সোহাগী তোমার শরীর তোমার পাপ
(১)
ছোটখাটো আকৃতির মেয়েটা। সবুজ রঙের ফুলস্লিভ জামা পরেছে, সাথে ম্যাচিং সবুজ আর কমলা রঙের মিশেল দেওয়া ওড়না। ওড়নাটা মাথা কান গলা মিলিয়ে এমনভাবে প্যাঁচানো যে ওর কান চুল গলা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওড়নার কমলা রঙ অংশটা মাথায় ঘোমটা হয়ে প্রায় ভুরু পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে সেই সাথে ফোলা ফোলা দুই গালের অর্ধেকটা হয়ে থুতনির মাঝখান থেকে নীচের দিকের গলা বুক সব ঢেকে রেখেছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখেন, প্রায় পুরো শরীর আর পুরো মুখ ঢেকে রাখলেও মেয়েটার চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ ঢেকে রাখতে পারেনি।
এই পোশাকেই মেয়েটা অনেকগুলি ছবি তুলেছে। ছবিগুলি তুলেছে শ্রীমঙ্গলে। চা বাগানে, চা গবেষণা কেন্দ্রের বাগানে, বারান্দায়, পথে সবখানে। কখনো একা কখনো গ্রুপের সাথে কখনো একজন বা দুইজন বন্ধুর সাথে। সেরকম ভাল কোন ছবিনা, মোবাইল ফোনে তোলা ছবি। যেসব জায়গায় মেয়েটা এইসব ছবি তুলেছে জায়গাগুলি আমার পরিচিত।
আজ থেকে ২৩ বছর আগে আমিও একদল ছেলেমেয়ের সাথে এইসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফটো তুলেছি। সেই দলের মধ্যে একটি মেয়ের সাথে সেই সফরে আমার একটু বেশীই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেম, প্রেম থেকে বিবাহ। বন্ধুদের সাথে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে এই মেয়েটিও কি প্রেমে পরেছিল সাথে বেড়াতে যাওয়া কোন বন্ধুর সাথে? সেই কথা আমরা আর কোনদিন জানতে পারবো না।
মেয়েটার বড় বড় দুই চোখে মোটা করে কাজল দেওয়া। ঠোঁটে আনাড়ি হাতে দেওয়া হালকা লাল লিপস্টিক। চোখে আর ঠোটে ঝলমল করতে থাকা আনন্দ ছাড়া মেয়েটার চেহারার কোন বৈশিষ্ট্য নাই। খর্বাকৃতি একটু মিষ্টি চেহারার অতি সাধারণ একটা মেয়ে। ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে এখন মেয়েটার সেইসব ছবি। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছি শ্রীমঙ্গলে তোলা ওর সেইসব ছবি। প্রতিটা ছবিতেই হাসিমুখে মেয়েটা, কিন্তু কোন ছবিতেই ওর দাঁত দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটির দাঁত কি আঁকাবাঁকা ছিল? সেজন্যেই কি মেয়েটি সবসময় ঠোঁট চেপে হাসতো?
(২)
মেয়েটির নাম সোহাগী জাহান তনু। মিষ্টি নাম। নাম যতো সুন্দরই হোক, যত প্রতিভাবান বা শিল্প সচেতনই হোক না মেয়েটা, শেষ বিচারে সে তো ছিল কেবলই একজন নারী, কেবলই পুরুষের ভোগের বস্তু।
আমার মতই একজন বা একাধিক পুরুষ তাদের পৌরুষ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই খর্বাকৃতির মিষ্টি ধরনের মোটা করে কাজল পরা সোহাগী নামের বড় বড় চোখের মেয়েটাকে ওরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সুবিধাজনক একটা জায়গায় নিয়ে ভোগ করেছে। মেয়েটি হয়তো বাধা দিয়েছিল বা এমন একটা কিছু করেছিল যাতে আমার পুরুষ ভাইদের পৌরুষে আঘাত লেগেছিল, কাজ শেষ করে ওরা মেয়েটাকে জানেই মেরে ফেলেছে।
আপনারা এটা নিয়ে এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছেন কেন বুঝতে পারছি না। পুরুষ মানুষ মওকা মত পেয়ে একটা মেয়েকে খেয়ে দিয়েছে এতে এমন কি অপরাধ হয়েছে? নারী কি পুরুষের ভোগের জন্যে নয়? নারীর শরীর কি কেবলই একটি সুস্বাদু মাংসপিণ্ড নয়? আপনারা কি প্রতিদিন নারীকে সেই শিক্ষা দিচ্ছেন না? আপনারা কি কোনদিন বলেননি যে নারী হচ্ছে তেঁতুলের মত তেঁতুলের মত তেঁতুলের মত? তো তেঁতুল দেখে আমার পুরুষ ভাইদের জিভে পানি এসেছিল, মওকাও ছিল, করে দিয়েছে দোষের কি আছে?
আপনারা কেন বিচার চাই বিচার চাই বলে চেঁচাচ্ছেন? কিসের বিচার? ধর্ষণের বিচার? আপনি বলেন তো আপনার ধর্মে ধর্ষণের শাস্তি কি? চুরি করলে হাত কাতা হবে, পরকীয়া করলে পাথর ছুড়ে মারা হবে এইসব বিধান আছে। ধর্ষণের শাস্তির কি বিধান আছে বলেন তো? জানা না থাকলে গ্রন্থ খুঁজে দেখেন। তারপর বিচার চাইতে আসেন।
(৩)
শোনেন, আপনারা তো মেয়েদেরকে ছোটকাল থেকেই শিক্ষা দিচ্ছেন 'মেয়ে তুমি পুরুষের ভোগের বস্তু।' 'মেয়ে তোমার অঙ্গ ঢেকে রাখো, তোমার শরীর তোমার না, এটা পুরুষের ভোগের জিনিস'। 'মেয়ে তোমার শরীর তোমার না, একে রক্ষা করো তোমার স্বামীর জন্যে, যেন সে একটা ফ্রেশ মাল পায়'। আপনি কি নারীকে বলেননি, 'নারী তুমি তোমাকে ঢেকে রাখো, নাইলে পুরুষের জিভে পানি চলে আসবে, আর সে হবে তোমারই দোষ'?
কন্যাকে তো আপনি সবসময়ই বলেছেন, 'মেয়ে তুমি ভালো হয়ে চলো, পরপুরুষ তোমাকে ছুঁয়ে দিলে তোমার শরীর নষ্ট হয়েয় যাবে, তুমি হয়ে যাবে নষ্টা'। আপনি কি কখনো আপনার পুত্রকে বলেছেন যে 'শোন ছেলে, তুমি ভাল হয়ে চল', আপনি কি কখনো কোন আপনার পুত্রকে বলেছেন কোন মেয়ের গায়ে বিনা অনুমতিতে হাত দিলে তুমি নষ্ট হয়ে যাবে?
বলেননি। আপনি নারীকে তৈরি করেছেন ভিক্টিম হিসেবে। আপনি নারীকে শিখিয়েছেন নারী তুমি ধর্ষণের জন্যেই জন্ম নিয়েছ। জি। নানারকমভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে ইতং বিতং করে সাজিয়ে গুছিয়ে বলেছেন বটে- কিন্তু মুল কথা ঐটাই বলেছেন, নারীর জন্মই হয়েছে ধর্ষণের জন্যে। ভেঙে বলি। নারীর সম্মতি ছাড়া সঙ্গম করলে সেটাই হয় ধর্ষণ। আপনি কি আপনার নিজের জীবনে নারীর সম্মতিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভেবেছেন? ভাবেননি।
উল্টাটা করেছেন। পুত্রের জন্যে বা ভাইয়ের জন্যে বা নিজের জন্যে সেজেগুজে পাত্রী দেখতে যাননাই? গরু কেনার মত করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নারীর শরীর দেখেননি? কেমন পাত্রী চাই সেই আলোচনা করেননি? গাইয়ের আবার সম্মতি কি?
ফ্রেশ ভার্জিন পাত্রী খোঁজেন, কখনো কি ফ্রেশ ভার্জিন পাত্র খুঁজেছেন?
(৪)
এই মেয়েটাকে যারা ধর্ষণ করেছে ওরা আপনার মতই পুরুষ। ওরা ধর্ষণ করার আগেই আপনারা সোহাগী মেয়েটাকে জানিয়েছেন 'সোহাগী তোমার শরীর তোমার পাপ, একে ঢেকে রাখ। সোহাগী তোমার অঙ্গ তোমার দায়, এটাকে রক্ষা কর। সোহাগী তোমার রূপ তোমার বোঝা, এই বোঝা তুমি বইছ আরেকজনের জন্য।'
আপনারা নারীত্বের নামে মেয়েটাকে শিখিয়েছেন ভয়। মেয়ে তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াবে না। চিখ নিচু করে চলবে। গলা নিচু করে কথা বলবে। নাইলে একটা কিছু হলে সেই পাপ তোমারই। নষ্ট হবে তুমিই- যে তোমাকে ধর্ষণ করবে সে নষ্ট হবে না। নারীত্বের নামে নারীকে তার নারী পরিচয়ে ভীত করে রেখেছেন। ধর্ষণের আগেই মেয়েটাকে আপনারা প্রি-ভিক্টিম বানিয়ে রেখেছেন। এখন আবার কিসের বিচার চান?
শোনেন, আপনার কন্যাকে শেখান যে সে নিজেই নিজের দেহের মালিক, অন্য কেউ নয়। পুত্রকে শেখান যে নারীর শরীরের মালিক নারীই, ওর সম্মতি ছাড়া নারীর শরীরে হাত দিলে সে নষ্ট ছেলে হয়ে যাবে। শারীরিক ধর্ষণ তো ধর্ষণই, শারীরিকভাবে ধর্ষণের শিকার না হয়েও আপানর আশেপাশে প্রায় সকল মেয়েই ভিক্টিমের জীবন যাপন করে। সেটা আগে রেকগনাইজ করেন।
ধর্ষণ অর্থ হচ্ছে নারীর সম্মতি ছাড়া ওর দেহ ভোগ করা। নারীর সম্মতিকে আগে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেন। আগে স্বীকার করেন যে নারীর অধিকার আছে 'না' বলার এবং না মানে হচ্ছে 'না'। আর এই সম্মতি না নেওয়াটাই অপরাধ। সম্মতির গুরুত্ব বুঝেন। নারী পুরুষ পরস্পরের সম্মতিতে মিলিত হলে সেটা অপরাধ না, এই বিষয়টা বুঝতে শিখেন। বুঝেন- শব্দটা হচ্ছে 'সম্মতি', ইংরেজিতে বলে 'কনসেন্ট'। এই জিনিসটা বুঝেন। আপনার পুত্রকে ভাইকে বন্ধুকে শেখান, নারীর দেহের মালিক নারী, নারীর সম্মতি ছাড়া নারীর শরীরে হাত দেওয়া অন্যায়।
(৫)
এই মেয়েটার হিজাব দেখে আতঙ্কে আমার শরীর হিম হয়ে গেছে। এই মেয়েটি জীবনের প্রতিটা দিন কাটিয়েছে নিজের দেহের বোঝা নিয়ে লজ্জা নিয়ে নিজেকে একজন প্রি-ভিক্টিম ভেবে ভেবে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা ভিক্টিমই হলো।
উনিশ বিশ বছরে ছোট্ট জীবনটা সে মানুষ হিসাবে কাটাতে পারলো না। একজন নারী, একটা দেহ একজন ঊন-মানুষ হিসেবেই ছোট্ট জীবনটা তার শেষ হলো। আপনি আমি আমরা ওকে হত্যা করেছি প্রতিদিন। আমার তো নিজেকে অপরাধী মনে হয়, আপনার হয় না?
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।