সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা ভাই-ভাই
সাম্রাজ্যবাদের সাথে সাম্প্রদায়িকতার, বিশেষতঃ সমসাময়িক কালের সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের, রয়েছে একটি ভাই-ভাই সম্পর্ক। সাম্রাজ্যবাদ মূলতঃ একটি অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা। সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের একটি চূড়ান্ত রূপ, তার সর্বোচ্চ স্তর। এদিকে, সাম্প্রদায়িকতা হলো মূলতঃ ভাবধারা অবলম্বনে সৃষ্ট একটি সামাজিক-রাজনৈতিক উপাদান। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তা এক ভয়াবহ জঙ্গিবাদের রূপ নিয়েছে। এতদসত্ত্বেও, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর যুক্ত এবং তারা পরস্পরকে পরিপুষ্ট করার মধ্য দিয়ে সৃজিত হয়ে থাকে। একথার স্বাক্ষী হলো ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা, পাশাপাশি লুটপাটতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতা আমাদের দেশের সামনে বর্তমানে প্রধান বিপদ।
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে সম্পর্ক টাকার এপিঠ-ওপিঠের মতো। এগুলো একই বিপদের দুটি আপাতঃ ভিন্ন মুখ মাত্র। একটিকে সাথে নিয়ে (বা বাঁচিয়ে রেখে) অন্যটিকে আঘাত করার কোনো সুযোগ নেই। একটির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য অপরটির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে গৌণ বিবেচনা করাটা অথবা আপাতত: স্থগিত রাখার কথা ভাবাটা, শুধু গুরুতর ভ্রান্তিই নয় তা বাস্তবিকভাবে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, সাম্রাজ্যবাদ অথবা সাম্প্রদায়িকতারই সেবা করার মতো কাজে পরিণত হতে বাধ্য।
সমসাময়িক বিশ্ব বাস্তবতায় ‘অখ- বিশ্ব’, ‘গ্লোবাল ভিলেজ’, ‘বিশ্বজনীন পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক’, ‘এক কেন্দ্রীক বিশ্ব’ ইত্যাদির অভিঘাত বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে অবধারিতভাবে এসে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা নির্ধারণমূলক উপাদান হিসেবে কাজ করছে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা হলো বর্তমান বিশ্বের প্রধান ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বকারী শক্তি। এই বৈশ্বিক শক্তি কোনোভাবেই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে, দক্ষিণ এশিয়াকে ও বাংলাদেশকে তার স্ট্র্যাটেজির বাইরে যেতে দিতে পারে না। এই অঞ্চলে ভারত একটি বড় শক্তি। আমেরিকান লবিকে সেদেশের নিয়ন্ত্রকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বহু ক্ষেত্রেই ভারতের মাধ্যমে আমেরিকা স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রক্ষার কাজটি সম্পাদিত করছে। ফলে, সেই ইন্দো-আমেরিকান লবির মোটা দাগের নিয়ন্ত্রণেই বাংলাদেশের ঘটনাবলীর গতি প্রকৃতি বহুলাংশে নির্ধারিত হচ্ছে বলে ধরে নেয়াটা খুব ভুল হবে না।
বিশ্বের এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রধান স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ হলো ‘গণচীনকে ঠেকানো’। সামরিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্যভাবে চীনকে ঘেরাওয়ের মধ্যে রাখাটা হলো আমেরিকার জন্য একটি নিজস্ব ‘জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু’। চীনকে একদিকে বিশ্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার জন্য হুমকি এবং একই সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে আমেরিকা মনে করে। এই স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্যের কারণে আমেরিকা ঘোষণা করেছে যে, এখন বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন সামরিক শক্তির ৬০% শতাংশ মোতায়েন থাকবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। ‘চীনকে ঘেরাওয়ে রাখার’ কাজে বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের গুরুত্ব অসীম। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে আজ্ঞাবহ একটি মার্কিনপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখা ও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশি সমুদ্র এলাকার মধ্যে মার্কিন স্থায়ী নৌ উপস্থিতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক হবে না যে, এজন্য সে এতোটাই মরিয়া যে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করে হলেও তাদের নীতি বিনা প্রশ্নে অনুসরণে সম্মত একটি সরকার ক্ষমতায় আসুক, তার ব্যবস্থা করতে সে পিছপা হবে না। এসব স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্যের সাথে সাথে আমেরিকার বাড়তি লোভ হলো এদেশের তেল-গ্যাস-প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাতের সুযোগসহ খোলা-বাজার অর্থনীতির নামে দেশের সম্পদ লুটে নেয়া।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গোটা বিশ্বকে তার নিয়ন্ত্রণে ও শোষণের জালে আবদ্ধ রাখতে তৎপর রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য হলো তেল সম্পদের বিশাল উৎস। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটা আমেরিকার বিশ্ব স্ট্র্যাটেজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই উদ্দেশ্যে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রটিকে লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহার করার পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোতে, তাদের আজ্ঞাবাহী শক্তির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আমেরিকা তৎপর। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেন কোনো ‘ইসলামিক আন্দোলন’ শক্তিশালী না হয়ে উঠতে পারে, কিংবা এধরনের কোনো দেশ যেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সেক্যুলার শক্তির হাতে চলে যেতে না পারে সে বিষয়ে আমেরিকা সজাগ ও তৎপর রয়েছে। ‘সর্প হয়ে দংশন কর, আর ওঝা হয়ে ঝাড়ো’র নীতিও সে প্রয়োগ করে চলেছে। সেজন্যই আমেরিকা মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে গৃহপালিত ও নিয়ন্ত্রিত ‘ইসলামী দল’কে মদত দিয়ে চলেছে।
সাম্রাজ্যবাদকে টিকে থাকতে হলে তার প্রয়োজন একটি ‘বিপজ্জনক শত্রুর’ উপস্থিতি । অন্যান্য কারণের সাথে, তার সামরিক অস্ত্র ব্যবসা তথা মিলিটারি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের’ স্বার্থরক্ষার জন্য তা তার জন্য অপরিহার্য। সে ধরনের কোনো শত্রু-শক্তি বাস্তবে বিরাজমান না থাকলেও, সাম্রাজ্যবাদকে তা পয়দা করতে হয়। ‘সোভিয়েত বিপদ’ বহুদিন ধরে তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে। সোভিয়েতের অবসানের পর তার স্থানে সাম্রাজ্যবাদের জন্য সেরূপ একটি নতুন ‘শত্রু’ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতেই সাম্রাজ্যবাদ তালেবান, আল কায়দা, আইএস ইত্যাদি নামে ইসলামী জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে। মধ্যযুগের ‘ক্রুসেড’ বনাম ‘জিহাদ’এই যুদ্ধংদেহি দুই শিবিরের নতুন রূপে জন্ম দিয়েছে।
দেশে দেশে নিজ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদ নানা কলা-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এদেশে তাদের মূল কৌশলটি কী? বাংলাদেশে তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য মার্কিনীরা এদেশকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করে রাখতে চায়। সে ক্ষেত্রে ‘নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্যের’ মধ্যে দেশকে নিমজ্জিত রাখাটাই হলো তাদের অনুসৃত কৌশল।
সাধারণভাবে একথা বলা যায় যে, আমেরিকা বাংলাদেশে তার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বুর্জোয়া দলগুলোকে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্বের কারণে ও অধিকতরভাবে, লুটের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে, বুর্জোয়া দলগুলো সবসময় সব মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। এমন অবস্থায়, বুর্জোয়া দলগুলোকে চাপে রাখার জন্য, কিংবা দেশকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বাইরে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মাঠে নামানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলাম দলটি হলো সেরূপ ‘মেইড ইন আমেরিকা’ মার্কার ‘ইসলামী দল’। জামায়াতকে সাম্রাজ্যবাদের মদত দেয়ার এই বিষয়টি দীর্ঘদিনের। এই দীর্ঘদিনের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ থেকে সাম্রাজ্যবাদের সাথে সাম্প্রদায়িকতার সংযোগ ও সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে অবিভক্ত ভারতে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় জামায়াতে ইসলামী দলটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে জামায়াত ব্রিটেনের দালালি করেছে। পরে তা পরিণত হয়েছে পাকিস্তানের দালালিতে। আগাগোড়াই জামায়াত হলো মার্কিনীদের পদলেহী দালাল সংগঠন। ইতিহাসের পর্বে, ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, সে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য দাঙ্গা লাগিয়েছে। পাকিস্তানে দাঙ্গা লাগিয়ে কাদিয়ানিদের হত্যা করায় জামায়াত নেতা মওদুদির ফাঁসির রায়ও হয়েছিল, যা পরে সউদী অনুরোধে মওকুফ করা হয়েছিল। জামায়াত সব সময় জাতীয় আত্মপরিচয় ও স্বাধিকারের দাবিকে বিরোধিতা করেছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা ‘মওদুদিবাদ’ প্রচার করেছে। কবি নজরুলকে কাফের বলে প্রচার করেছে। ভাষা আন্দোলনকে জামায়াত ‘নাস্তিক ও ভারতীয় চরদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচার করেছে। ’৫৪ সালে কেউ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে এবং তার ‘বিবি তালাক হয়ে যাবে’ বলে ফতোয়া দিয়েছে। ইসলামের চেয়ে আমেরিকার প্রতি তার ভালোবাসা যে বেশি তার প্রমাণ, প্যালেস্টাইনে হামলা, ইরাক দখল, আফগানিস্তান দখল, লিবিয়ায় আগ্রাসন, পাকিস্তান-আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা ইত্যাদি কোনো বিষয়েই জামায়াত তেমন সরব হয়নি। হোয়াইট হাউজ ও ডাউনিং স্ট্রীটের সাথে জামায়াতের দহরম-মহরমের কথা সর্বজন বিদিত।
আমেরিকা-ব্রিটেনের কাছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটি যে কখনোই নীতিগত কোনো বিষয় নয় তা বিভিন্ন সময় তাদের নেয়া বিভিন্ন অবস্থান থেকে স্পষ্ট। তাদের কাছে প্রধান বিষয় হলো, একটি দল তাদের পক্ষের না বিপক্ষের। হিজবুত তাহরির, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদি সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশে নির্বাহী হুকুমের দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমেরিকা-ব্রিটেন তাতে কোনো আপত্তি করেনি। অথচ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতার কথা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো প্রায় প্রকাশ্যে জানিয়ে চলেছে। কারণ, জামায়াত তাদের মূল দালাল সংগঠন।
সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে বলার চেষ্টা করা হয় যে জামায়াত কোনো জঙ্গি সংগঠন নয়। এটি হলো একটি ‘উদার ইসলামী দল’। তাদের একথা যে সত্য নয়, তার প্রমাণের অভাব নেই। একথা ঠিক যে জেএমবি, হিজবুত তাহরির ইত্যাদি হলো সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু সেই সাথে একথাও ঠিক যে এসব সংগঠনে ক্যাডারের যোগানদাতা, মতাদর্শগত মুরুব্বি, রাজনৈতিক আচ্ছাদন দানকারী হিসেবে যে দলটি কাজ করে সেটি হলো জামায়াত। আটক জঙ্গিদের জামায়াত সংশ্লিষ্টতার ভুরি ভুরি অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তাছাড়া, জামায়াতের নিজস্ব কর্মকাণ্ডই কি তার সন্ত্রাসী-জঙ্গি চরিত্রের প্রমাণ বহন করে না? হাত পায়ের রগ কাটা, গান পাউডার দিয়ে ঘর-রুম-বাস জ্বালিয়ে দেয়া, ক্যাডারদের মিলিটারি কায়দায় প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র-অগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সামরিক ফর্মেশনের কায়দায় পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা চালানো ইত্যাদি কাজকর্ম জামায়াত-শিবিরের সাথে যুক্ত হয়ে রয়েছে। পুলিশকে আক্রমণের ঘটনা, পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে তারই সাহায্যে পুলিশকে রক্তাক্ত করা, আইনমন্ত্রীর গাড়ি বহরে হামলা করা, বিজিবির গাড়ি আক্রমণ করা, হিট লিস্ট তৈরি করে ব্লগারসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা, বিদেশি নাগরিক হত্যা, গীর্জায়-শিয়া মসজিদে-মন্দিরে হামলা ইত্যাদি ঘটে যাওয়া প্রায় প্রতিটি সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার প্রামাণ পাওয়া গেছে। এতোসব সহিংস জঙ্গি তাণ্ডবের পরেও কি ‘উদার ইসলামী দল’ হিসাবে তাদের সম্পর্কে মার্কিন-ব্রিটিশের দেয়া সার্টিফিকেটের সাথে একমত হওয়া যায়? বস্তুত জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় পড়ে না। এটি একটি সুগঠিত জঙ্গি-সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যেহেতু জামায়াত আমেরিকা-ব্রিটেনের সেবা করে থাকে, আমেরিকা-ব্রিটেন তাই তাকে ‘উদার ইসলামী দলের’ সিল লাগিয়ে এদেশকে নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্যের মাঝে চিরদিন ডুবিয়ে রেখে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নয়-উপনিবেশবাদী স্বার্থ এগিয়ে নিতে তৎপর রয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছে। রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করাকে সর্বোৎকৃষ্ট পথ নয় বলে তারা আমাদেরকে সবক দিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, যদি তাই হয় তাহলে তারা নিজেরা কেন হিটলারের নাৎসি পার্টি, গেস্টাপো, এসএস ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করলো? কেন কু ক্লাক্স ক্লান নামের উগ্র বর্ণবাদী সংগঠনটি আমেরিকায় নিষিদ্ধ? আল-কায়দা, তালেবান ইত্যাদি সংগঠনকে কেন তারা নিষিদ্ধ করতে দিল? অপর যে আরেকটি খোঁড়া যুক্তি এক্ষেত্রে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তা হলো, নিষিদ্ধ করা হলে জামায়েত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে ও তাতে তারা ভয়ঙ্কর বিপদজনক শক্তি হয়ে উঠবে। এই যুক্তি যদি সঠিক হতো তবে নাৎসি পার্টি, কু ক্লাক্স ক্লান, আল-কায়েদা ইত্যাদি সংগঠনতো এতোদিনে দুনিয়াকে দখল করে নিতে সক্ষম হওয়ার কথা!
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই কি সে শেষ হয়ে যাবে সাম্রাজ্যবাদী মহল এধরনের প্রশ্ন তুলে জামায়াত-শিবিরের নিষেধাজ্ঞার দাবিটির বিরোধিতা করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু, একথা তো কখনই কেউ বলেনি যে জামায়াত-শিবিরকে আইন করে নিষিদ্ধ করার পর, নাকে তেল দিয়ে ঘরে বসে থাকলেই হবে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কাজটি প্রয়োজন, কিন্তু সেটিই যথেষ্ট নয়। নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তার বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে দিতে হবে, প্রশিক্ষিত ক্যাডার কাঠামো চুরমার করে দিতে হবে, রিক্রুটমেন্ট ও কমিউনিকেশন চ্যানেলগুলোকে ধ্বংস করে দিতে হবে ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা হলো, জামায়াতের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক ও সামাজিক সংগ্রামকে বিস্তৃত, ব্যাপক, গভীর ও অপ্রতিরোধ্যরূপে গড়ে তুলতে হবে। মানুষের মন থেকে জামায়াতের ছায়া দূর করার এই কাজটি অনেকদিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে।
এসব কাজে সফল হতে হলে একই সাথে জনগণের ভাত-কাপড় ও জীবন-জীবিকার সমস্যাগুলোরও নিরসন করতে হবে। ইহলৌকিক চাহিদাগুলো পূরণে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক পথের দিশা না দেখতে পেয়ে জনগণের মাঝে যে হতাশার জন্ম হয়, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তি তাকে পুঁজি করে বিকশিত হয়। কিন্তু বুর্জোয়া শাসক দলগুলো জনগণের ইহলৌকিক চাহিদা পূরণের বদলে, বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে ধন-বৈষম্য, শ্রেণি-বৈষম্য উৎকটভাবে বাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া নয়া-উদারবাদী পুঁজিবাদী নীতির কারণেই সাম্প্রদায়িকতার প্রসারের উর্বর ভিত্তি ভূমি সৃষ্টি হয়ে চলেছে। পরিস্থিতি যেন গণ-বিপ্লবের পথে না যেতে পরে, সেজন্য সাম্প্রদায়িকতা তথা জামায়াত হলো সাম্রাজ্যবাদের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। অতএব বলা যায় যে, সাম্প্রদায়িকতা আঘাতপ্রাপ্ত হলে সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদও আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
সাম্রাজ্যবাদ জামায়াতকে সে আশ্রয় দিয়ে চলেছে। কারণ, এরূপ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে পারার সাথে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি যুক্ত। বিশ্বব্যাপী ও দেশে-দেশে সাম্রাজ্যবাদের নীল-নকশা বাস্তবায়নে জামায়াত ও এ ধরনের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হলো তাদের ‘রিজার্ভ ফোর্স’ ও ‘পঞ্চম বাহিনী’। সাম্প্রদায়িকতার সাথে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্কটি ভাই ভাইয়ের মতো। সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা যাবে না। একইভাবে, সাম্প্রদায়িকতার সাথে হাত মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে নির্মূল করা যাবে না। তাই মনে রাখতে হবে, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে’!
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।