নারীর জন্যে চাই স্বাধীনতা
(১)
আজকে ২৫শে মার্চ আর রাত পোহালেই কাল ২৬শে মার্চ, আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসাবে আজকে মধ্যরাতের পরই আমাদের স্বাধীনতা দিবস। পঁচিশে মার্চের রাত আমরা পালন করি কাল রাত হিসাবে। আর এই কাল রাতের পরই বাংলাদেশের জন্মদিন। আমাদের স্বাধীনতা দিবস।
আজকে পঁচিশে মার্চের বিকালে আমাদের অন্যরকম কর্মসূচি পালনের কথা। আজকে রাতে আলোর মিছিল হবে বিভিন্ন জায়গায়, তার প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত থাকার কথা সংগঠকদের। সেই সময়ে আজকে বিকালে শাহবাগে আমাদেরকে পালন করতে সোহাগী জাহান তনুর জন্য ন্যায় বিচারের দাবীতে ভিন্ন কর্মসূচি। আপনারাও আসুন, যোগ দিন এই কর্মসূচীতে। সোহাগীর বিচারের দাবীতে এই আন্দোলনটা জরুরী। জরুরী কেবল সোহাগীর জন্য নয়- এটা আপনার জন্যেই জরুরী আমার জন্যই জরুরী। আন্দোলনটাতে থাকুন।
দেখবেন এই আন্দোলনটা ইতিমধ্যে খানিকটা ফল দিয়েছে। সোহাগীর মৃত্যুর খবর প্রথম থেকেই কোন বড় খবরের কাগজে ছাপেনি, কোন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখায়নি। এমনকি বড় যেসব অনলাইন খবরের কাগজ আছে, ওরাও এই খবরটা প্রকাশ করেনি। আমরা যখন বুধবার দিন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচীতে গিয়েছি তখন সংবাদ মাধ্যমগুলি নড়েচড়ে বসেছে। কুমিল্লায় যখন ছেলেমেয়েরা কান্দিরপারে জড়ো হয়েছে তারপর থেকে টেলিভিশনে খবরটা ওরা দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। আজকের বড় খবরের কাগজগুলিতেও গুরুত্ব দিয়েই খবরটা ছেপেছে।
আপনি মিডিয়াগুলিকে গালাগালি করতে পারেন, নিন্দা করতে পারেন। নিন্দা করা জায়েজ আছে। কারণ বিশ তারিখ সকালেই এই বনৃশংস ঘটনার খবরটা কাগজে আসা উচিৎ ছিল। ওরা পারেনি। কেউ নিশ্চয়ই ওদেরকে ভয় দেখিয়েছে। খবরের কাগজ খবর প্রকাশ করতে চাইবে না এটা হতে পারে না। আর এরকম সেন্সেশনাল খবরের জন্য তো ওরা বসেই থাকে। ওরা ভয় পেয়েছে। আপনি আমি যদি রাস্তায় থাকি তাইলে ওদের সাহস হয়। ওরা বলতে পারে। ওরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারে।
(২)
বিচারের দাবীতে আমরা আন্দোলন তো করবোই। আমি আমার দাবীটা কেবল বিচারের দাবীর আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনা। আমি এই আন্দোলনের সাথে যোগ করে দিতে চাই স্বাধীনতার দাবী। স্বাধীনতার দাবী। জি। নারীর স্বাধীনতার দাবী।
চিন্তা করে দেখেন, সময় কিন্তু হয়ে গেছে এই নারীর জন্যে স্বাধীনতার দাবীটা নিয়ে রাস্তায় নামার। আগামী কাল আমাদের স্বাধীনতা দিবস, এই স্বাধীনতা দিবসে আসেন আমরা নারীর জন্যে স্বাধীনতার দাবী তুলি। স্বাধীনতা চাই, নারীর জন্যে স্বাধীনতা। বাংলাদেশ ১৯৭১এর ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীন দেশ। কিন্তু এই স্বাধীনতাটা আসলে কেবল মুসলমান পুরুষ বাঙালির স্বাধীনতার মধ্যেই আটকে আছে। আমাদের নারীরা এখনো তাঁর অংশের স্বাধীনতার ভাগ পায়নি।
কেন বলছি নারীর স্বাধীনতার কথা? কথাটার মানে কি? কথাটার মানে কি সেরকম জটিল কিছু? না। নারীর স্বাধীনতা মানে নারীর স্বাধীনতাই। আমি একজন পুরুষ যেরকম স্বাধীন একজন নারী কেন একইরকমভাবে স্বাধীন হবে না? উদাহরণ দিই?
আমাদের এই শহরে গলির মোড়ে চায়ের দোকানে একটা ছেলে সন্ধ্যার সময় বিড়ি টানবে আর হাসিনা খালেদা ওবামা পুতিনের গুষ্টি উদ্ধার করবে আপনি তাকে কিছু বলবেন না। কিন্তু আপনার পাশের বাড়ীর মেয়েটা কেন সেখানে একইভাবে আড্ডা মরতে পারবে না? রাত দশটার পর একটা ছেলে বা দুইটা ছেলে শুনশান সড়ক দিয়ে হাঁটবে আর রাতের ঢাকার রূপ দেখবে, আমার মেয়েটা কেন রাত দশটায় ঢাকার রাস্তায় একা একা কিংবা কোন বন্ধু বা বান্ধবীর হাত ধরে হাঁটতে পারবে না?
আরও আছে। পিতার সম্পত্তিতে কেন একটা মেয়ের উত্তরাধিকার একটা ছেলের চেয়ে কম হবে? পারিবারিক ক্ষেত্রে একজন নারীরই আইনগত অবস্থান কেন একটা ছেলের চেয়ে নিচে হবে?
দেখেন, এইগুলি নেহায়েত কথা কথা না। একটা দেশ স্বাধীন করার জন্যে ত্যাগের ব্যাপারে নারী আপনার আমার চেয়ে কম করে না। কিন্তু রোজকার জীবনে এসে কেন একটা মেয়ে একটা ছেলের সমান স্বাধীনতা ভোগ করবে না।
(৩)
অনেকে বলছেন নারীর জন্যে নিরাপদ নগর চাই। কেউ কেউ বলেছেন নারীবান্ধব নগর চাই। এরকম যারা বলেন পুরুষ হলেও ওরাও ভাল মানুষ। নারীর প্রতি সহানুভূতি থেকেই ওরা নারীর জন্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান, নারী বান্ধব নগর করতে চান। উনাদের উদ্দেশ্য সৎ। কিন্তু, কিছু মনে করবেন না, উনাদের উদ্দেশ্য সৎ হলেও সঠিক না। নারীর জন্যে নিরাপদ নগর বা নারীবান্ধব নগর এইসব আবার কি?
নিরাপদ নগর করতে চান সকলের জন্য নিরাপদ নগর করেন। নারীর জন্য বিশেষভাবে নিরাপদ নগরের দরকার নাই। শুধু এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করেন যে নারীও আমার মতো আপনার মতো এই নগরেরই একজন নাগরিক। তাইলেই হবে। আর এই যে বলেন নারীবান্ধব নগর, এই কথাটার মধ্যে কেমন যেন একটু 'প্রতিবন্ধী বান্ধব' ধরনের গন্ধ আসে। নারী কি আপনার আমার চেয়ে নিচু স্তরের কোন প্রাণী? নাগরিকবান্ধব নগর করেন আর স্বীকার করেন যে নারীও একজন পুরুষের সমানই নাগরিক।
না, এই নারীর জন্যে নিরাপদ বা নারিবান্ধব এই কথাগুলি বাস্তব কারণেই এসেছে। নারীদের উপর অত্যাচার হয় বলেই এই কথাগুলি বলা হয়। কিন্তু ভাই, অত্যাচার তো আপনি পাহারা দিয়ে নিবারণ করতে পারবেন না। পুলিশের হাতে আর মিলিটারির হাতেই তো নারীদের হেনস্থা হতে হচ্ছে। তাইলে কাকে দিয়ে কিভাবে আপনি পাহারা দিবেন? সেজন্যে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে নারীকে মানুষ হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া। নারী যে পুরুষের অধীন নয়, নারীও যে স্বাহদিন নাগরিক এই ব্যাপারটা রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন, তাইলে সমস্যার অনেকাংশে মিটে যাবে।
কিভাবে করবেন? দেশের আইনে যেখানে যেখানে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার থেক বঞ্চিত করা হয় সেখানে হাত দেন। নারীর প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ সম্মানজনক করুন। রাষ্ট্র যদি নারী আর পুরুষকে সমানভাবে দেখে সেটাই শিক্ষা ব্যাবস্থা সহ নানানভাবে নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। যেটা দরকার সেটা হচ্ছে সবার আগে স্বীকার করা যে নারী আর পুরুষ উভয়েই স্বাধীন উভয়েই সমান।
এরপর কি অপরাধ হবে না? হবে। অপরাধ পুরোপুরি বন্ধ হওয়া কঠিন। কিন্তু সকল পর্যায়ে বৈষম্য যদি দুর করতে পারি তাইলে অপরাধের ক্ষেত্রেও অবস্থার উন্নতি হবে।
(৪)
দেখেন, এই যে নারীর স্বধিনতার কথা বলছি এটা কেবল মাত্র মহান কোন আদর্শের কারণে বলছি না। বাস্তব প্রয়োজনে নিজেদের স্বার্থেই বলছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজের জীবনের প্রয়োজন থেকেই বলছি।
আমি মফস্বলে নিতান্ত প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলে পড়েছি। সেই প্রাইমারী স্কুল থেকেই আমি দেখে এসেছি আমাদের ক্লাসের মেয়েদেরকে কখনোই আমাদের সমান ভাবা হয়নাই। বুদ্ধি হবার পড় থেকেই আমাদেরকে শেখানো হয়েছে নারীর চেয়ে পুরুষ উত্তম। নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা, পুরুষের অধীনে থাকা। নারী যে পুরুষের ভোগের বস্তু সেটা তো আমাদেরকে এই সমাজেই শিখানো হয়। মেয়ে শিশুকেও তো শিখানো হয়, 'তুমি পুরুষের জন্য, তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে পুরুষের জন্য।'
আমাদের আইন কানুনও তো সেরকমই। পারিবারিক আইনের কথা তো আপনারা সবাই জানেন। দণ্ডবিধির একটা ধারার কথা আপনাদেরকে বলি। দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় একটা অপরাধ আছে- এডাল্টারি। কেউ যদি বিবাহিতা জেনেও কোন নারীর সাথে 'নারীটির স্বামীর সম্মতি বা যোগসাজশ ছাড়া' সঙ্গম করে তাইলে তার শাস্তি জরিমানা বা সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল অথবা দুইই। লক্ষ্য করবেন যে নারীটির যদি সম্মতি থাকে তাইলেও এটা অপরাধ কিন্তু নারীটির স্বামী যদি সম্মতি দেয় তাইলে আর এটা অপরাধ হবে না।
মানেটা কি দাঁড়ায়? মানেটা হচ্ছে এই যে বিবাহিতা নারী হচ্ছে তার স্বামীর সম্পত্তি। স্বামীটির ইচ্ছায় যদি আপনি ওর স্ত্রীর সাথে করেন তাইলে কিছু না। আর স্ত্রী যদি তার ইচ্ছায়ও মিলিত হয় সেটাও অপরাধ। নারীকে তাইলে আপনি কথায় রাখলেন?
স্বাধীনতাটা এজন্যেই দরকার। আমি আমার জীবন তো প্রায় পার করে দিলাম। আমার আমার দুইটা কিশোরী মেয়ে আছে। আমার মেয়েরা কি এই দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে জীবন যাপন করতে পারবে না? ওরা কি তবে পুরুষদের তুলনায় একটু কম-স্বাধিন হয়েই এই দেশে বাস করবে?
(৫)
না, নারী কেন আমার চেয়ে কম-স্বাধীন নাগরিক হিসাবে এই দেশে বাস করবে? নাইর কি আমার চেয়ে কম-নাগরিক? এই দেশের স্বাধীনতা কি আমরা কেবল পুরুষরা পুরুষের জন্যে এনেছি? আর কত দিন?
সোহাগীর মৃত্যুটা যদি আপনার চোখ খুলে থাকে, আপনি যদি বুঝে থাকনে যে নারীর জন্যে স্বাধীনতা এখনো আসেনি, আপনি যদি নারীরই জন্যে স্বাধীনতার আওয়াজ তোলেন তাইলেই অনেক সোহাগী এরকম অত্যাচার থেকে বাঁচবে।
এইবার এই দাবীটা তুলি চলেন। স্বাধীনতা চাই। নারীর জন্যে স্বাধীনতা। বিশেষ সুযোগ নয়, বিশেষ সুরক্ষাই কেবল নয়, বিশেষ কোটা ইত্যাদিই না। স্বাধীনতা চাই। নারীর পুর্নাঙ্গ স্বাধীনতা।
সোহাগীর জন্যে ন্যায়বিচার চাই আর নারীর জন্যে চাই স্বাধীনতা।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।