- হোম
- >
- বাংলা ও বাঙালি
- >
- অভিজিৎ রায়
অভিজিৎ রায়
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
প্রিন্টঅঅ-অ+
অভিজিৎ রায় (১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী-মার্কিন প্রকৌশলী, লেখক ও ব্লগার। তিনি বাংলাদেশের মুক্ত চিন্তার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে সরকার সেন্সরশিপ এবং ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়কারক ছিলেন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী কিন্তু তিনি তার স্ব-প্রতিষ্ঠিত সাইট মুক্তমনায় লেখালেখির জন্য পরিচিত। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে আহত করে।
প্রাথমিক জীবন
অভিজিৎ রায়ের পিতা একুশে পুরস্কার বিজয়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. অজয় রায়। অভিজিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্র কৌশলে স্নাতক ডিগ্রী প্রাপ্ত এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছাড়ার আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখান থেকে আটলান্টা, জর্জিয়ায় যান এবং বাংলাদেশে ফিরে আসা না পর্যন্ত সেখানে একজন প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করতেন।
কর্মজীবন
পেশায় তিনি একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তবে তিনি নিয়মিত ব্লগ ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি করতেন। তিনি মোট ৮টি বই প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান, নাস্তিকতাবাদ, বাস্তববাদ, সন্দেহবাদ ও যৌক্তিকতার ওপর ভিত্তি করে রচিত অবিশ্বাসের দর্শন এবং বিশ্বাসের ভাইরাস নামক তাঁর দুটি বাংলা বই পাঠক মহলে বহুমুখী সমালোচনা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মুক্তমনা ব্লগ
তিনি ২০০১ সালের দিকে সমমনা কয়েকজন লেখকদের নিয়ে মুক্তমনা নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। তিনি এই সাইটের আটজন নিয়ন্ত্রককের একজন ছিলেন। এই ওয়েবসাইটটি দ্য ববস সেরা অনলাইন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০০৭ সালে মুক্তবুদ্ধি, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার ও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রেক্ষিতে মুক্তমনা ওয়েবসাইট শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক অর্জন করে। এই ওয়েবসাইটে হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর ঠিক পূর্বে তাঁকে পাঠানো হত্যার হুমকিগুলি প্রকাশ করা হয়।
অভিজিত তাঁর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আদর্শভিত্তিক রচনাগুলির জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলের কট্টরপন্থী সমর্থকদের নিকট হতে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। রকমারি.কম নামক অনলাইন কেনাকাটা করার ওয়েবসাইটের মালিক ইসলামী মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি পাওয়ার পর থেকে এই ওয়েবসাইট অভিজিতের বই বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়।
প্রতিবাদ
বহু বাংলাদেশী ব্লগার ২০১৩ শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন করে। একই বছর ইসলামের অবমাননার অভিযোগে মৌলবাদী ইসলামী দলগুলি শাহবাগ আন্দোলনকারী ব্লগারদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে শাপলা চত্বরে আন্দোলনের ডাক দেয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজীব হায়দার কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী দ্বারা খুন হন। দ্য ববস সেরা অনলাইন পুরস্কার প্রাপ্ত ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন আনোয়ার আল-আওলাকি দ্বারা প্রভাবিত চার যুবক দ্বারা আক্রান্ত হন। শফিউল ইসলাম নামক একজন সমাজবিদ্যার অধ্যাপক ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারা নিহত হন। মহিউদ্দিনের ব্লগ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ইসলাম ও মুহাম্মাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলাদেশ সরকার বহু ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে এবং এক ডজনের মতো ওয়েবসাইট ও ব্লগ বন্ধ করে দেয়। হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স, কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বাংলাদেশের ব্লগারদের গ্রেপ্তারের ঘটনাসমূহের তীব্র নিন্দা জানায়।
অভিজিৎ রায় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ছাড়াও সেন্টার ফর ইনক্যুয়ারি এবং ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিক্যাল ইউনিয়ন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির নিকট সমর্থনের আবেদন জানান। তিনি ঢাকা, নিউ ইয়র্ক সিটি, ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন, অটোয়া প্রভৃতি শহরে বন্দী ব্লগারদের সমর্থনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। সালমান রুশদি, তসলিমা নাসরিন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হেমন্ত মেহতা, মারিয়াম নামাজি, অনু মুহাম্মদ, কাইয়ুম চোধুরী, অজয় রায়, রামেন্দু মজুমদার প্রভৃতি প্রথিতযশা ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিরা বন্দী ব্লগারদের সমর্থনে সর্বসমক্ষে মতপ্রকাশ করে অভিজিতের সঙ্গে যোগ দেন।
হত্যা
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে অভিজিৎ একুশে বইমেলা চলাকালীন ঢাকা যাত্রা করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলায় তিনি ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা একটি রিকশায় করে একুশে বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় সাড়ে আটটা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নিকটে অপরিচিত দুস্কৃতিদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সাক্ষীদের মতে, দুইজন দুষ্কৃতি তাঁদের থামিয়ে রিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তায় ফেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁদের কোপাতে থাকেন। অভিজিতের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর কাঁধে ধারালো অস্ত্রের আঘাত লাগে এবং বাম হাতের আঙুলগুলি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। উভয়কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যাওয়া হলে অভিজিৎ রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মৃত্যুবরণ করেন। রাফিদা আহমেদ বন্যা চিকিৎসার পর বেঁচে যান।
অভিজিতের মৃত্যুর একদিন পরে আনসার বাংলা-৭ নামক একটি সংঘঠন এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অভিজিতের পিতা অজয় রায় ২৭শে ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় হত্যার অভিযোগ দায়ের করেন।
১লা মার্চ অভিজিতের মৃতদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য্যের নিকট রাখা হয়, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান করেন। অভিজিতের ইচ্ছানুসারে তাঁর মৃতদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণার জন্য প্রদান করা হয়।
২রা মার্চ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান ফারাবি শফিউর রহমান নামক একজনকে সন্দেহমূলকভাবে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের সন্দেহানুসারে, ফারাবি বিভিন্ন ব্যক্তিকে অভিজিতের অবস্থান, পরিচয় ও পরিবারের ছবি সম্বন্ধে তথ্য দিয়েছিলেন। ফারাবি অভিজিতকে বিভিন্ন সময় ব্লগ এবং ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইটে ঢাকা পৌছলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের নিকট হতে সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ মার্চ ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের চার সদস্যের দল বাংলাদেশের গোয়েন্দা দলের সাথে মিলিত ভাবে হত্যার স্থানটি পর্যবেক্ষণ করে প্রমাণ সংগ্রহ করেন।
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে শোকাহত এবং ক্ষুব্ধ। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী এই লেখকের মৃত্যু বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি। ক্ষণজন্মা এই লেখক এবং বিজ্ঞানীর জীবন স্বল্পায়ু হলেও ছিলো বর্ণাঢ্য। আসুন, তার ব্যাপারে জানি।
১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, অভিজিৎ রায়ের জন্ম। তাঁর পিতা অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য ২০১২ সালে অজয় রায় একুশে পদকের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হন।
লেখালেখি
অভিজিৎ রায় ইন্টারনেট, ম্যাগাজিন এবং দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তার লেখার বিষয় ছিলো আধুনিক বিজ্ঞান, নাস্তিকতা, সমকামিতা এবং দর্শন। মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশিত তার বইগুলো হল-
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫)
মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭)
স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮)
সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০)
অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১)
বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২)
ভালবাসা কারে কয় (২০১২)
শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪)
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫)
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।