পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে হালাল-হারাম বিতর্ক!
নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সংক্তৃতি নিয়ে বাঙালি মুসলমানরা বরাবরই দু’ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তি পরিলক্ষিত হয় পহেলা বৈশাখ উদযাপনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনাকে কেন্দ্র করে। একটি পক্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিভিন্ন যুক্তি এবং উস্কানি প্রদান করছে। আরেকটি পক্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করার জন্য প্রস্তুতিগ্রহণ করছে। এই দুই পক্ষের মাঝে একটি তৃতীয় পক্ষেরও দেখা মেলে। যারা বিভিন্ন হাদিস এবং কোরআনের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন ‘পহেলা বৈশাখ হালাল’। যদিও এই তৃতীয় পক্ষ সংখ্যায় খুবই কম।
মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিজাতীয় সংস্কৃতি আখ্যায়িত করে প্রহেলা বৈশাখ উদযাপন থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে বেশি কিছু ইভেন্ট খোলা হয়েছে। এসকল ইভেন্ট থেকে পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে নানা অপপ্রচার ছাড়াও দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় উস্কানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের পক্ষে যারা লিখছে তাদের নানা হুমকি প্রদান করা হচ্ছে এসকল ইভেন্ট এবং পেজ থেকে।
‘সত্যের সন্ধানে’ নামের একটি পেজ থেকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ‘শিরক’ আখ্যায়িত করে লেখা হয়-
“পহেলা বৈশাখ পালনের অন্যতম শিরক হচ্ছে কথিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করা হয়।
আল্লাহ্ বলেন- শুনে রাখ তাদের অশুভ আলামতের চাবিকাঠি একমাত্র আল্লাহরই হাতে রয়েছে, অথচ এরা জানে না। (৭।সূরা আঽরাফ:১৩১)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন- হে আল্লাহ্ তুমি ছাড়া কেউ কল্যাণ দিতে পারে না, তুমি ছাড়া কেউ অকল্যাণ ও দুরবস্থা দূর করতে পারে না। ক্ষমতা ও শক্তির আধার একমাত্র তুমী। (আবু দাউদ: ৩৯১৯)
আমরা বাঙালী জাতি। আমাদের অনেকের আরো একটা পরিচয় , আমরা মুসলিম জাতি । জাতিগত , ধর্মীয় উভয়ের সাথে সাংঘর্ষিক " মঙ্গল শোভাযাত্রা " নামক শিরক থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন ।”
মুসলমানদের বাঙালি হওয়া, অথবা বাঙালিদের মুসলমান হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন Shahjahan Babar- নামে একজন। তিনি পহেলা বৈশাখ উদযাপনবিরোধী ইভেন্টে পোস্ট করেন-
‘আপনি কখনো একসাথে মুসলমান এবং বাঙ্গালি দুটি হতে পারবেন না,আপনাকে একটি হতে হবে, হয় আপনি মুসলমান, না হয় আপনি বাঙ্গালি।’
Priya Aktar- নামে একজনের মতে ভারতীয়রা এবং শাহবাগীরা পহেলা বৈশাখ পালন করে। তিনি লিখেছেন- ‘এই ইভেন্ট নিয়ে চুলকানি ধরছে ভারতীয়দের আর শাহবাগীদের। অবাক হতে হয়। এদেশে তাহলে মঙ্গল ফাত্রার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না?’
ইসলামী বিভিন্ন যুক্তির পাশাপাশি অনেকে মুসলিম দেশসমূহে হওয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি/নিউজ লিংক পোস্ট করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনবিরোধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
Joyeta Sakib- নামে একজন লিখেছেন ‘আপ্নেরা সৌদি আর ফিলিস্তিন এর কালচার ফলো করার কথা কইতেছেন। কিন্তু নিচের লিঙ্ক টার রেফারেন্স দিলে আমি কি কমু?? এইখানে দেখা যাইতেছে রামাল্লায় নারীরা রঙ উৎসবে মাতছে।ওরাই যদি এমন করে তাইলে আমগো কি হইব খোদা?’
এই পোস্টে Ibna Islam নামে একজন কমেন্ট করেন- ‘এখানেত কেউ কি মঙ্গল শোভাযাত্রা বাদা দেয়ার কথা বলেছে। এখানে কারো ধর্ম যদি বাধা না দেয়, তাহলে সে যাবে এখানে বাদা কথায়...? আর ইসলাম এটাকে হারাম মনে করে, তার জন্য কিছু মুসলিম ভাই দের কে সচেতন করবার জন্য এই ইভেন্ট।’
Afnan Adnan Aziz নামে একজন পহেলা বৈশাখকে হারাম আখ্যায়িত করে লেখেন-
“প্রশ্নঃ পহেলা বৈশাখ পালন করা কেন হারাম ??
উত্তরঃ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পর মদীনা শরীফ গিয়ে ঐ এলাকাবাসীর দুটি উৎসব বন্ধ করেছিলেন। একটি হচ্ছে, বছরের প্রথম দিন উদযাপন বা নওরোজ; অন্যটির নাম ছিলো ‘মিহিরজান’।
এ উৎসবের দুটির বিপরীতে চালু হয় মুসলমানদের দুই ঈদ।”
Rubel Hasan নামে একজন আহ্বান করেন ‘পান্তা দিয়ে নয়, বছর শুরু হোক দু’রাকাত নামাজ দিয়ে’।
পহেলা বৈশাখকে ‘হিন্দুয়ানা সংস্কৃতি’ আখ্যায়িত করার প্রতিবাদ করে Pavel Ahmed লিখেছেন-
“পহেলা বৈশাখ নাকি হিন্দুয়ানা সংস্কৃতি!! এটি নাকি কোন মুসলিম মানতে পারবে না!! আরে হারাম জাদা তাইলে বাঙালী সংস্কৃতি কোনটি? লুঙী,কাটা পাঞ্জাবী তাহলেতো এই গুলোও হিন্দুয়ানা সংস্কৃতি। বাংলায় মুসলমানরা আসার আগে হিন্দুরা এই গুলো পরতো। তো এবার বল তুই মুসলিম কোন ইসলামী সংস্কৃতিটা পালন করছ?
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।
আচ্ছা ঈদের দিন কেউ যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে তাহলে আপনি কি ঈদের দিন কে দোষারোপ করবেন, নাকি যে ব্যাক্তি কিছু করলো তাকে দোষারোপ করবেন? কেউ যদি পহেলা বৈশাখে উল্টা পাল্টা রং মাখামাখি করে সেটাতো পহেলা বৈশাখের দোষ না। পূর্বের পহেলা বৈশাখ আর বর্তমান পহেলা বৈশাখ এক না। এটা ছিল কৃষকদের একটি সুস্থ সংস্কৃতি। তারা কাজ করতে করতে মাঠে হাফিয়ে গেলে মেলার আয়োজন করত। এটাতো দোষের কিছু না। কিছু কিছু বলদা আছে এরা সব জায়গায় ইসলাম নিয়ে আসে। এরা ১৪ ই ফেব্রুয়ারিতে, পহেলা বৈশাখে, এপ্রিল পুল ডে তে ইসলামের অবমাননা খুঁজিয়া পায়। তোর দায়িত্ব এইগুলা না, তোর দায়িত্ব নামাজ, রোযা রাখা। এইগুলার জন্যই তোকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।”
এছাড়া Mridul Ahmed একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবিতে দেখা যায় হিজাব পরা কিছু নারী এবং তলোয়ার হাতে নিয়ে আরবিদের পোশাকে কিছু পুরুষ। যেটিকে তিনি ‘পহেলা বৈশাখের হেফাজতী ভার্সন’ বলে আখ্যায়িত করছেন।
বিগত বছর পহেলা বৈশাখে রাজধানী ঢাকার টিএসসি এলাকাতে নারীদের উপর যৌন আক্রমণের ঘটনা ঘটে। যা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রথমে পুলিশ-প্রশাসন বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে পুলিশই ওই ঘটনার সাথে জড়িতদের ছবি প্রকাশ করে।
এবার পহেলা বৈশাখের আগেই পুলিশের পক্ষথেকে দিনটি উদযাপনের ক্ষেত্রে নানা ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভুভুজেলা এবং মুখোশ। এছাড়া বিকেল ৫টার মধ্যে সব ধরনের অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। পুলিশ প্রধান বলেছেন- বিকেল ৫টার পরে কেউ অপ্রীতিকর অবস্থার শিকার হলে পুলিশ দায় দায়িত্ব নিবে না।
বাঙালির সংস্কৃতি লালনের ক্ষেত্রে ধর্ম আদিম প্রতিবন্ধকতা হলেও নতুন করে যোগ হয়েছে নিরাপত্তার বিষয়টি। পহেলা বৈশাখে নারীদের উপর যৌন আক্রমণ হবে, বোমা হামলা হয়ে মানুষ মারা যাবে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা এর দায় নিবেন না। এভাবে যুদ্ধকরে কতোকাল পহেলা বৈশাখকে বুকে ধরে রাখতে পারবে তা দেখতে আর বেশি সময় হয়তো অপেক্ষার প্রয়োজন পড়বে না।
সবাইকে আগাম বৈশাখী শুভেচ্ছা।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।