার হলেও সম্মানিত বিখ্যাত মানুষ। তাঁর এই চিৎকার দুনিয়ার কানে গেলে নাক কাটা যাবে, ইউরোপের খ্রীষ্টানপাড়ায় হুঁকো-নাপিত বন্ধ হয়ে যাবে। ল্যাঠা লাগলো দেখি পাদ্রীটা। কি করা যায়! চলল কূটনীতি। হাতজোড় করে কোম্পানি এসে দাঁড়াল সেই কেরিরই দরজায়।
“এত খরচাপাতি করে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজটা বানালাম। ছাত্ররা ভর্তিও হচ্ছে কিন্তু বাংলা
সংস্কৃত চালাবার লোক পাচ্ছি না। আপনি হাল না ধরলে বন্ধই হয়ে যাবে কলেজটা। প্লি --- জ”!
“তা না হয় ধরব। কিন্তু প্রভুর বাণী প্রচারের কি হবে”?
"নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আমরাও তো খ্রীষ্টান, আমরাও তো ওটা চাই! তবে কিনা, বিশ বছর বাইবেল প্রচার বন্ধের আইনটা সংসদে পাস হয়ে গেছে তো! তাছাড়া কয়েকটা বছর তো চলেই গেল। বাংলা ভাষাটা রপ্ত করতে, বাংলায় বাইবেল অনুবাদ করতেও তো কয়েক বছর যাবে। তারপর নমো নমো করে বিশটা বছর পার হলেই আর কোনো সমস্যা হবে না। কথা দিচ্ছি, যীশুর কিরে”।
রাজি হলেন কেরি – “যীশুর কিরে”-র প্রতি আস্থায়, নাকি বাধ্য হয়ে কে জানে - হাল ধরলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের। ১৮১৩ পর্যন্ত চলল বাংলা শেখা ও বাইবেলের বঙ্গানুবাদ। তারপর শুরু হলো বাংলায় খ্রীষ্টধর্মের প্রচার যা মোগল আমলেও কিছুটা চালু ছিল।
জাতটা জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক - জাতে যীশু হলেও তালে ছিল লক্ষ্মী। স্রেফ স্বার্থের জন্য নিজেদেরই গড-কে যারা ঠেকিয়ে রেখেছিল তাদের হাতেই আমাদের ভাগ্য ভাতকাপড় ছিল ১৯০ বছর !!
লেখক: ডিরেক্টর, শারিয়া আইন ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।