কৃষ্ণকলি করলেও অন্যায়, মিলিটারি করলেও অন্যায়
(১)
কৃষ্ণকলির গান শুনছি অনেক আগে থেকেই। অনেকদিন আগে বন্ধু ব্যারিস্টার তানজিবএর সুপারিশে তিনটা গানের সিডি কিনেছিলাম, দুইটার নাম ছিল ঝালমুড়ি ১ ও ২ আর আরেকটার নাম ভুলে গেছি, শিল্পী ছিলেন কৃষ্ণকলি (সূর্য নিয়ে কি যেন একটা সুন্দর নাম ছিল। এলবামের কভারে ওর মায়ের কথা লেখা ছিল)। তখনই ওর গান ভাল লেগেছিল। এর পরে অন্য গানও শুনেছি। কিন্তু এই পোস্টটি কৃষ্ণকলির গান নিয়ে নয়। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে।
ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণকলির সাথে আমার পরিচয় নাই। মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড আছে অনেক। সেই সূত্রে আমি জেনেছি যে তিনি মাওপন্থী বা প্রায় মাওপন্থী বা সেরকম যেসব বাম গ্রুপগুলি আছে সেগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ। দল করেন কিনা জানিনা, কিন্তু তিনি তার সঙ্গীত এবং শিল্পী পরিচয়ে নানাপ্রকার কর্মকাণ্ডে নানাভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এদের সাথে নানারকম মতপার্থক্য আছে, কিন্তু আবার নানারকম ইস্যুতে তো এদের সাথে ঐক্যমত্যও আছে। আর চূড়ান্ত লক্ষ্য তো ওদের ঠিকই আছে, পথ নিয়ে হয়তো আমাদের সাথে ভিন্নমত আছে। কৃষ্ণকলি তো তাইলে গণমানুষের পক্ষের লোকই। কৃষ্ণকলির স্বামীটিকে অবশ্য আমি চিনিনা, ওর সম্পর্কে কিছু জানিওনা। স্বামী স্ত্রীতে আদর্শিক মিল থাকারই কথা।
সম্প্রতি খবরে এসেছে যে কৃষ্ণকলির বাসায় কাজ করতো যে মেয়েটি সে সন্দেহজনক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। এই মেয়েটি নিতান্তই একটি শিশু। বলা হচ্ছে মেয়েটির বয়স ছিল সতের, কিন্তু আপনি তো জানেনই বাংলাদেশের দরিদ্র ঘরের মেয়েদের বয়সের কোন হিসাব থাকেনা। আর সতের হলেই বা কি? হয়তো দেখবেন অপুষ্টি অনাদরে লিকলিকে মেয়েটিকে দেখতে লাগে তেরো চৌদ্দের মতো। আর কাজের জন্যে এরা বয়স বাড়িয়ে বলে, বলতে বাধ্য হয়।
(২)
সন্দেহ করা হচ্ছে যে কৃষ্ণকলির স্বামীটি বা এরা দুইজনে হয়তো মেয়েটিকে মেরে ফেলেছে। এই সন্দেহ যদি সত্যি হয় তাইলে তো খুবই খারাপ ব্যাপার আরকি। বিশেষ করে কৃষ্ণকলির সংশ্লিষ্টতা যদি পাওয়া যায় তাইলে তো আমার খুবই খারাপ লাগবে। এমনিতে একজন মানুষ একটা অপরাধ করে, সেটার আপনি নিন্দা করবেন বিচার চাইবেন, বিচার হয়ে সাজা হয়ে গেলে শেষ।
কিন্তু একজন শিল্পী, যাকে আপনি গণমানুষের পাশের লোক বলে জানেন, মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের সহযোদ্ধা হিসাবে জানেন তিনি যদি এই রকম একটা অপরাধে জড়িত থাকেন সেটা তো একজন সাধারণ গৃহবধূর চেয়ে বেশী নিন্দার্হ। এমনিতে শিল্পী হলেই তো তার কাছে মানবিক প্রত্যাশা একটু বেশী থাকবে, তার উপর আবার সংগ্রামী রাজনীতিসচেতন শিল্পী। কৃষ্ণকলি যদি আসলেই সেই শিশুটিকে নির্যাতন আর হত্যার সাথে জড়িত থাকেন, আমি মন থেকে দাবী করবো ওর শাস্তি যেন সাধারণ অপরাধীর চেয়ে দ্বিগুণ হয়।
এখানে সুখের কথা হচ্ছে কৃষ্ণকলি বা ওর স্বামী কেউই পালিয়ে নেই বা লুকিয়ে নেই। কৃষ্ণকলির স্বামী ইতিমধ্যেই পুলিশের হেফাজতে আছে, ওকে নাকি রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো অনেক কথা বেরিয়ে আসতে পারে। যতটুকু জেনেছি, কৃষ্ণকলিও ঢাকায়ই আছেন, প্রকাশ্যেই আছেন, পালিয়ে যাননি। তদন্ত ইত্যাদির জন্যে ওদেরকে পাওয়া যাচ্ছে।
(৩)
আমার কাছে অস্বস্তি লাগছে দেখে যে অনেকে ফেসবুকে নিন্দা শুরু করেছেন কৃষ্ণকলিকে ও কৃষ্ণকলির স্বামীকে। যারা নিন্দা করেছেন ওরা বেশ ভাল মানুষ দায়িত্বশীল মানুষ। অনেকে আমার পছন্দের মানুষও। এরা নিন্দা করছেন, করবেনই তো, কেন করবেন না। আপনার নিন্দা করার ইচ্ছা হয়েছে, নিন্দা করেন।
আমি কৃষ্ণকলিকে এখনই নিন্দা করতে চাইনা। কেন? কৃষ্ণকলি একজন শিল্পী এবং রাজনিতিসচেতন শিল্পী। তিনি এরকম একটা ঘটনা ঘটাবেন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়না। আমি এখনো বিশ্বাস করতে চাই যে শিল্পী কখনো মন্দ কাজ করেন না, কৃষ্ণকলিও এরকম একটা মন্দ কাজের সাথে জড়িত না। উল্টাটা যদি প্রমাণিত হয়, অর্থাৎ যদি দেখা যায় যে কৃষ্ণকলি আসলেই জড়িত, তাইলে তার প্রতি আমার ক্রোধ ও ঘৃণা দ্বিগুণ হবে- অপরাধের জন্যে এবং সেইসাথে আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গের জন্যে।
আপনার যদি মনে হয় যে কৃষ্ণকলিকে তীব্র নিন্দ করা উচিৎ, করেন। আপনার ইচ্ছা। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে মেহেরবানী করে শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন বা জীবনযাত্রার স্টাইল ইত্যাদি নিয়ে স্ক্যান্ডাল ছড়াবেন না। এইগুলি স্ক্যান্ডাল এমনিতেই ছড়ানো উচিৎ না। তার উপর এখন এইসব কথাবার্তা মানুষের মনে (এমনকি তদন্তকারীদের মনেও) বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।
একজন মানুষের জীবনযাত্রা আপনার পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু তার মানে এই না যে সে অপরাধী। এই কথাটা আমাদের এখানে মানুষ রাগের মাথায় ভুলে যায়।
(৪)
আর যারা সোহাগী হত্যার বিচারের দাবীতে আন্দোলনের সাথে এই ঘটনাকে জুড়ে দিতে চাইছেন, বা বলছেন যে তনুর জন্যে আন্দোলন করলে এই মেয়েটির জন্য নয় কেন, আপনারা হয় ভুল করছেন অথবা আপনাদের উদ্দেশ্য অসৎ।
প্রথমত দুইটা ঘটনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। তনুর ক্ষেত্রে ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলেই বিচারের দাবী করাটা জরুরী ছিল। সেখানে বিচার যাতে না হয় সেই চেষ্টা চলছিল, এখনো সম্ভবত চলছে। এই কারণে তনুর বিচারের দাবীটা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটা স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে তনুর জন্যে বিচারের দাবী কেবল তনু জন্যেই নয়, সকল নির্যাতিতা নারীর বিচারের দাবীও সেখানে এমনিতেই সম্পৃক্ত।
আপনি হয়তো সৎভাবেই প্রশ্ন তুলছেন সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার চাইলে একই সাথে এই মেয়েটির হত্যার বিচারও কেন চাইবো না। চাইতে পারেন। কেন নয়? আমি আলাদা করে বলার দরকার দেখি না, কিন্তু অনেকে আলাদা করে বলছেন। আপনিও বলেন। আমরা যেদিন মানব বন্ধন করলাম তেইশ কি চব্বিশ তারিখে সেদিন সারা তন্নির মাও ছিলেন সেখানে। তিনি তাঁর মেয়ের কথা বলে বক্তৃতাও করেছেন, আমাদেরকে কাঁদিয়েছেন। তিনি কিন্তু স্পষ্ট করেই বলেছেন যে তনুর বিচার তাঁর মেয়ের জন্যে ন্যায় বিচার চাওয়ার সাথেই একই সূত্রে গাঁথা।
তাইলে উদ্দেশ্য অসৎ বলছি কেন? কেননা কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা তনু হত্যার ঘটনাটা নিয়ে খুবই বিব্রত এবং তারা চাচ্ছেন না যে এটা নিয়ে কথাবার্তা বাড়ুক বা আন্দোলন হোক বা মানুষ রাস্তায় নামুক। ওরা এইসব কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে- হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণের বিচার চাওনা কেন? পাহাড়ের মেয়েদের ক্ষেত্রে কথা বলনা কেন? ঐটা নিয়ে আন্দোলন করনাই কেন? তখন কোথায় ছিলে? ইত্যাদি। ভয় হয়, আপনি আবার ওদের দলের কিনা।
(৫)
দেখেন, অন্যায় অন্যায়ই। কৃষ্ণকলি করলেও অন্যায়, মিলিটারি করলেও অন্যায়, আমি আপনি করলেও অন্যায় অন্যায়ই। আইন সকলকে অর্থাৎ সকল অপরাধীকে সমান শাস্তি দিক এটাই আমরা চাই। কিন্তু বিচার যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। কৃষ্ণকলির বন্ধুরা বিশ্বাস করে কৃষ্ণকলি এই ঘটনার সাথে জড়িত না, ওরা কৃষ্ণকলির পাশে দাঁড়িয়েছে, ওকে ন্যায়সঙ্গত সহযোগিতা দিচ্ছে। ওরা তো আর বিচারে বা তদন্তে বাধা দিচ্ছে না। ওদেরকে আপনি নিন্দা করবেন কিভাবে?
নিন্দা করতে হয় তাদেরকে যারা তদন্ত হতে দিতে চায়না, বিচারে বাধা দেয়, ঘটনা ধামাচাপা দিতে চায়, প্রভাব ওর ক্ষমতা ব্যবহার করে টেলিভিশন খবরের কাগজের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায়। এদের সাথে কৃষ্ণকলিকে বা ওর বন্ধুদের এক কাতারে ফেললে হবে?
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।