বিপ্লবী কাকে বলে জানেন ?
(১)
তরুণ বন্ধুদেরকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়- বিপ্লবী কাকে বলে জানেন? 'বিপ্লবী' শব্দটা শুনে কি আপনার বুকের ভিতর একরকম স্পন্দন জাগে? এই পচা সমাজটাকে ভেঙে চুরে গুড়িয়ে দেওয়ার প্রচণ্ড তাড়না যখন বুকের ভিতরে তোলপাড় করে ওঠে তখন কি আপনার কখনো নিজেকেই বিপ্লবী মনে হয়েছে? বা বৈষম্য অন্যায় অনাচার যখন চারপাশে গুয়ের গন্ধের মত জুড়ে থাকে আর সেইসব দেখে যখন আপনার বিবমিষা উদ্রেক হয় তখন আপনার কি কখনো বিপ্লবী হতে ইচ্ছা করে না? করে তো?
সমাজ যদি আপনার ভাঙতে ইচ্ছা করে তাইলে বিপ্লবী হওয়ার শুরুর ইচ্ছাটা তো আপনার আছেই। কিন্তু কেবল ভাঙ্গার ইচ্ছা হলেই তো হবেনা। নষ্ট সমাজটা যখন আপনার ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে, তখন কিন্তু আপনি কেবল ভাঙ্গার জন্যেই ভাঙতে চাননা। আপনি চান যে এই পচা সমাজটা ভেঙে এর জায়গায় একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করবেন। এমন সমাজ যেখানে বৈষম্য থাকবে না, অন্যায় অনাচার থাকবে না। যেখানে প্রতিটা মানুষ মানুষের মর্যাদায় বাঁচবে।
(২)
কিন্তু এই কাজটা তো খুব সোজা কাজ না। প্রথমেই তো আপনাকে জানতে হবে এই যে সমাজটাকে আপনি পচা সমাজ বলছেন, এটা এইরকম পচা অবস্থায় আসলো কি করে। ঠিক কোন জায়গাটায় পচন রয়েছে? কেন ধরেছে এইসব পচন? মানুষের সমাজ কি সব সময়ই এরকম পচা ছিল? সবসময়ই এরকম বৈষম্যমূলক ছিল? সারা দুনিয়ার মানব সমাজই কি একইরকম ভাবে পচা? নাকি একেক সমাজের পচন একেকরকম? এইসব যদি আপনি না জানেন তাইলে সমাজ ভাঙবেনই বা কি করে আর ভাঙ্গার পরে নতুন আরেকটা সমাজ গড়বেনই বা কি করে?
আর গড়ার প্রশ্ন যখন আসে, তখন প্রথম থেকেই তো আপনাকে একটা ডিজাইন নিয়ে নামতে হবে। পচা সমাজ ভেঙে যে সুন্দর সমাজ করবেন সেই সুন্দর সমাজের ডিজাইন। সুন্দর সমাজের ডিজাইন করাটাও তো খুব সহজ কাজ না। সেটার জন্যেও তো অনেক কিছু জানতে হয়। কিভাবে কাঠামো করবেন- কিরকম ভিত্তি হলে পরে উপরের কাঠামোটা সুন্দর করে বানানো যাবে সেটাও জানতে হবে না? টেকসই একটা সুন্দর সমাজ বানাতে হলে কতরকম কত হিসাব কিতাব বুঝতে হয়।
(৩)
তাইলে দেখেন, বিপ্লবী হওয়ার ব্যাপারটা অত সহজ ব্যাপার না। বিপ্লবী হওয়ার জন্যে আপনার আবেগটা খুবই জরুরী। কিন্তু কেবল আবেগ দিয়ে আপনি দুই চারজন মানুষ মেরে ফেলতে পারবেন , কয়েকটা বিল্ডিং উড়িয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু এই পচা সমাজকে ভাঙ্গা তো দুরের কথা, এর একটা ছাল বাকলাও উঠাতে পারবেন না। এই যে পচা সমাজটা আছে, এই সমাজ তো নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে। যারা এই পচা সমাজের সুবিধাভোগী, ওরা কি আপনাকে ছেড়ে দিবে?
আপনি বলবেন 'এই সমাজ ভাঙতে হবে' আর সাথে সাথে সকলে বলবে যে 'হ্যাঁ চলেন ভেঙে ফেলি'? এতো সোজা? লোকে বলবে যে, 'কেন ভাই, যেরকম আছে ভালোই তো আছে, সমস্যা হলে বলো একটু সংস্কার করে নিই, ভাঙতে হবে কেন?' কেউ বলবে যে 'ভাই ভাঙতে চান সে তো ভাল কথা, কিন্তু ভেঙে যে একটা ভাল কিছু বানাতে পারবেন, তাঁর গ্যারান্টি কি?' এখানে এই বর্তমান কাঠামোতে যাদের সুবিধা ওরা ওদের ভোগ করা সুবিধা থেকে উচ্ছিষ্ট কিছু ছুড়ে দিয়ে আবার আপনার বন্ধুকেই লাগাবে আপনার পিছনে। আপনার বন্ধু একটা লাঠি নিয়ে এসে আপনার মাথায় মারবে বারি।
তাইলে ভেবে দেখেন, চে গিভেরার ছবিওয়ালা টিশার্ট পরে নেমে পড়লেই তো বিপ্লবী হওয়া যায়না। আপনি সমাজকে ভাঙ্গার আগেই সমাজই আপনাকে মেরে ফেলবে।
(৪)
তাইলে কি বিপ্লব করবেন না? অবশ্যই করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কিনা একটু গুছিয়ে করতে হয়। আর বিপ্লব তো কেবল একটা শহর একটা জেলা বা একটা দেশেরই ব্যাপার না। বিপ্লব একটা বিশ্বজনীন ব্যাপার। আপনি হয়তো একটা দেশকে নিয়েই বিপ্লব করতে চান, কিন্তু সারা দুনিয়াই তো বর্তমান কাঠামো ধরে রাখতে চায়। তাইলে আপনি না চাইলেও আপনার লড়াইটা সারা দুনিয়াব্যাপিই।
আর একা তো পারবেন না। দল পাকাতে হবে। দল পাকাবেন কাকে নিয়ে? শোষিত বঞ্চিতরাই তো বিপ্লব করার কথা, সুতরাং ওদের নিয়েই দল পাকাবেন। কিন্তু শোষিত বঞ্চিতরাই বা আপনার দলে আসবে কেন? একজন বঞ্চিত মানুষ তো বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা নাও করতে পারে। একজন হয়তো ভাববে 'কি দরকার এত মারামারি কাটাকাটি করে, দেখি না কায়দা করে নিজের দুরবস্থাটা কাটিয়ে ফেলতে পারি কিনা'। সে তো আর আপনার দলে আসবে না। এদের সংখ্যা তো আর কম হবার কথা না।
আর দলও না হয় পাকালেন বেশ কায়দা করে। তাইলেও তো হবে না। কেবল আপনার দল চাইলেই কি হবে? সমাজটাতে একটা বাস্তব অবস্থা থাকতে হবে না আপনার পক্ষে? সেই অবস্থাটাও তো জরুরী।
(৫)
এতোসব প্রস্তুতি তো ভাই বিশাল ঝামেলার কাজ। আসলেই বিশাল ঝামেলার কাজ। বিপ্লবী যদি হতে চান তাইলে এই ঝামেলাগুলি সামলেই আপনাকে বিপ্লব করার প্রস্তুতি নিতে হবে। এই কাজে জীবন চলে যেতে পারে। জি। জীবন চলে যেতে পারে। সেই প্রস্তুতি নিয়েই নামতে হবে। বিপ্লবী হওয়া মানে মানুষের মুক্তির জন্যে জীবন উৎসর্গ করা। আপনি কি সেটা করবেন? কেন করবেন?
নিকোলাই অস্ত্রভস্কি নামে একজন রুশ লেখকের কথা তুলে দিচ্ছি-
"জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ।এই জীবন সে পায় মাত্র একটি বার; তাই এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবনযাপন করার যন্ত্রণা ভরা অনুশোচনায় ভূগতে না হয়; যাতে বিগত জীবনের গ্লানিভরা লজ্জার দহন সইতে না হয়। এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষ বলতে পারে -আমার সমগ্র জীবন সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্যে -মানুষের মুক্তির সংগ্রামে।"
(৬)
আপনি হয়তো ভাবলেন, 'আমার সমগ্র জীবন সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেবো এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্যে -মানুষের মুক্তির সংগ্রামে।' তারপরেও বিপ্লবের পথে টিকে থাকা অনেক কঠিন। বিল্পবের পথে প্রতিদিন দুনিয়া জুড়ে হাজার মানুষ নামে, আবার এই পথ থেকে প্রতিদিন হাজার মানুষ সরেও যায়। সরে যায় কেন জানেন? ভয়ে সরে যায় এরকম তো কিছু আছেই। কিন্তু ভয়ের চেয়ে বড় কারণ লোভ। নিজের জীবন আরাম আয়েশে কাটানোর লোভ।
পুঁজিবাদের উচ্ছিষ্ট ভোগ করেও বেশ আরামে আয়েশে জীবন কাটানো যায়। এটা সেরকম কঠিন কাজ না। সেই লোভ থেকে সরে আসা বড় কঠিন। মৃত্যুভয়কে জয় করা যতো কঠিন, নিশ্চিত জীবনের আরাম আয়েশের লোভ কাটানো তার চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশী কঠিন। এইরকম লোভে পরে মানুষ বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবনযাপন করার যন্ত্রণা ভরা অনুশোচনায় ভূগতে থাকে আর যাপিত জীবনের গ্লানিভরা লজ্জার দহন সইতে থাকে, তবু বিপ্লবের পথ মাড়ায় না।
(৭)
এই কারণেই প্রকৃত বিপ্লবীরা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ।
আজকে এইসব কথা কেন বলছি? গ্লানি থেকে বলছি। ঈর্ষা থেকে বলছি। মার্চের এক তারিখ আসলেই এই ঈর্ষা আর গ্লানি আমাদের মাথা নত করে দেয়। বাংলাদেশে আমার মত হাজার মানুষ, যারা বিপ্লবের পথ থেকে সরে এসেছে, ওরা নিজেদের ক্ষুদ্রতা অনুভব করতে পারে মার্চের এক তারিখ এলেই। মার্চের এক তারিখ কি জানেন?
তাজুল ইসলাম নামে একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যুবার্ষিকী মার্চের এক তারিখ। নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেধাবী এই যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ডিগ্রী ফিগ্রি নিয়েও ব্যাক্তিগত প্রতিষ্ঠার কথা ভুলে এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্যে -মানুষের মুক্তির সংগ্রামে জীবন ব্যয় করেছে। আর আমদেরকে ফেলে দিয়ে গেছে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবনযাপন করার যন্ত্রণা ভরা অনুশোচনায় ভোগার জন্যে আর এই অর্থহীন জীবনের গ্লানিভরা লজ্জার দহন সহ্য করার জন্যে।
আমার যখন মৃত্যু হবে, আমি সম্ভবত তাজুল এবং এরকম আরও কিছু মানুষের প্রতি ঈর্ষা নিয়েই মৃত্যুবরণ করবো, কেননা তাজুল বিপ্লবী ছিলেন, আমি পুঁজিবাদের উচ্ছিষ্টভুগির জীবন যাপন করেছি।
(৮)
তরুণ বন্ধুরা, আপনারা যদি বিপ্লবী হতে চান, আপনার প্রিয়তম সম্পদ জীবন কিভাবে ব্যয় করবেন জানতে চান, তাজুল ইসলামের দিকে তাকান।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।