কয়টা ইভেন্ট হয়েছে শাহবাগে?
(১)
ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে না এখানে সেখানে? দেখেছেন? এরকম ভ্যানে করে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সবজি আর ফল বিক্রি করতো মুহম্মদ বুয়াজিজি তিউনিসিয়ার ছোট্ট একটা মফস্বল শহরে। মুহম্মদের বয়স ছিল পঁচিশ ছাব্বিশএর মতো। ওর এই সবজি বেচা আয়ে ওর ছয় সাতজন মানুষের সংসার চলে। বিধবা মা, ভাই বোন এক গাদা মানুষ, কামানেওয়ালা একজন- মুহম্মদ।
সেদিন মুহম্মদ ওর ভ্যান গুছিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই সে তাই করে। এক পুলিশ এসে বলে কিনা, 'এই ব্যাটা, ভ্যান লাগানোর পারমিট ট্রেড লাইসেন্স কি আছে বাইর কর'। মুহম্মদের কাছে তো পারমিট নাই। 'পারমিট ছাড়া ব্যাবসা করা নিষেধ, ভ্যান দে, ভ্যান বাজেয়াপ্ত করা হলো'। ভ্যান নিয়ে গেলে মুহম্মদ খাবে কি, বিধবা মা আর ছয় ভাইবোনরে কি খাওয়াবে। সে ভ্যান দিবে না।
পুলিশের কথা শুনবি না হারামজাদা? ভ্যান দিতে বলছি ভ্যান দিবি না? ঐ মহিলা পুলিশ কনস্টেবল মেরেছে এক থাবা মুহম্মদের কান বরাবর। মুহম্মদের সহ্য হয়নাই এই অত্যাচার, সে একটা সরকারী অফিসের সামনে গিয়ে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
সেদিন বিকালেই শহরে বিক্ষোভ হলো। অল্প কিছু লোক। মুহম্মদের আত্মাহুতি, পরের বিক্ষোভ এইসব ঘটনা উপস্থিত লোকজন মোবাইল ফোনে ভিডিও করে, ছবি তোলে আর ফেসবুকে আর টুইটারে পোস্ট করে। তারপর খবর আসে যে আরেক শহরে বিক্ষোভ, আরেক শহরে আরেক শহরে এভাবে দেশের সর্বত্র তারপর দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরে।
(২)
এটাই হচ্ছে ২০১০ সনের আরব বসন্তের সূচনা। একজন মুহম্মদ বুয়াজিজি সব্জিওয়ালার ঘটনা থেকে তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বেন আলীর ভিত্তি নড়ে যায়। মাস খানেকের মধ্যেই জয়নাল আবেদিন ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর আরব বসন্ত ছড়িয়ে পরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
এই কাহিনী আর এর পরের ঘটনা আপনারা সবাই কম বেশী জানেন।
(৩)
খড়ের যে শেষ ডাঁটিটা উটের পিঠ ভেঙে দেয় সেটার ওজন খুব বেশী থাকে না। 'বোঝার উপর শাকের আঁটি' বলে একটা কথা আছে না বাংলায়? সেই কথা আরকি।
আপনি একটা গাধার উপর ধরেন একটার পর একটা বস্তা রাখতে লাগলেন। এইরকম পাঁচটা দুইমনি বস্তা রাখলেন। গাধা রওনা দিবে। এমন সময় খালা শাশুড়ি বললো, 'গাধা তো ঐদিকেই যাচ্ছে, এই কলমি শাকের আঁটি কয়টা নিয়ে যা।' আপনি তিন আঁটি কলমি শাক আগের পাঁচটা বস্তার উপর রাখার সাথে সাথেই দেখলেন গাধা মাটিতে বসে পরেছে।
ঐ তিনটা কলমি শাকের জন্যে কি গাধার পিঠ ভেঙ্গেছে? দশ মন ভুসি বইতে পারে আর তিন আঁটি কলমি শাক নিতে পারবে না? এইটাই হচ্ছে ঘটনা। সুশৃঙ্খল দশ মন ভুষির বস্তাতে স্বৈরাচারের হয়তো কিছুই হয়না। বিশাল উটের পিঠ ভাঙ্গার জন্যে তখন দরকার হয় একটা খড়ের ডাঁটির।
(৪)
আপনারা যারা সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদের জোয়ার দেখে নানারকম প্রশ্ন করছেন তাঁদের জন্যে এই কথাটা বলছি। দিনের পর দিন হিন্দু মেয়েদের উপর অত্যাচার হয়- কয়টা ইভেন্ট হয়েছে শাহবাগে? পাহাড়ে আমাদের মেয়েদের উপর প্রতিদিন অত্যাচার হয়, মিলিটারিদের উপস্থিতিতে এবং, অভিযোগ আছে, ওদের প্রশ্রয়ে ওর অংশগ্রহণে- তখন কেন ঢাকা চট্টগ্রাম সড়ক অবরোধ হয়না?
এইসব কথাই সত্যি। সব প্রশ্নই জায়েজ। এটাও সত্যি যে পাহাড়ে আমার মেয়েদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরালো হলে সোহাগীর মতো ঘটনা হয়তো ঘটতোই না। কিন্তু তবুও সোহাগীর ঘটনায় প্রতিবাদের তীব্রতাকে আরও তীব্র করাই কি সঙ্গত না? সোহাগীর প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিবাদের সাথে এর আগের যেসব অত্যাচার হয়েছে সেগুলিকে যুক্ত করে দেওয়াটাই সঙ্গত না?
ঐ উদাহরণে যে বলেছি- দশ মন ওজনে হয়তো উটের পিঠ ভাঙবে না, শেষ খড়ের ডাঁটিটা দরকার। কিন্তু শুধু খড়ের ডাঁটি দিয়ে তো আর উটের পিঠ ভাঙ্গার প্রশ্নই আসে না যদি না আপনি আগের দশ মন ওজন এর সাথে যুক্ত করেন। খড়ের ডাঁটিটা হয়তো বারুদে স্ফুলিঙ্গের কাজ করবে, কিন্তু জমানো বারুদ তো থাকতে হবে।
(৫)
কি করবেন? বাস্তবতা হচ্ছে সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলি আপনার আমার অধিকারের পক্ষে সেইভাবে দাঁড়াতে পারছে না। যাদের শক্তি আছে ওরা দাঁড়ায় না, আর যারা বলে যে দাঁড়াতে চায় ওদের শক্তি দৃশ্যতই সীমিত। আমরা সাধারণ মানুষ আমাদের নিজদের শক্তি ছাড়া আর কার শক্তির উপর ভরসা করবো?
আগে প্রতিবাদ হয়নি বা কম হয়েছে বলে এই ঘটনার প্রতিবাদ করবো না তা তো হতে পারে না। আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে প্রতিটা অন্যায়ের প্রতিটা অত্যাচারে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদকেই তার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ তীব্রতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। এগুলিরই কোন একটা দেখবেন সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।