পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতীয় সঙ্গীত
(১)
আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটা (সম্ভবত) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতীয় সঙ্গীত। সম্ভবত বলছি কারণ পৃথিবীর সকল জাতীয় সঙ্গীত আমি শুনিনাই। যেগুলি সঙ্গীত শুনিনাই সেগুলির সাথে তুলনা করা বা সেগুলিকে নিয়ে কিছু বলা তো ভ্যালিড হবে না। কিন্তু সাধারণভাবে দুনিয়াব্যাপি জাতীয় সঙ্গীতের যে প্যাটার্ন আছে, তাতে মনে হয়না আমাদেরটার মত আর কোনটা আছে। যত জাতীয় সঙ্গীত শুনেছি, সেগুলির মধ্যে আমাদেরটাই সেরা। এটা আবেগ থেকে বলছি না। আবেগ তো আছেই। আমার জাতীয় সঙ্গীত আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লাগবে না তো কি নাইজেরিয়ারটা লাগবে? সেটা তো আছেই। কিন্তু আবেগ ছাড়াও আপনি যদি দেখেন, 'আমার সোনার বাংলা'র মত আর কোন জাতীয় সঙ্গীত নাই।
কেন একথা বলছি? আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মোট আট লাইনে যে কথা বলা আছে সেটা দেখেন। সুরটা একবার গুনগুন করেন, আপনি নিজেই টের পাবেন কেন এটা শ্রেষ্ঠ। আমি কারনগুলির মধ্যে কয়েকটা দিয়ে দিচ্ছি।
(২)
প্রথমেই দেখেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে কোন বাগাড়ম্বর নাই। খুব সরল ভাবে আমরা বলছি, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'। এইরকম সরল 'আমি তোমায় ভালোবাসি' বলার চেয়ে আর কি প্রেমময় কথা হতে পারেন বলেন। কোন বাকচাতুর্য নাই, অন্যের সাথে তুলনা নাই, সহজ এবং সরলভাবে বলে দিলাম 'আমি তোমায় ভালোবাসি'। এর চেয়ে মধুর কথা আর কি হতে পারে!
এর পরে কি বলছি? আমি তোমায় ভালোবাসি এই কথাটিরই একটি অনুষঙ্গ, 'চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি'। এখানেও দেখেন, আমি তোমায় কেন ভালোবাসি, সেই নিয়ে কোন তর্কাতর্কি বা যুক্তি উপমা কিচ্ছু না। স্রেফ ভালবাসারই একটি প্রতিক্রিয়া 'চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি'
এর পরের লাইন উচ্চারণ করেন। একটি অতি সরল রূপ বর্ণনা- মাতৃরূপ বর্ণনা। মায়ের ঘ্রাণ, মায়ের হাসি, মায়ের আচল আর সুশীতল ছায়া। এখানেও দেখবেন, অন্যের সাথে কোন তুলনা নাই। আমার মাকে আমি ভালবাসবো তার জন্যে কারণ দেখাতে হবে? আমার মায়ের আচল আমার মায়ের হাসি আমার মায়ের ঘ্রাণ এর সাথে আমি কিসের তুলনা করবো?
তারপর এসেছে মায়ের মুখের বানী। 'মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো'। নিরেট খাঁটি অনুভূতির বর্ণনা, ভালোবাসার বর্ণনা।
আর সবশেষে কি বলেছি? এইটা দেখেন। এইটা চূড়ান্ত। 'মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি'। এইটাই তো আমাদের প্রকাশ। বাঙালি দেশের জন্য কাঁদে। বাঙালির ভালোবাসাও প্রকাশিত হয় কান্নায়, বাঙালির ক্রোধও প্রকাশিত হয় কান্নায়। আমরা লড়াইও করি কান্নায়। এইখানে আমরা বলছি মায়ের বদন মলিন হতে দিব না।
(২)
এই তো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। প্রথমে ভালোবাসার ঘোষণা। এরপর নিতান্ত সরলভাবে মাতৃরূপ বর্ণনা- মায়ের ঘ্রাণ, মায়ের হাসি মায়ের আচল, মায়ের বানী। এরপর আমাদের প্রত্যয় যে মায়ের হাসি অম্লান রাখতে হবে।
এটাকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জাতীয় সঙ্গীতের চেয়ে উত্তম বলছি কেন?
যত জাতীয় সঙ্গীত শুনেছি, সাধারণত সেগুলিতে একরকম তুলনা থাকে। আমার দেশ দুনিয়ার সেরা, এরকম একটা ভাব থাকে যে 'তোমার দেশের চেয়ে আমার দেশ ভাল'। আমাদের এটা আছে সেটা আছে ইত্যাদি। আমরা ভাই এইসব কিছু বলিনাই। আমাদের কথা হচ্ছে আমার দেশ আমার মা। মাকে ভালোবাসার জন্যে কি যুক্তি দিতে হয়? তোমার দেশ তোমার কাছে কেন শ্রেষ্ঠ তুমিই ভাল জানো। আমার দেশ আমার মা। মা তো মা, ভাল হলেও মা মন্দ হলেও মা। 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
আর অন্যান্য দেশের জাতুয় সঙ্গীত যখন শুনি অনেক দেশেই দেখি একরকম একটা মেরে ফেলবো কেটে ফেলবো ভাব থাকে। একরকম মিলিটারি মিলিটারি বা জঙ্গি জঙ্গি একটা ভাব। আমরা সেরকম গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বেছে নেইনাই। কেন ভাই, কথায় কথায় হুঙ্কার দেওয়ার দরকারটা কি? আমার দেশকে আমি ভালোবাসি, আর ভালোবাসার জন্যে সন্তান কি করতে পারে সে কি ঢাক পিটিয়ে মার্চ করে বলার দরকার আছে? আমরা বলে দিচ্ছি, আময়ের বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। আমি মায়ের ম্লান মুখ দেখতে চাইনা।
আপনি অন্য দেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনে দেখতে পারেন। সেগুলিও সুন্দর। কিন্তু কিছু আছে ভিনদেশি জাতীয় সঙ্গীত, কিন্তু শুনলে আপনিও উদ্দীপ্ত হবেন। খুবই ভালো। কিন্তু আমাদের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' এইটার মত আর কোনটা নাই।
(৩)
আরেকটা কারণ আছে। রবীন্দ্রনাথের এই যে গানটা, এই গানটার রচনার প্রেক্ষাপট আর আমাদের এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। যোগসূত্রটা আপনারাও জানেন। যারা এটা নিয়ে ভাবেননি, তাঁদের জন্যে যোগসূত্রটা আরেকদিন বিস্তারিত বলবো। এখানে শুধু একটা কথা বলে রাখি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে এই রাজনৈতিক যোগসূত্রটা আপনি আমি টের পাই বা না পাই, রাজাকার বা পাকিপন্থী বা দ্বিজাতিতত্বপন্থী যেসব মিয়া সাহেব আর জেনারেল সাহেবরা আছেন ওরা কিন্তু এই যোগসূত্রটা ঠিকই জানে। এজন্যে জিয়াউর রহমানের সময় মাঝে মাঝেই কিছু লোক জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের ধুয়া তুলে মাঠের অবস্থা বুঝতে চাইতো। ওরা এখনো আছে, মাঠ ছাড়ে নাই। অনেকে আওয়ামী লীগের পেটের মধ্যেও ঢুকে আছে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।