উচ্চ আদালতে উপেক্ষিত বাংলা ভাষা
যে ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে, মহান ভাষা আন্দোলনের সেই দেশেরই উচ্চ আদালতে আজও উপেক্ষিত বাংলা ভাষা।সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রথা ও রীতিনীতির কথা বলে স্বাধীনতার ৪৫ বছরে এখনো সব কাজকর্ম চলছে ইংরেজি ভাষাতেই। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকরা রায়, আদেশ বা নির্দেশনা দিচ্ছেন ইংরেজিতেই। শুধু তাই নয়, আইনজীবীরাও তাদের শুনানিও করেন ইংরেজি ভাষায়।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. তুহিন মালিক বলেন, উচ্চ আদালতে ইংরেজির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে যারা ভারত বা পাকিস্তানের উদাহরণ টানেন তাদের জানা দরকার যে, বিভিন্ন ভাষাভাষীর দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানে জনগণের একক কোনো ভাষা নেই। তাদের সংবিধানে বহু ভাষার মধ্যে আপসকামি হিসেবে ইংরেজিকে আদালতের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ইংরেজিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে। এমনকি আমাদের সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে বিরোধ হলে বাংলাকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের সব অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করতে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা হয়। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতে সওয়াল জবাব এবং আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’
২০১১ সালে জাতীয় আইন কমিশন উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে গুরুত্ব আরোপ করে আইন সংস্কারের সুপারিশও করেছিল।
আইনজ্ঞরা বলেন, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আইনগত কোনো জটিলতা নেই। মাতৃভাষা বাংলায় উচ্চ আদালতে রায় দেওয়া হলে সাধারণ বিচার প্রার্থীরা সহজেই তা বুঝতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারপতির সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. এম শাহ আলম বলেন, যেহেতু বর্তমানে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে কোনো আইনগত বাধা নেই, সেহেতু বিচারপতিরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টে বাংলায় রায় লিখেছেন অনেক বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ভাষায় রায় লেখেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলা ভাষায় সর্বাধিক রায় লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাই বর্তমান সময়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা বাংলায় রায় লিখলে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করি।
আশার কথা, সম্প্রতি ‘মাতৃভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতি’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারকাজ বাংলায় হওয়া উচিত। আমিও চিন্তা করছি, দু-একটি রায় বাংলায় দেওয়ার জন্য।
জানা যায়, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী, কাজী এবাদুল, এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীসহ কয়েকজন বিচারপতি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেই অর্থে অন্য বিচারপতিরা তাদের অনুসরণ করেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বে বিচারপ্রার্থীদের শুনানি ও রায় বোঝার জন্য উচ্চ আদালতে দাফতরিক কাজসহ আদালতের রায় ও আদেশ চলে তাদের নিজস্ব ভাষায়।
সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা। সুপ্রিম কোর্ট রুলসেও ভাষা হিসেবে প্রথমে বাংলা ও পরে আদালতের ভাষা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
দেশের নিম্ন আদালতের প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮৭ সালে প্রণীত বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, রায় দেবেন কোন ভাষায় এটা একান্তই বিচারপতিদের বিষয়। ইচ্ছা করলে যেকোনো ভাষায় রায় দিতে পারেন তারা। এক্ষেত্রে নেই কোনো বাধ্যবাধকতা।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।