শিরোনাম |
- হোম
- >
- উপ-সম্পাদকীয়
- >
- মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমর নেলসন ম্যান্ডেলা
মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমর নেলসন ম্যান্ডেলা
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা সত্য, ন্যায় ও অহিংস দর্শনের প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় রাষ্ট্র নায়কদের একজন। তাঁর প্রধান শক্তি ছিল মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসা। দেশের স্বাধীনতার জন্য, সাম্যের জন্য সম্মানের জন্য তিনি লড়াই করেছেন। দেশবাসী যাতে স্বাধীনতার স্বাদ পায়, সে জন্য তিনি নিজের জীবনের স্বাধীনতা বিলিয়ে দিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার শক্তি ছিল অহিংস দর্শন। মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংস দর্শন তাঁকে শক্তি যুগিয়েছে, মহিমান্বিত করেছে এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে পরাভূত করেছে।বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে দেশে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে তাঁর মাতৃভূমি দক্ষিণ আফ্রিকাতেও চলছে ১০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। ১৫ ডিসেম্বর নিজ গ্রামেই নেলসন ম্যান্ডেলাকে চির বিদায় জানানো হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার উমতাতু প্রদেশের মাভেজো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। জোহানেস বার্গের উইটওয়াটার স্ট্যান্ড বিশ্ববিদালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনার সময় বর্ণবিদ্ধেষের শিকার হন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন নিমজ্জিত ছিল বর্ণবিদ্বেষের অতল আঁধারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময়েই আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। পরের বছর ১৯৪৮ সালে আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বের সামনের সারিতে আসেন নেলসন ম্যান্ডেলা। অংশ নেন দলের স্বশস্ত্র সংগঠন উমখন্ত উই সিজওয়ের নেতা হিসেবে। সক্রিয় অংশ গ্রহণের দায়ে ১৯৬২ সালে বর্ণবাদী সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। সক্রিয় আন্দোলন অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয় ম্যান্ডেলাকে। তরুন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর রবিন দ্বীপের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হন তিনি। এরপরও বর্ণবাদের সঙ্গে কোনো আপোষ না করে তিনি বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর দলের হয়ে বর্ণবাদী সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা অংশ নেন। ফলশ্রুতিতে এরই ধারাবাহিকতায় সকল বর্ণের মানুষের অংশ গ্রহণে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে জয়লাভ করে আফ্রিকান কংগ্রেস। এরপর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্নে ভূষিত করে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শেতাঙ্গদের কাছে থেকে সহ্য করেছেন নির্যাতন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে শেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নীতি গ্রহণ না করার জন্য ম্যান্ডেলা নিজের দেশসহ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হন। বিশ্বব্যাপী একজন অসাধারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ম্যান্ডেলা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শান্তির পক্ষে কাজ করা এবং আফ্রিকার নবজাগরণে অনন্য ভূমিকা রাখার জন্য গত চার দশকে ম্যান্ডেলা পেয়েছেন ২৫০ টির ও অধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারও রয়েছে।দক্ষিণ আফ্রিকার আপামর জনতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে আদর করে ‘মাদিবা’ বলে ডাকতেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘের সহাসচিব বানকি মুন আফ্রিকার স্থপতি নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিনকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। জাতিসংঘের ১৯২ সদস্য মহাসচিবের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। এরপর থেকে জাতিসংঘ ১৮ জুলাই দিনটিকে নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করছে। বিগত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে ১৯৯৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর রমনা মঞ্চে আয়োজিত বিজয় দিবসের রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এ অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ডেমিরেল সোলায়মান।এরা তিন জনই নিজস্ব স্বকিয়তার গুনে বিশ্বমান নেতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ। সেদিন বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে উপস্থিত ছিলেন বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় অতিথি রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা এক কালজয়ী বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যদি আজ ঘন্টার পর ঘন্টা বলি বর্ণবাদী শাসকগোষ্টি যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশ শাসন করার কারণে দেশের কোনো উন্নয়ন হয়নি। এতে আমাদের দেশের মানুষের কোনো লাভ হবে না। বরঞ্চ আমাকে স্মরণ রাখতে হবে দেশের মানুষ অপশাসনের অবসান ঘটিয়ে আমাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছেন। তিনি আরও বলেছিলেন, আজ আমাকে ভাবতে হবে আমি তাদের সেই স্বপ্ন ও আকাংখা পূরণে কতুটুক সক্ষম হয়েছি।আমাদের দেশের দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সরকার এবং বিরোধীদলের মধ্যকার সৃষ্ট দ্বন্দ্ব এখন ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। বিরোধী ১৮ দলের নেতারা আল-কায়দা স্টাইলে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে লাগাতার অবরোধ-হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচী দিয়ে সারাদেশে চালাচ্ছে নাশকতা। প্রতিদিন আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে নিরাপরাধ মানুষকে। অপরদিকে সরকার চলমান রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সাংবিধানিক ভাবে দেশের নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। সে ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হচ্ছে।ডিসেম্বর মাস জাতীয় ইতিহাসে বাঙালির বিজয়ের মাস। ৪২ বছর পর স্বাধীন দেশে এরকম বর্বরতা কারো কাম্য ছিল না। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজয়ের মাসটি যেভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠছে, এটি নিছক কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন বলে মনে করার কারণ নেই। কাজেই বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা জাতীয় দিবসের আন্তরিক উপলব্ধির দিক থেকেই যেকোনো সুনাগরিককে পরিপূর্ণ হতে হবে। একাত্তরের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আগামি দিনের নিঃশঙ্ক আনন্দ-গৌরব অম্লান রাখতে হবে। আমি এ সকল বিষয় নিয়ে গত বছর একটি নিবন্ধ লিখেঠিলাম। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল “নেলসন ম্যান্ডেলার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা।” আমার লেখাটি জাতীয় দৈনিকসহ স্থানীয় দৈনিক সমূহে প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ওই ঐতিহাসিক বক্তৃতাটি স্মরণ রাখলে আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়।নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বিশ্বনন্দিত নেতার মৃত্যু নেই। এই মহান কিংবদন্তি নেতা আমাদের মাঝে ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমর নেলসন ম্যান্ডেলা।লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট.
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।