আমাদের মেয়েরা মাথা নত করবে না
(১)
শনিবার এপ্রিলের দুই তারিখ বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে 'তনুদের লাঠি মিছিল' হবে। আয়োজন করেছে প্রীতিলতা ব্রিগেড। দৃশ্যতই মেয়েদের প্রোগ্রাম। ইভেন্টে আমি ক্লিক করেছি 'going', মানে কিনা আমিও যাচ্ছি। যাবো।
ছেলেরা অংশ নিবে কিনা জানিনা। কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া যদি বিধেয় না হয়, তাইলে দুরে থেকে দেখবো। আমাদের মেয়েরা লাঠি হাতে মিছিল করবে- প্রীতিলতার নামে ব্রিগেড বানিয়েছে আর যারা সেই মিছিলে অংশ নিবে ওরা একেকজন তনু- আমাদের সাহসী মেয়েদের প্রতিরোধ মিছিল। যাবো আমি। সরু গলায় বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করার পরিবর্তে লাঠি হাতে প্রতিরোধের প্রত্যয় ঘোষণা করছে তনুরা। যাবনা? যাবোই তো।
ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা উদ্যোগ নিয়ে 'প্রীতিলতা ব্রিগেড' বানিয়েছে গত বছরের পহেলা বৈশাখের সেই কলঙ্কময় ঘটনার পর। তখনই আমার বেশ লেগেছিল ব্যাপারটা। আপনাদের মনে আছে সেই ঘটনা? তখন আমাদের পুলিশ প্রধান কি বলেছিল মনে আছে? পহেল বৈশাখের সেই ঘটনা নিয়ে সরকারী দলের মন্ত্রী ইত্যাদি যারা আছেন ওদের মন্তব্য মনে আছে। এই সেদিন শাহজাহান খান কি বলেছিল মনে আছে?
পহেলা বৈশাখে সেই ঘটনা, এর পরের আন্দোলন আর সেই সময়ে পুলিশের প্রতিক্রিয়া এইসবের প্রেক্ষাপটেই প্রীতিলতা ব্রিগেড বানিয়েছিল ওরা। আমার জানামতে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগেই হয়েছে। অন্য সংগঠনও থাকতে পারে, আমার জানা নাই। ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগও হতে পারে, ঐক্যের ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়নের ঐতিহ্য ও দক্ষতার কথা কে না জানে।
(২)
ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে আজকে থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে মেয়েরা ঢাকার রাস্তায় ড্যামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে মার্চ করেছিল। সাদা শাড়ী পড়ে কাঁধে রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাস্তায় মেয়েরা দুইটা সারি করে মার্চ করছে এই ছবি আপনিও দেখেছেন। সেই ছবি তো একরকম আইকন হয়ে গেছে আরকি। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস বিজয় দিবস এলেই এই ছবি কাগজে ছাপা হয়।
কাল রাতে যখন ফেসবুকে প্রীতিলতা ব্রিগেডের ইভেন্টের নোটিশ পেয়েছি, বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, আমার চোখে ভেসে উঠেছে একাত্তরের মার্চ মাসের সেই কুচকাওয়াজের ছবি। মেয়েরা কাঁধে রাইফেল নিয়ে কুচকাওয়াজ করছে সেই ছবি। আর সকাল বেলা ফেসবুক খুলে দেখি কেউ একজন আমাকে কতোগুলি ছবিওয়ালা একটা পোস্টে ট্যাগ করেছে- নিল সাদা স্কুল ইউনিফর্মে ছোট ছোট স্কুলের মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানার নিয়ে মিছিল করছে। ব্যানারে লেখা তনুসহ সকল ধর্ষণের বিচার চাই। কোথায় জানেন? কক্সবাজারে।
মার্চের শেষে এইরকম দুপুর বেলায় কক্সবাজারের বাতাস আগুণের মতো গরম হয়ে থাকে। আমি সেখানে বাস করেছি, আমি জানি। এই গরমের দুপুর বেলায় ছোট ছোট প্রীতিলতারা মিছিল করছে কক্সবাজারের রাস্তায় তনু সহ সকল নারীর উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে। এইরকম আশা আর সাহস জাগানিয়া ছবি দেখলে কার না ভাল লাগে বলেন!
কক্সবাজারের এই খুদে সাহসী মেয়েগুলি সহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে বাচ্চারা রাস্তায় নেমে এসেছে তাদেরকে সালাম জানাই। তোমাদের জন্যে আজকে আরেকবার আমি মেরুদণ্ড সোজা করে মাটিতে পা ঠুকে অহঙ্কারভরে মাথা ঝাঁকিয়ে সারা দুনিয়াকে বলতে পারি- আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম। এই যে এদের মতো।
(৩)
না, আমাদের মেয়েরা মাথা নত করবে না। এরা সরু গলায় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকারের করে মেল-শভিনিস্ট-শুকরগুলির বিকৃত পুলকও বাড়াবে না। আমাদের মেয়েরা লড়বে।
এই কথাটা কিন্তু সত্যি। পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষবাদী ধরনের লোকেরা চায়না মেয়েরা লড়াই করুক। হাজার বছরের পুরুষ আধিপত্বের ফলে নারীকে পুরুষ লড়তে দেখতে চায় না। পুরুষ সবসময়ই চায় বিপদে নারী অসহায়ভাবে চিৎকার করবে, কাঁদবে, প্রার্থনা করবে কিন্তু লড়বে না। ঐ বার্বি পুতুলের মত চিকনচাকন একটা মেয়ে লম্বা লম্বা কাঠির মত হাত পা ছুড়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে আর কুৎসিত এক পুরুষ তাঁর পিছনে ধাওয়া করছে এইরকম দৃশ্য পুরুষকে উদ্দীপ্ত করে।
কেননা এইরকম একটা দৃশ্যে পুরুষ কর্তৃত্ব বোজায় রাখার কয়েকটা জিনিস একসাথে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমত- এরকম একটা দৃশ্যে 'নারী হচ্ছে পুরুষের জন্যে সুস্বাদু ভোগের জিনিস' এই কথাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত পুরুষরা দেখাতে চায় যে নারী দুর্বল, অসহায় সে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনা, সুতরাং নারী ঠিক সম্পূর্ণ মানুষ না।
এইসব দৃশ্য আমাদের পুরুষ দৃষ্টি থেকেই তৈরি হয়- যে নারীর প্রতি অপরাধ মানে হচ্ছে ওর মালিকের প্রতি অপরাধ, অনেকটা গরু ছাগল চুরির মতো। আমি যদি আপনার ছাগল জবাই রকে খেয়ে ফেলি তাইলে আমার শাস্তি হবে আপনার মাল চুরির অপরাধে। নারীকেও এইভাবেই দেখা হয়। নায়ক আর ভিলেনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়, 'এই তুই আমার মালে হাত দিয়েছিস কেনে' ঢিসুম। ভিলেন বলে, 'আমি একবার যেই জিনিসে হাত রেখেছি সেটা আমার' ঢিসুম।
(৪)
সেই দিন শেষ প্রায়। আমাদের মেয়েরা এই শৃঙ্খল ভাঙবে। আমাদের মেয়েরা লড়বে।
মেয়েরা লড়ছে সেই কবে থেকেই, পুরুষের পাশে থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়ছে। পুরুষরা সেটা স্বীকার করতে চায়না। মানতে চায়না যে নারীও পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়তে পারে। পুরুষরা মানুক আর নাই মানুক নারীরা লড়েছে। সামনে থেকেই লড়েছে। পুরুষের পাশে থেকে একসাথে লড়েছে, আবার পুরুষের বিরুদ্ধেও লড়েছে। প্রীতিলতার নামে তো ব্রিগেডই বানিয়েছে ওরা- প্রীতিলতা এরকম একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু লড়াই করার উদাহরণ প্রীতিলতা একা নয়।
এই লাঠি মিছিল, এটা এইরকম দীর্ঘ লড়াইয়েরই একটা অংশ। আসেন, সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রার এই পর্বটিতে শরিক হই।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।