- হোম
- >
- উপ-সম্পাদকীয়
- >
- পাল্টা রবীন্দ্রনাথ
পাল্টা রবীন্দ্রনাথ

এদেশের মাটি, এদেশের জল/এদেশের বায়ু, এদেশের ফল/দূষিত হউক, দূষিত হউক, হে ভগবান!/ এদেশের ডাকু, এদেশের চোর/এদেশের লুট, এদেশের গোর, পূজ্য হউক, হে ভগবান! থমকে গেলুম। একী! শান্তিনিকেতনের পথে বাউলের মুখে এ-গান! গিজ গিজ করছে লোক! পয়সা পড়ছে হরিলুটের বাতাসার মতো। মেলায় ঘুরছি অনেকক্ষণ। এমন তো শুনিনি! পায়ের ঘুঙুর বাজিয়ে বাউল গাইছেন-
এদেশের তেল, এদেশের চাল,/এদেশের মাছ, এদেশের ডাল, লুপ্ত হউক, লুপ্ত হউক হে ভগবান! এদেশের পথে ঘাটে দূর্যোগ,/ঢের হউক ঢের হউক, ঢের হউক হে ভগবান!
এমনি হাততালি পড়েছে ঘন ঘন। একবার উঠেছে হাসির রোল। এক-একটা বাস আসছে, যাত্রীরাও নেমে পড়ছে ঠিক এখানেই এসেই। তাদের মুখে হাসি ধরছে না। আমার যেন পেট ছিরে যাচ্ছে। গানটা শেষ হল। ছড়ানো ছিটানো পয়সাগুলি তুলে নিচ্ছেন বাউল। রাখছেন তাঁর ছোটো একতারা ফাঁপানো পেটে। আমার কাছে আসতেই বললুম-বাঃ বাঃ, কী নাম আপনার? আনন্দিত বাউল বললেন-জগা বৈরাগী।
-এ আপনি কি গাইলেন ভাই? এও কি বাউল?/-না। এ পাল্টা রবীন্দ্রনাথ।–মানে? অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলুম।–লোকে এখন আর বাউল শুনতে চায় না বাবু। বলে, ওসব পুরোনো, পচা। তাই নতুন গান শিখেছি। একটু থেমে বললেন,-ভালো লাগল তো।সানন্দে বললুম-না লেগে উপায় কই! হ্যাণ্ডশেক করে বললুম-দারুণ গেয়েছেন! বলতে বলতেই ওর একতারা পেটে দিলুম একটা বিশ টাকার নোট। কাঁচুমাচু হয়ে বৈরাগী তাকালেন আমার দিকে। বললেন না না এত দিবেন কেন? পাঁচ টাকা দিন। বললুম-তা কী হয়! পাল্টা পাল্টি রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, তার দামই তো পঞ্চাশ টাকা। মৃদু হেসে বৈরাগী মাথা নেড়ে বললেন- বেশ বেশ একটু গাছতলায় আসুন, একটু জিরিয়ে নি, একটু জল খাই। আপনাকে এমনি অনেক পাল্টা শোনাবো।
দেখলাম চকচক করছে বৈরাগীর মুখ। কী প্রশান্ত হাসি! যেন কোনো দু:খ নেই, কোনো অভাব নেই, কোনো অভিযোগ নেই। সারা মুখে যেন তৃপ্তি উপচে পড়ছে। বেশ মানিয়েছে! যৌবনের রবীন্দ্রনাথের মতোই একমাথা চুল। ঘন দাড়ি। ফরসা ধবধবে রং। অনেকটা রবীন্দ্র রচনাবলীর ভানুসিংহের মতোই লম্বা। গাছতলায় উনি শতরঞ্জি পাতলেন, আমাকে আদর করে বসালেন, ঢকঢক করে জল খেলেন। হাসতে হাসতে একথা সেকথার পর আর পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। বললুম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক, রবীন্দ্রনাথ পড়াই। অমনি স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠলেন বৈরাগী। বললেন-তবে তো বাবু, আপনাকে ছাড়বোনি। আমার অনেক উপকার হবে। তারপর ধীর গলায় বললেন, লোকে এখন রবীন্দ্রনাথ গান, কবিতা শুনতেই চায়, শেখাবার তেমন গুরু পাই না।
কলকাতায় কত মিত্তির আছে, শুনেছি বড় ওস্তাদ। তাকে তো আর কেউ ধরতে পারবনি। তারপর ঢোক গিলে বললেন ছোটবেলা থেকেই ছড়া বানাতাম। মা বলতেন রবীন্দ্রনাথ হবি। যে-বছর রবীন্ত্রনাথ মারা গেলেন সেই বছরই আমার জন্ম। মায়ের হিসেবে, ওর মৃত্যর ঠিক দশমাস দশদিন পরেই আমার জন্ম। তাই আমাকে রবিকাকা বলে ডাকতেন। আমার ছড়া শুনে বলতেন লেখ লেখ, ওরে রবিকাকা আত্মাটা তোর মধ্যে ঢুকেছে। দেখছিস না, তোর আঙ্গুলগুলি, তোর নাকটা তেনার মতোই। আমাকে দাদু ডাকতেন পুচকে রবি বলে। আমার মা ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত। তাঁকে কতবার গান শুনিয়েছেন। এই বোলপুরের বাঁধাগোড়ায় আমার মামার বাড়ি। কবি একবার সে বাড়িতে এসেছিলেন। মজা করে মাকে বলেছিলেন, রানু তোর কেমন ছেলে চাই। মা বলেছিলেন-ঠিক তুমার মতো।
খানিক থেমে বৈরাগী বললেন- না, আপনার খামকা সময় আছে। আমার শ্রোতারাও উশখুশ করছে। বলেই আমাকে টেনে নিয়ে এলেন শতরঞ্জির কাছে। বললেন- আপনার তো মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘শরৎ কবিতাটি’। আহা, কী মধুর মুরতী হেরিনু শারদ প্রভাতে। হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝড়িছে অমল শোভাতে।’
এবারে এর পাল্টাটা শুনুন-
আজকি তোমার কুরুণ মুরতি হেরিনু বোশেখ শোভাতে/হে মাতঃ ব ঙ্গ তোমার অঙ্গ খুবলে খাচ্ছে প্রভাতে!/জনগণমনে হৃদয় কম্প/পথে ঘাটে লাগে লফূম্প/ঝাণ্ডা উড়ায়ে ঠাণ্ডা করিছে কাহার মরিছে শ্রীহাতে/খুন ধর্ষণ, দেহ কর্ষণ ফুটিছে নতুন বিভাতে।
শুনেছি আর আশ্চর্য হচ্ছি! হাততালি পড়ছে আকাশ ভেঙ্গে লোক আর ধরছে না। ভীষণ ঠেলাঠেলি, চিৎকার, চেঁচামেচি। মনে হচ্ছে এবার পুলিশ চাই সামাল দিতে। তীরের মতো মাটিতে হুমড়ি খাচ্ছে পয়সা। না, একালের রবীন্দ্রনাথই বটে!বৈরাগী থামলেন। আমার কাছে এসে বললেন-কী, কেমন লাগছে বাবু? বিগলিত হৃদয়ে বললুম-চমৎকার লাগছে। পুষ্পকলির মতো নুয়ে বৈরাগী বললেন-তবে আরও দুটো পাল্টা শোনাই। জনসমুদ্রে তখন প্রচণ্ড জোয়ার-শোনান শোনান। শতরঞ্জির ওপর দাঁড়ালেন বৈরাগী। সুর করে আরম্ভ করলেন-জননী তোমার মাহাত্ন্য কথা উঠেছে ভবনে ভবনে/ছুঁরি লাঠি আর পিস্তলগুলি নাচানাচি করে সঘন।/অবসর ঢের অঢেল তোমার, দলে দলে ছোটে ভলেন্টিয়ার,/কে যে রক্ষক কে যে ভক্ষক সব একাকার সদনে/শুনে কালা আর দেখে কানা তুমি নিরব নিথর ভবনে।
খুলেছে তোমার হসপিটাল যে জুড়াইয়া ভব যাতনা,/মুঠোমুঠো যেন লুটের বাতাসা ঝেড়ে ফেলে প্রাণ চেতনা।/গরীব রোগীরা আসে আর যায়,/এদিকে ওদিকে যেদিকে তাকায়/ কোথায় যে হয় কোনো সন্ধান নেই তার কোনো ঠিকানা/দালাল বাবুরা এসে হাত ধরে দেখে বাবুদের মাতনা।
এবার বৈরাগী প্রচণ্ড ঘামছে। আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ছে জনতা। সারা মেলাটাই যেন হুমড়ি খাচ্ছে আমাদের চারপাশে। বৈরাগী গেয়েই চলেছেন-
খুলেছে স্কুলেতে বিশ্রামাগার লেখাপড়া গেল আকাশে/ক্লাস হয় নাকো টিউশনি চলে গরম টাকার বাতাসে/অফিসে অফিস ঘুষের বাতা, ডানে বাঁয়ে ঘন কার নিঃম্বাস/ধর্মঘট আর মিছিলের ফিতা কাহারা কাটিয়েছে সকাশে,/হে মাতঃ বঙ্গ এখনও কি তোর থাকিবে এ মুখ ফ্যাকাশে?
বৈরাগীর গলা উঠেছে তুঙ্গে, কলরব উঠেছে সমানে। বৈরাগী গেয়ে চলেছেন-
আয় আয় আয় যে আছো যেথায় আমার চাঁদোয়া তলেতে, ধন দৌলত গাড়ি বাড়ি জুটি নিরাপদ এর কলেতে।/ ও ঘর হইতে আয় খোঁড়া কানা,/ ও বাড়ি হইতেক আয় ছানাপোনা,/ মেয়ে কি মরদ বুড়ি কি বা ছুড়ি উঠে আয় সব মুখরি/ জোরেরই ভোগ্য ও বসুন্ধরা, সে কথা ওঠ ফুকরি।
যতই শুনছি ততই অবাক হচ্ছি! কি মানুষ! একজন বৈরাগীর এত জানা! আমি রবীন্দ্রকাব্যের ডক্টরেট। রবীন্দ্র সাহিত্য পড়াচ্ছি দীর্ঘ ৩০ বছর। নিজেকে খুব ছোটো মনে হল। হঠাৎই ভিড় ঠেলে ঢুকল একদল তরুণ। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। খুব পরিচিতির মতোই বলল- ও বৈরাগী দাদা, সেই পরীক্ষার পাল্টাটা শোনাও না। ছ্যাঁক করে উঠল বুকটা। অধ্যাপকদের ক্লাস ফাঁকির কথা উঠেব নাকি। আমার শুকনো মুখ দেখে বৈরাগী বললেন-
প্রফেসার বাবু, আপনি তো রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটি পড়েছিলেন-‘বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা? বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
কিন্তু একালের ছাত্র কি বলে শুনুন- ছাত্র তার পরীক্ষার কথা। বলছে-
বিপদে মোরে রক্ষা কর, একান্ত এ প্রার্থনা,/টুকিতে প্রাণে না যেন জাগে ভয়।/সাহস প্রভু দাও গো চিতে, ফাঁকিতে মন ক্লান্ত না/বুঝেই ম্যানেজ করিব নিশ্চয়।/হেলপার কেউ না যদি জুটে, বইয়ের পাতা লইব লুটে/ তেমন গার্ডে ধরিলে জানি জুটিবে বড় লাঞ্চনা।/হৃদয় যেন না আসে সংশয়।/টেস্টে টুকে এলাও আমি ধরতে কেউ পারল না/ফাইনালেতে মানটা যেন রয়।/ধরতে এসে গার্ড বাবাজি পড়েন যেন বিপাকে,/ নাকে মুখে বাতাস দিতে হয়।/ দেখিয়া নিও পাসের দিনে বিরাট পাঁঠা আনিব কিনে/ তোমায় প্রভু ধাপ্পা দিয়ে করব নাকো বঞ্চনা,/ চুটিয়ে যেন প্রথম শ্রেণি হয়।/ বিপদে মোরে রক্ষা কর, একান্ত এ প্রার্থনা/টোকার যেন সকল সুযোগ হয়।
থামলেন বৈরাগী। আহ্লাদিত তরুণেরা তাঁকে কাঁধে তুলে নাচতে আরম্ভ করল। তরুণেরা বলল-
বৈরাগী দা, এবার সেই হাতকাটা কারকাটা মাছ ধরা লণ্ঠন হাতা। ভোটবাবুদের ছাপ্পা ভোটের গানটা শোনান। অমনি বৈরাগী বিদ্যুৎ বেগে নেমে পড়লেন মাটিতে। বললেন, বেশ বেশ। ভোটবাবুদের গানটাই শোনাই। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-আপনি তো স্যার, রবীন্দ্রনাথের ‘শাজাহান’ কবিতাটা পড়েছেন-
‘একথা জানিতে তুমি ভারত ইশ্বর ‘শাজাহান’। কলস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান।’
তার পাল্টাটা শুনুন-
একথা জানিতে তুমি ভোটবাবু ভারত ইশ্বর ভগবান।/ছাপ্পা ভোটের স্রোত হাতকাটা কানকাটা গলাফাটাদের যত দান/ অন্য কিছুই নহে শুধু এই দামি গদিখানা/ চিরন্তর হয়ে তাক এই ছিল একান্ত সাধনা/ তাই শুধু চলিয়াছি দ্বারে দ্বারে এই বার্তা নিয়া/গদি চাই, গদি চাই, গদি চাই, গদি চাই প্রিয়া।
উল্লসিত তরুণেরা। উচ্ছ্বসিত জনতা। বৈরাগী থামতেই এক তরুণ বলল-এবার রবীন্ত্রনাথের ১৪০০ সাল শোনান। বৈরাগী বললেন-বর্ধমানের তেলমাড়ুই-এরন ডাক্তার অন্ময়ের সেই গানটা? বেশ, বেশ। বলেই আরম্ভ করলেন-
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি ঝাপিলে কৌতুহল ভরে।/ আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে ডুবিছ বাবা আমাদের ইতিহাসে নন্দন সাগরে। আজিকার দলবাজির শাসানির লেশমাত্র ভাগ? নিজ জন পোষণের ফাইলে উধাও-এর দাগ,/ভ্রাতৃবধু, বধুহত্যা, শ্বাশুড়ি ও পিতারে লাঞ্ছনা,/ বেকারের শুকনো মুখ, ধনঞ্জয় ফাঁসিকথা-/পাঠাইতে পারি না পারি না/ তোমাদের ঘরে। আজি হতে শতবর্ষ পরে।
দেখি বৈরাগী যেন থামতেই চাইছে না। জনসমুদ্রের এমন উত্তাল রূপ কোনো বড় পার্টির মিটিংয়েও দেখিনি।
আমি ছুটে গিয়ে তাঁর হাত ধরলুম। বললুম-এক্সেলেন্ট। জনসমুদ্র যেন একটা বিরাট বেলুন এক মুহুর্তে চুপসে উঠল। একটা বাস আসছিল। আমি ছুটে গিয়ে উঠলুম।
লেখক: লোকসংস্কৃতি গবেষক
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।