সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাস
আনু মুহাম্মদ
প্রিন্টঅঅ-অ+
কয়েকশো বছর আগে থেকে পুঁজিবাদ সম্প্রসারণে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা খুবই সহায়ক হয়েছিলো। আর উপনিবেশগুলোতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারণে মিশনারীদের বিভিন্ন মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো, ভূমিকা ছিলো স্থানীয় ধর্মীয় নেতা ও ক্ষমতাবানদেরও। আবার ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী ভূমিকাতেও মিশনারী ও স্থানীয় কোনো কোনো ধর্মীয় নেতার সক্রিয়তা দেখা গেছে।
উত্তর উপনিবেশকালে প্রান্তস্থ দেশগুলোতে খুঁটি ধরে রাখতে এবং সমাজতন্ত্র ঠেকাতে পুঁজিবাদী কেন্দ্র বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ধর্মীয় শক্তি ব্যবহারে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। মূলধারার চার্চ সাম্রাজ্যবাদের খুঁটি হিসেবেই বরাবর ভূমিকা পালন করেছে। এর বাইরে একদিকে মুসলিম রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা অন্যদিকে ইহুদীবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ইসলামপন্থী দল ও ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র বিরোধী আতংক সৃষ্টি করবার কাজ খুবই সহজ ছিলো। ৫০ দশক থেকে আমাদের এই বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। বস্তুত সাম্রাজ্যবাদ পুষ্ট এই ধর্মপন্থীরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সামরিক বেসামরিক স্বৈরশাসকদের সমর্থন দেবার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের পথও সুগম করেছে।
‘মৌলবাদ’কে একটি গ্রামীণ, অনাধুনিক, পশ্চাৎপদ বিষয় হিসেবে দেখলে এর শেকড় সন্ধান পাওযা যাবে না, এর ব্যাপ্তি বোঝানো যাবে না। মার্কিন ইসলামবিষয়ক পন্ডিত আমিনা ওয়াদুদ এর মতে ‘ইসলামপন্থীদের বর্তমান পুনরুত্থান একটি উত্তর-আধুনিক ঘটনা’। যেভাবেই বলি না কেনো, ‘মৌলবাদী’ শক্তিগুলোর ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাবকে নিছক স্থানীয় বা জাতীয় বিষয় হিসেবে দেখা চলে না। তথ্য যুক্তি দিয়েই তারিক আলী দেখিয়েছেন যে, ‘বর্তমান সময়ে সবচাইতে বড় ‘মৌলবাদ’, ‘সকল মৌলবাদের জন্মদাতা’ হলো- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’।কীভাবে?
৮০ দশক থেকে বিশ্বজুড়ে ইসলামী ‘মৌলবাদী’ তৎপরতা বেড়ে যায়। এরসাথে প্রান্তস্থ দেশগুলোতে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের বিপন্ন দশা ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ৮০ দশক পর্যন্ত ধর্মপন্থী শক্তিগুলোকে সমাজতন্ত্র ও সবরকম মুক্তির লড়াই-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এই পর্যায়ের সর্বশেষ বড় উদাহরণ আফগানিস্তান। প্রথমে মুজাহেদীনদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেইসময় আফগান মুজাহেদীনদের সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তারা। প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে। অর্থ দিয়েছে সৌদী আরবও। ইউএসএইড সরবরাহ করেছে ইসলামী উন্মাদনা সৃষ্টির মতো বই, শিশুদের পাঠ্যপুস্তক। যার মধ্যে সোভিয়েত সৈন্যের চোখ উপড়ে ফেললে বেহেশতে যাবার প্রতিশ্রুতিও ছিলো। সিআইএ-র এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠের ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউল হকের মতো একজনকে অধিষ্ঠিত করা সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাজে দিয়েছে। একপর্যায়ে আকস্মিকভাবে বিশাল শক্তি নিয়ে উদিত হয় তালিবান। মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে যাদের অস্ত্র, সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত সমর্থন সবই যোগান দিয়েছে সেই যুক্তরাষ্ট্রই।
তালিবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের সূচনা করে ১৯৯৭ সালের ২৪ মে। ঠিক তার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যবসাজগতের মুখপাত্র ওয়াল স্ট্রীট জার্ণাল আফগানিস্তান নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে লেখা হয়: ‘আফগানিস্তান হচ্ছে মধ্য এশিয়ার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানির প্রধান পথ।...তাদের পছন্দ কর বা না না কর ইতিহাসের এই পর্যায়ে তালিবানরাই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত।’ দুদিন পর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস লেখে: ‘ক্লিনটন প্রশাসন মনে করে যে, তালিবানদের বিজয় ইরানের পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে..এমন একটি বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত করবে যা এই অঞ্চলে রাশিয়া ও ইরানের প্রভাবকে দুর্বল করবে।’ মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনোকাল, ক্লিনটন প্রশাসন ও ওয়াল স্ট্রীট জার্ণালের এরকম অবস্থানকে ‘খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি’ বলে অভিহিত করে। এই কোম্পানি বিশ্ববাজারে বিক্রির জন্য তুর্কমেনস্তিান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল নেওয়ার প্রকল্প নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।
একইবছর যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক দিক থেকে আরও অনেক শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক করবার প্রকল্প নেওয়া হয়। এই কর্মসূচির শিরোনাম দেওয়া হয়: “প্রজেক্ট ফর দ্য নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি”। এতে যারা স্বাক্ষর করেন তাঁদের মধ্যে ইউনোকাল কর্মকর্তা, অস্ত্র ব্যবসায়ী সহ আরও ছিলেন ডিক চেনী, ডোনাল্ড রামসফেল্ড, জেব বুশ এবং ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা। বিশ্বব্যাপী কট্টর পুঁজিবাদী ধারার সংস্কার, দখল, আধিপত্যের নতুন পর্ব আরও জোরদার হয়। ২০০১ সালে নিউইয়র্কের ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার পর থেকে এই কর্মসূচির অধিকতর সামরিকীকরণ ঘটে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারণাও জোরদার হয়। অথচ সৌদীসহ মুসলিম রাজতন্ত্রকে ভর করেই এই সন্ত্রাসী আধিপত্য বিস্তৃত হয়। এই প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় ইসলামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রও উর্বর হতে থাকে। অপমান, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ক্ষোভে এবং বিশ্ব রাজনীতির নানা চক্রে ইসলামপন্থী রাজনীতির নতুনভাবে প্রসার ঘটে।
কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদের নতুন শত্রুপক্ষ নির্মিত হয় ১৯৯১ সালে প্রথম ইরাকের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ বাড়তে থাকে এবং তার বিরোধী লড়াইএর নামে সাম্রাজ্যবাদী দখল বিস্তারের বৈশ্বিক এজেন্ডাসক্রিয় হয়।সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে ৮০ দশকে ইসলামপন্থী জঙ্গী সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঐক্য তৈরি হয়, যেভাবে তার আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয় তার ধারাবাহিকতা পরেও অব্যাহত থাকে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বর্তমান সময়ে ক্রমবর্ধমান নৃশংসতার মধ্যেও পাওয়া যাবে। আইসিস, তালেবান, আল কায়েদা ইত্যাদি নামে পরিচিত যেসব গোষ্ঠীকে দমন করবার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে দখলদারিত্বের নতুন জাল ফেঁদেছে তারা সবাই মার্কিনীদেরই সৃষ্ট বা লালিত পালিত দানব। এগুলোর সূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে। ইসলামের নাম নিয়ে এইসবগোষ্ঠীর বর্বর দিগভ্রান্ত সন্ত্রাসী তৎপরতাকে কেউ কেউ ‘জিহাদ’কেউ কেউ ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই’ বলে মহিমান্বিত করতে চান। মোহমুক্ত থাকলে এসব বয়ান যে কতো ভ্রান্ত তা উপলব্ধি কঠিন নয়।
অনেকে আবার এরকম ভাবে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে ‘ইসলামী জঙ্গী’দের বিরুদ্ধে সেকুলার শক্তির পক্ষে। এটিও আরেকটি বড় ভ্রান্তি। বস্তুত নির্বাচিত সেকুলার সরকার উচ্ছেদে মার্কিনী রেকর্ড অনেক। ৭০ ও ৮০ দশকে আফগানিস্তানে সেকুলার সরকারই ক্ষমতায় ছিলো, কিন্তু তারা ছিলো মার্কিন বিরোধী সোভিয়েত পন্থী। এই সরকারগুলো আফগানিস্তানে ভূমি সংস্কার, নারী অধিকার, শিক্ষা ও চিকিৎসা সংস্কারে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলো। ইরাক ও লিবিয়াতেও সেকুলার সরকার ছিলো। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানিসহ জন অধিকারের ক্ষেত্রেও তাদের অনেক সাফল্য ছিলো। যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম ও গাদ্দাফীকে উচ্ছেদের পর সেসব ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। আর সেখানে বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর প্রভাব বেড়েছে।
একইসঙ্গে গণনায় লাশের সংখ্যাও বাড়ছে। গত ২৯ মার্চ “বডি কাউন্ট: ক্যাজুয়ালটি ফিগারস আফটার টেন ইয়ারস অব দ্য ওয়ার অন টেরর” নামের এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে জার্মান, কানায়িান ও মার্কিন তিনটি সংগঠন যৌথভাবে। এগুলো হলো ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ার, ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিরিটি, এবং ফিজিশিয়ানস ফর গ্লোবাল সারভাভাইভাল”। এই রিপোর্টে ২০০৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ লাখ ইরাকে, দুই লাখের বেশি আফগানিস্তানে। মার্কিন ড্রোন ও অন্যান্য আক্রমণে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন শুধু পাকিস্তানেই। এর মধ্যে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
২০০১ এর আগে ইরাক লিবিয়া সিরিয়ায় আল কায়েদা বা তালেবান ধারার কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। তথাকথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ এই অঞ্চলকে চেনা অচেনা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সর্বশেষ এই অঞ্চলে বিরাট শক্তি ও সম্পদ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আইসিস যা ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফৎ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। নতুন শত শত গাড়ী, বার্ষিক ১৬ হাজার কোটি টাকার বাজেট এবং প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র সদস্য নিয়ে আচমকা তারা হাজির। তারা ইরাক সিরিয়ায় একের পর এক অঞ্চল দখল করছে। তারা একের পর এক ভিন্নধর্ম ও মতাবলম্বী, সংখ্যালঘু জাতির মানুষদের ধরছে, গলা কাটা ও নির্যাতনের দৃশ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করছে। হঠাৎ করে এরকম একটি বিশাল বাহিনীর জন্ম এবং ক্রমান্বয় বিজয় আফগানিস্তানে তালিবানদের আচমকা আবির্ভাব এবং দ্রুত আফগানিস্তান দখলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ছিন্নভিন্ন হবার ফলে এই দেশগুলোর মানুষদের নারকীয় অনিশ্চিত অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ইউরোপে অভিবাসনে বিশাল স্রোত এরই ফলাফল। অন্যদিকে এর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী তিনপক্ষ: সৌদী আরব, ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাদের কাছে ইরাকের সাদ্দামের অপরাধ স্বৈরশাসন ছিলো না ছিলো তেল ক্ষেত্র জাতীয়করণ এবং সামরিক শক্তি হিসেবে সৌদী আরব ও ইজরায়েলের কর্তৃত্ব অস্বীকারের ক্ষমতা। লিবিয়ার গাদ্দাফিরও একই অপরাধ ছিলো। সৌদী রাজতন্ত্র বরাবরই তার ওপর গোস্বা ছিলো। জীবনের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে ‘নয়া উদারতাবাদী’বলে পরিচিত পুঁজিপন্থী কিছু সংস্কারের পথে গেলেও গাদ্দাফীর বড় অপরাধ ছিলো সৌদী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আক্রমণাত্মক কথাবার্তা। ২০১১ সালে গাদ্দাফী সরকারকে উচ্ছেদ করবার জন্য ন্যাটো বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং আল কায়েদাসহ বিভিন্ন ভাড়াটিয়া ইসলামপন্থীদের জড়ো করার কাজটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও সৌদী আরবের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।
সিরিয়ার আসাদ সরকারেরও অপরাধ স্বৈরশাসন নয়, অপরাধ সৌদী আরব-ইজরাইল অক্ষের কাছে তার অগ্রহণযোগ্যতা। সিরিয়ার আসাদ সরকার উচ্ছেদের জন্য অতএব বিভিন্ন ক্ষুদ্ধ গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় পশ্চিমা শক্তি ও সৌদী-কাতার-জর্ডান রাজতন্ত্র। ইরানকে কাবু করাও এর একটি উদ্দেশ্য ছিলো। আসাদ বিরোধী এসব গোষ্ঠীর অধিকাংশই আল কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন গ্রুপ, ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী। সৌদী আরব, কাতার, তুরস্ক, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল অর্থ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র যোগানের ওপর ভর করেই এসব গোষ্ঠী শক্তিপ্রাপ্ত হয়। এর সাথে মার্কিন ব্রিটিশ ফরাসী ও ইজরায়েলী গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। এদেরই অনেকে এখন গঠন করেছে আইসিস। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় মুখ ফসকে আইসিস এর পেছনে এই দেশগুলোর শত হাজার কোটি ডলার সহ নানা পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে ফেললেও পরে মিত্রদের ক্ষোভের মুখে মাফ চেয়েছেন। বাইডেন অবশ্য নিজেদের ভূমিকার কথা বলেননি। কিন্তু সত্য ঢাকা পড়েনি।
দেশে বিদেশে এখন আতংক আর অনিশ্চয়তা সবধরনের সক্রিয়তার পথ আগলে আছে। জনগণের মুক্তির লড়াই ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বর্তমান গতি ও জাল, তার অন্তর্গত সংকটের কারণেই, কার্যত এক বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে গেছে বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষকে।
তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে, একইসাথে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাস বিরোধী তৎপরতা’র নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, অস্ত্র যোগান বাড়ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হচ্ছে, তখন নতুন নতুন দৃশ্যমান অদৃশ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থার দাপট বাড়ছে, সন্ত্রাস বাড়ছে, তা দমনে নতুন নতুন দমন পীড়নের আইন, বিধিনিষেধ তৈরি হচ্ছে। যারা সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী তারাই বিশ্বজুড়ে দাপাচ্ছে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ নাম দিয়ে। তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে বিশ্বসংস্থা, ‘গণতান্ত্রিক’ সভ্য রাষ্ট্র, এনজিও, ‘সুবোধ’ বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ এরই অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল, যাকে বিশ্ব সন্ত্রাসের উর্বর ভূমি বানানোর চেষ্টাও খুব জোরদার বলে মনে হয়।
গত কয়েকদশকে বাংলাদেশে একদিকে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর জৌলুস অন্যদিকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের দারিদ্র ও বৈষম্যের বিভীষিকা, একদিকে সম্ভাবনার বিকাশ অন্যদিকে দেশি-বিদেশি দখলদারদের দাপটে নিরাপত্তার বিপর্যয় একটি নির্মম বৈপরীত্যের মধ্যে বাংলাদেশকে নিক্ষেপ করেছে। দেশে এযাবত অনেক সামরিক-নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু এসব নীতির ক্ষেত্রে, দুর্নীতি ও লুন্ঠনের ক্ষেত্রে শুধু মাত্রা বেড়েছেই- নতুন কোন গতিমুখ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি। দল বদলেছে, প্রক্রিয়ার বদল হয়নি। রাজনীতির মূলধারা তাই জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে না, করে দেশী ও বিদেশী দখলদারদের। এইসব গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাদের প্রতিযোগিতা আর হিংস্র সংঘাত। আর এখানেই বর্ম হিসেবে ধর্ম ও ধর্মপন্থী গোষ্ঠী ব্যবহারের প্রতিযোগিতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে হতাশা, নিয়তিবাদিতার পাশে ধর্মপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক তাদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
কোণঠাসা হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে ধর্মপন্থী দলগুলোর মধ্যে এখনও জামায়াতে ইসলামী সবচাইতে বড় ও সংগঠিত দল। এর বাইরেও, বিশেষত মার্কিন নেতৃত্বাধীন তথাকথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ শুরু হবার পর থেকে নিত্যনতুন সংগঠনের নাম শোনা যায়। তবে এর কোনটা আসল কোনটা নকল বা কোনটা গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি তা বলা কঠিন।‘জঙ্গী’ ‘সন্ত্রাসী’ দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাস দমন’ মডেলে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশও। একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে ভারতের সাথেও যৌথ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এই মডেলে প্রবেশের অর্থ যে ‘জঙ্গী’ ও সন্ত্রাসীর বর্ধিত পুনরুৎপাদন এবং সন্ত্রাসের চিরস্থায়ীকরণ তা আমরা অভিজ্ঞতা থেকেই দেখছি।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।