অভিজিতদের হারা চলবে না
(১)
অভিজিতরা হারলে বাংলাদেশ হারবে। এই কথাটা নেহায়েত আবেগের কথা না। এই কথাটার মধ্যে কোন অতিরঞ্জনও নাই। কে বলেছিল প্রথম এই কথাটা জানিনা, কিন্তু প্রতিটা বর্ণে বর্ণে কথাটা সত্যি।
একজন অভিজিৎ শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে জাতি হিসাবে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের পরাজয় হয়না। আমাদের উপর তখন দায়িত্ব চলে আসে যেন আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে মৃত্যুতে যেন অভিজিতের পরাজয় না হয়। এটা যদি আমরা করতে না পারি, অর্থাৎ আমরা যদি নিশ্চিত করতে না পারি যে মৃত্যুতেও অভিজিতই জয়ী, তাইলে জাতি হিসাবে আমরা মানে কিনা বাঙালিরা হেরে যাই আর দেশ হিসাবে বাংলাদেশ হেরে যায়।
গতকাল শুনলাম কয়েকজন নাকি প্রশ্ন তুলেছেন এই কথাটা, অর্থাৎ অভিজিতরা হারলে হেরে যায় বাংলাদেশ, বলাটা নাকি ঠিক হচ্ছে না। একজন বিশিষ্ট ফেসবুকার লেখক নাকি এই প্রশ্নও করেছেন যে- অভিজিৎ কি একুশের চেয়েও বড়? কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বড়? তাঁর প্রশ্ন হচ্ছে তাইলে অভিজিতরা হারলে বাংলাদেশ হারবে এই কথাটা কেন বলা হচ্ছে।
আমি আপনাকে প্রথমেই বলে নিই, যারা 'অভিজিতরা হারলে বাংলাদেশ হারবে' এই কথাটার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তারা একটা আদর্শগত অবস্থান থেকেই এই প্রশ্নটা তোলে। এমনি ক্যাজুয়ালি কথা চালাচালির জন্যে এরা এইসব প্রশ্ন তোলে না। এরা হচ্ছে মোটা দাগে দ্বিজাতিতত্বে বিশ্বাস করা লোক। অর্থাৎ কিনা এরা মনে করে যে কেবল ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় দিয়ে একটা জাতি গঠিত হতে পারে না, ধর্মের ভিত্তিতে তাকে বিভক্ত করতে হবে। এরা মনে করে যে বাংলাদেশ সাধারণভাবে বাঙালির দেশ না, এটা হচ্ছে মুসলমান বাঙালির দেশ।
এই দ্বিজাতিতত্বওয়ালাদের সাথে অভিজিৎ এবং আমাদের সংঘাতের জায়গাটা বলি।
(২)
যারা একদম রাজাকার ছিল এরা তো ছিলই। এরা ছাড়াও আরেকদল লোক আছে যারা মনে করে যে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়াটা আসলে একটা পাকিস্তান ভেঙে দুইটা পাকিস্তান হওয়া। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন। এমনিতে মনে হবে এরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই লোক। আবুল মনসুর আহমেদ এই লাইনে লেখালেখি করেছেন। জিয়াউর রহমান এই লাইনেই কিছুটা অগ্রসর হয়েছিলেন। এরা দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানে বটে, কিন্তু আদর্শগতভাবে এখনো মনে করে পাকিস্তানের সৃষ্টিতত্ব, অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্বই সঠিক এবং এখনো সেটাই প্রযোজ্য।
আজকেও কিছু লোক প্রশ্ন তোলে যে ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি আমাদের স্বাধীনতার চেতনার অংশ না। ঐ তো সেই পুরনো কথা, হিন্দু মুসলমান মিলে একটা জাতি হতে পারে না। বাঙালি বলে একটা জাতি হবে না, হতে হবে বাংলাদেশী। যেন আমরা অর্থাৎ মুসলমান বাঙালিরা হিন্দু বাঙালির সাথে মিশে না যাই।
এমনিতে আমরা সাধারণভাবে বাঙালি-বাংলাদেশী তর্ক করতে গেলে অনেকে আদিবাসীদের প্রশ্নটা নিয়ে এসে বলতে চেষ্টা করেন যে বাঙালি পরিচয় সকল নৃগোষ্ঠীকে ধারণ করে না বিধায় বাংলাদেশী পরিচয়টাই নাকি যথার্থ। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন সংবিধানে জাতীয় পরিচয় বাঙালি থেকে বাংলাদেশী করার পেছনে জিয়াউর রহমানের আদর্শিক কারণটা কিন্তু আদিবাসী প্রশ্ন ছিল না। জিয়াউর রহমান এটা করেছিল দ্বিজাতিতত্বের চেতনা থেকে। এই কথাটা খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সনে বাংলা একাডেমীতে দেওয়া এক বক্তৃতায় জিয়াউর রহমানের তাত্বিক আবদুল হামিদ চৌধুরী বলেছিলেন। পরে পার্লামেন্টেও ওরা স্পষ্ট করেছে যে বাঙালি থেকে বাংলাদেশী আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে মুসলিম জাতীয়তাবাদে প্রত্যাবর্তনেরই সূত্র।
এরা ভুল। যারা স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা খুঁজে পায়না। এরা চেতনাগতভাবে সাম্প্রদায়িকতায় ভোগে বলেই খুঁজে পায়না। আসলে তো ১৯৪৭এর পর পরই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে এই সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে জাতিভেদ এই জিনিস বাঙালির পোষাবে না। এই যে ১৯৫২ সনের ঘটনাটা, এটা যে আমাদের বাঙালি পরিচয়ে ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের ধারনার বিপরীতে দাঁড়ানোর ঘটনা সেই কথা কি এলাবরেটলি ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে?
(৩)
প্রথমে কয়েকটা রাষ্ট্রভাষার মধ্যে বাংলাকে একটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবী থেকে শুরু করে ১৯৭০ সনে তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা কিংবা তুমি কে আমি কে বাঙ্গালী বাঙালি এবং পরের বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, এই সবকিছুরই ভিত্তি তো ঐটাই, রাষ্ট্রীয় পরিচয় এবং জাতীয় পরিচয়ের গা থেকে ধর্মকে ঝেড়ে ফেলা। আপনি একটু পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে বাঙালি কি না করছে- নতুন কবিতা লিখছে, নূতন উপন্যাস লিখছে, সিনেমা বানাচ্ছে, গান বানাচ্ছে। মুসলমানিত্ব তখন ঝেড়ে ফেলেছি আমরা।
এইখানেই বাঙালির জাতীয় পরিচয়ের সাথে অভিজিতদের যোগ। অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশ বানিয়েছি। এখানে মুক্তচিন্তার চর্চা হবে স্বাধীনভাবে, শঙ্কা সংশয়হীনভাবে। মানুষকে ব্যাখ্যা করা আর প্রকৃতিকে জানা আর ব্যাখ্যার করার ক্ষেত্রে আমরা প্রচলিত বিশ্বাসের চৌহদ্দিতে আটকে থাকবো না। ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা প্রথা প্রতিষ্ঠান আমাদের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এটাই তো আমাদের অর্জন।
এখন আপনি যদি মুক্তবুদ্ধি বা মুক্তচিন্তা চর্চার জন্যে মানুষকে মেরে ফেলেন আর রাষ্ট্র যদি এসে বলে যে না ধর্মীয় বিধি বিধানের পান থেকে চুন খসলে সেই জ্ঞান চর্চা করা যাবে না, তাইলে জাতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমরা কোথায় রাখলাম। এইখানেই অভিজিতদের জয় পরাজয়ের সাথে বাংলাদেশের হারজিতের প্রশ্ন একসাথে মিলে যায়। অভিজিতের শারীরিক মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক হবে সেটা, যদি আমার রাষ্ট্র অভিজিতের খুনিদের পছন্দের কথা বলে। সেদিন আমার বাংলাদেশ আর আমার বাংলাদেশ থাকবে না। ঐ যে যারা বাংলাদেশকে দেখে এক পাকিস্তান ভেঙে দুইটা পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার একাংশ বা দ্বিজাতিতত্বেরই সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হিসাবে, দেশটা চলে যাবে ওদের দখলে।
এই কারণেই কথাটা। অভিজিতরা হারলে বাংলাদেশ হারবে। এইটাকেই আপনি বিস্তারিত করে বললে বলতে পারেন অভিজিতরা হারলে ২১ ফেব্রুয়ারি হারবে, অভিজিতরা হারলে ১৯৭১ হারবে।
(৪)
অভিজিতের শারীরিক মৃত্যুর চেয়ে এটা গুরুত্বপূর্ণ। অভিজিতদের হারা চলবে না। সংগ্রামে নেতার মৃত্যু হতে পারে, পরাজয় নয়। সমরে সেনাপতির মৃত্যু হতে পারে, পরাজয় নয়। অভিজিতের মৃত্যু হয়েছে, পরাজয় নয়।
অভিজিতরা যদি হেরে যায় তাইলে আমি আমার এই দীর্ঘ সংগ্রামের উত্তরাধিকার হারিয়ে ফেলবো। আমার একুশের বাংলাদেশ হারাব আমার একাত্তরের বিজয় চুরি হয়ে যাবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।