- হোম
- >
- ইতিহাস-ঐতিহ্য
- >
- বিলুপ্তির পথে নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
বিলুপ্তির পথে নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
আধুনিকায়নের ভিড়ে আর প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারের মাঝে নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনীয় পূঁজি, উপকরণ আর বাজারের অভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই জীবিকার তাগিদে এখন ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন। ফলে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। এরপরে পৈত্রিকভাবে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প ও ব্যবসা-বানিজ্য আকড়ে ধরে এই এলাকার প্রায় শতাধিক পরিবার জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ক্রেতার অভাবে বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প, কারিগররা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, অনেকেই আবার এই পেশা ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে নড়াইলের কুন্দশী, চোরখালি, জয়পুর, দিঘলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ৪ শতাধিক পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এসব পরিবারের লোকসংখ্যা যে হারে বেড়েছে সে হারে মৃৎশিল্পের চাহিদা বাড়েনি বরং দিনদিনের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিযেছে আর্থিক সংকট, বেড়েছে দারিদ্র্যতা। বাজারে অ্যালমুনিয়াম, প্লাষ্টিক ও স্টিলের তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। চাহিদা কম থাকায় মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল এখন আর কেউ কিনছে না। ফলে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা জীবিকা নির্বাহে নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
মূলত, হিন্দু পরিবাব এই শিল্পের সঙ্গেই বেশি যুক্ত। তারা রুদ্রপাল বা কুমার নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের লোকরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর হওয়ায় বেশির ভাগই চাকরি করার যোগ্যতা রাখে না। পূর্বপুরুষের পেশাকে ছেড়ে পাল সম্প্রাদায়ের লোকরা এতকাল নিজেদের অন্য কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত করেনি। শত অভাবের মধ্যেও আকড়ে ছিলেন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে। জীবিকার তাগিদে অনেক পরিবারই ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। শত অভাবের মাঝেও বেশ কিছু কুমার পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
কুমারপাড়ায় ঢুকলেই চোখে পড়ে তাদের জীবনযাত্রা। এই পাড়াতে কোন আধুনিকতা ছোঁয়া নেই, আছে শুধু বিষাদের ছোঁয়া। ময়লা ও ছেড়া কাপড়ে পরে তাদের দিন চলে। পুষ্টিহীনতার শিকার জীর্ণ শরীরের শিশুদের দীপ্তি নেই চোখে মুখে। কুন্দশী এলাকার কুমারপাড়ায় গেলে তারা তাদের ক্ষোভের এবং হতাশার কথা বলেন। তারা বলেন, কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। জানতেও চায় না তাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার কথা।
কুমুরপাড়ার তপন কুমার পাল জানান, সারা মাস হাঁড়ি-পাতিল, সরা-কলস, খোড়া, দোনাসহ বিভিন্ন ধরনের মাটির সামগ্রী তৈরি করে শুকানোর পর ভাটায় পুড়িয়ে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় হাট-বাজারে। জ্বালানির খড়ি বা লাকড়ির দাম বৃদ্ধির জন্য এক খোলা মাল তৈরি করতে প্রায় থেকে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ এক খোলা মাল বিক্রি করে চার থেকে পাঁচ শত টাকাও লাভ হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ পাল পরিবারই ভূমিহীন। নিজেদের বসবাসের জন্য সামান্য ভিটেটুকু ছাড়া তাদের অন্য কোন জমি নেই। তারপরও তারা তাদের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আঁকড়ে ধরে আছে এই শিল্পকে। চোরখালী এলাকার কুমারশিল্পীরা জানিয়েছেন, মাটির জিনিস বানাই বিক্রি করি, আর তা দিয়ে কোন রকমে খাওয়া-দাওয়া চলে। এই কাজে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, অথচ আয় নেই। এরপরেও পূর্ব পুরুষের এই ঐতিহ্য পেশাকে ধরে আছেন বলে জানান তারা।
মৃৎশিল্পীরা জানান, এক সময় আমাদের কিনে খেতে হয়নি। গ্রামে গ্রামে চিটা ধানের বিনিময় হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে যে ধান পাওয়া যেত তা দিয়েই চলে যেত প্রায় সারা বছর। কিন্তু এখন তা আর পাওয়া যায় না। লোহাগড়ার পাল সম্প্রদায়ের লোকরা এত অভাবের পরও পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চান। তারা জানান, পরিবারভিত্তিক ব্যাংক ঋণ ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করলে এখনও তারা মৃৎশিল্পকে অবলম্বন করে টিকে থাকতে পারেন। তাই এ অবস্থায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্রের মান উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণ করতে না পারলে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে না।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।