- হোম
- >
- শিল্প-সাহিত্য
- >
- হিমুর মাথায় হলুদ ব্যান্ড
হিমুর মাথায় হলুদ ব্যান্ড
আরিফ জেবতিক
প্রিন্টঅঅ-অ+
ফোন করেছেন মাজেদা খালা। আমি মিনমিনিয়ে বললাম, 'খালা, বলো।'
মাজেদা খালা হড়বড় করে বললেন, 'তুই কি শাহবাগে?' আমি বললাম, 'শাহবাগে থাকব কেন? আমি কি জাদুঘর?'
মাজেদা খালাকে যেমন বোকা ভাবি তেমনটা নয়। অপরপাশ থেকে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, 'তোর ফোনে ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আর তুই বলছিস তুই শাহবাগে না?'
আমি বললাম, 'টিভিতে দেখছি খালা। তুমি টিভির সাউন্ড পাচ্ছ।'
খালা অবাক হয়ে বললেন, 'এত বড় একটা ঘটনা আর তুই শাহবাগ যাবি না?'
আমি বললাম, 'মাথা খারাপ! টিভিতে দেখাচ্ছে একদল ছেলে মাথায় হলুদ ব্যান্ড পরে ঘুরছে, ধরো ব্যান্ডের শর্ট পড়ে গেল। তখন তাঁরা আমার পাঞ্জাবি খুলে কেটে ব্যান্ড বানিয়ে ফেলল, আমি কি খালি গায়ে ঘুরব নাকি তখন?'
মাজেদা খালা বিরক্ত সুরে বললেন, 'শোন, তুই আমার বাসায় আয়। খিচুড়ি রাঁধব, এক ডেকচি খিচুড়ি নিয়ে শাহবাগে দিয়ে আসবি।' আমি বললাম, 'অবশ্যই নিয়ে আসব। তুমি রান্না চড়াও। বেশি করে ছাগলের মাংস দিবে। শাহবাগে যারা এসেছে তারা ছাগলের মাংস পছন্দ করে। তারা ছাগলকে আদর করে ডাকে ছাগু।'
'কী আজগুবি কথাবার্তা বলিস' বলে খালা ফোন রেখে দিলেন।
আমি আসলেই শাহবাগে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে মচ্ছব লেগে গেছে। সব রাস্তা দিয়ে মিছিল আসছে। মিছিলগুলো চিৎকার করে শুধু বলছে, 'ফাঁসি চাই, 'ফাঁসি চাই'। অনেকগুলো ছেলে সত্যি সত্যিই মাথায় হলুদ ব্যান্ড বেঁধে ছুটোছুটি করছে। ব্যান্ডের মাঝে লেখা ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক। দেখে মনে হচ্ছে আচমকা এত মানুষ দেখে এরা হচকচিয়ে গেছে। অনলাইনের জিনিস অফলাইনে এসে খাবি খাচ্ছে।
আমি আস্তে করে রাস্তা পার হলাম। শাহবাগ থানার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। লোকজন যেভাবে বাড়ছে, কে কী করছে কোনো কিছু বুঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তেজিত লোকজন গাড়ি ভাংচুর শুরু করবে। এদেশে লোকজন উত্তেজিত হবে আর গাড়ি ভাংবে না এমনটা হয় না। গাড়ি ভাংগার পরে পুলিশ একশনে যাবে। তখন মজা জমে যাবে। পাশেই পিজি হাসপাতালে গোলাম আযম শুয়ে আছে। উত্তেজিত লোকজন গোলাম আযমকে টেনে হেচড়ে বের করে এখানেই ফাঁসি দিয়ে দেয় কী না বুঝতে পারছি না।
দৃশ্যটা সবসময় দেখা যাবে থানার সামনে থেকে। মারামারি লাগলে মানুষ এদিকে আসবে না। ভিড়মুক্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখা যাবে।
এরকম মধুর দৃশ্য দেখা মহাপুরুষদের নিষেধ। বাবার উপদেশমালায় ৭২ নম্বর উপদেশে গোটা গোটা করে লেখা আছে, 'মহাপুরুষরা কদাচিৎ সৌন্দর্য দেখিয়া মুগ্ধ হইবেন। সৌন্দর্যের লোভে তুমি ভ্রমন করিও না, সৌন্দর্য তোমার দিকে ছুটিয়া আসিবে।'
আমি ঠিক করলাম আজকে বাবার উপদেশ শুনব না। এরকম মধুর দৃশ্য জীবনে দ্বিতীয়বার দেখা যাবে না। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। মহাপুরুষের অনন্ত অপেক্ষা করার গুন নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আশেপাশে মজমা বসে গেছে। একটু দূরে দূরে লোকজন গোল হয়ে বসে পড়েছে। সবগুলো দলের সামনেই মোববাতি জ্বলছে। আমিও একটা দল দেখে বসে পড়লাম, কেউ নিষেধ করল না। কাজকর্ম তেমন কিছু নেই। মাইকে একটি চিকনচাকন মেয়ে দুলে দুলে স্লোগান দিচ্ছে। আমার কাজ হচ্ছে সেই স্লোগানের সঙ্গে পোঁ ধরা। পোঁ না ধরলেও কোনো সমস্যা নেই। সবার হাতেই খালি পানির বোতল। একটার সঙ্গে আরেকটা বোতল বাড়ি দিলেও চলে। মেয়েটি বলছে,
'ক তে কাদের মোল্লা'
বাকিরা জবাব দিচ্ছে 'তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।'
যাদের জবাব দিতে ইচ্ছা হচ্ছে না, তারা পানির বোতল একটার সঙ্গে আরেকটা বাড়ি দিচ্ছে তালে তালে। রাজাকার বলার সঙ্গে বোতলে ভয়ানক জোরে বাড়ি দিচ্ছে, মনে হচ্ছে বোতল দিয়ে পিটিয়েই রাজাকার মেরে ফেলবে। আমি এসব ছেলেমানুষি দেখে অবাক হচ্ছি। এই ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারছে না রাজাকার কোনো তেলাপোকা নয় যে বোতলের বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলা যাবে।
আমি বোতল দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে পাশের জনকে বললাম, 'ভাই, বোতলে বাড়ি মারার সিস্টেম কী? মানে কমবয়েসি রাজাকারের জন্য অল্প জোরে বাড়ি, ধাড়ি রাজাকারের জন্য জোরে বাড়ি মারতে হবে এরকম কোনো সিস্টেম আছে নাকি?'পাশ থেকে লোকটি অবাক হয়ে বলল, 'হিমু, তুমি আমাকে ভাই বলছ কেন? আমি কি তোমার ভাই হই নাকি?'
আমি চমকালাম। মাই গড, একেবারে মেঝখালু। স্যুট টাই নেই, একটা পাতলা টিশার্ট পরে আছেন। টিশার্ট পরা মেঝখালুকে চেনার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া টিশার্টটিও একেবারে নোংরা। টিশার্টের বুকের সামনে দাড়িওয়ালা ছবি। চে গুয়েভারা না রবীন্দ্রনাথের ছবি বুঝতে পারলাম না, আজিজ মার্কেটের দোকানিরা চে গুয়েভারা আর রবীন্দ্রনাথকে একরকম করে ছেপে দেয়। টু ইন ওয়ান ছবি, রাগি রাগি চেহারার ছেলেরা চে মনে করে কিনে নেয় আর নরম সরম ছেলেরা রবীন্দ্রনাথ ভাবে। কেন যেন মনে হল চে কিংবা রবিবাবু নয়, মেঝখালুর টিশার্টে বোধহয় কাদের মোল্লার ছবি। আজকাল ফ্যাশন ওয়ালারা নানান কিসিমের টিশার্ট বানায়, শাহবাগের জন্য বোধহয় কাদের মোল্লা স্পেশাল কিছু বানিয়েছে।
আমি বললাম, 'মেঝ খালু!! আপনি এখানে কী করছেন!!'
মেঝখালু বিরক্ত হয়ে বললেন, 'কী করছি দেখতে পারছ না? কাদের মোল্লার ফাঁসি দিয়ে বাড়ি যাব।'
আমি বললাম, 'ফাঁসি না দেয়া পর্যন্ত এখানে বসে বসে বোতলে বাড়ি দিতে থাকবেন?'
মেঝখালু বললেন, ' অবশ্যই থাকব। তবে চা খাওয়া দরকার। এই এক সমস্যা হয়েছে বুঝেছ? ভার্সিটির ছেলেরা খিচুড়ি কি তেহারি দিয়েছে, কিন্তু চা দেয়নি। এতবড় একটা আন্দোলনে চা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই, চিন্তা করা যায়? মিস ম্যানেজমেন্টের চূড়ান্ত!'
আমি বললাম, 'আন্দোলনের আবার ম্যানেজমেন্ট কী? এটা কি আপনার মতিঝিলের অফিস?'
খালুকে দেখে মনে হল আমার কথায় রেগে গেছেন। রাগি রাগি গলায় বললেন, 'অবশ্যই ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার আছে। এই যে দেখ কতগুলো বাথরুম বানিয়েছে। সবগুলোর সামনে লিখেছে গোলাম আযম বাথরুম, নিজামী বাথরুম। এরকম বাথরুমে কী যাওয়া যায় বলো?'
-যাওয়া যাবে না কেন?
- বাথরুমের নাম শুনে মনে হচ্ছে ওগুলো কমোড না, রাজাকারের মুখ। প্যান্ট খুলতে পারছি না, প্যান্ট খুললেই মনে হয় ক্যাঁক করে কামড় দিয়ে বসবে।'
আমি বললাম, ' আমি এসে গেছি খালু, এখন আর সমস্যা নেই। শাহবাগ থানায় গিয়ে আপনাকে বাথরুম করিয়ে নিয়ে আসব। থানার লাইনম্যান জিন্নাত আলী আমার খাতিরের লোক। সে আপনাকে বাথরুমে নিয়ে যাবে। সহজে বাথরুম না হলে রুলের গুতা দিয়ে বাথরুম করানোরও সুব্যবস্থা আছে। তবে আগে ছবির হাটের দিকে চলেন। আপনাকে চা খাইয়ে নিয়ে আসি আগে।'
খালু একটু লাজুক গলায় বললেন, 'আমার কাছে কিন্তু চা খাওয়ার টাকা নেই। কাল ঐ ছেলেমেয়েগুলোকে দিয়ে দিয়েছি। বেচারারা পোস্টার বিক্রি করে খাবারের টাকা জোগাড় করছে, কোনো মানে হয়! মিস ম্যানেজমেন্টের চূড়ান্ত!'
আমি বললাম, 'টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমার কাছেও টাকা নেই। টাকার কথা চিন্তা করলে হবে না, আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে কাদের মোল্লার কথা।'
ছবির হাটের এক কোনায় বসেছি। আশেপাশের সব দোকানে ভিড়, কিন্তু একটা টং খালি। আমি আর খালু বেঞ্চির মধ্যে বসলাম। দোকানিকে দেখে মনে হলো চা বিক্রিতে তার তেমন কোনো উৎসাহ নেই।
পাশেই ছোট একটা ছেলে। চুলায় ফু দিতে চোখে পানি চলে এসেছে। আশেপাশের সব টং দোকানে কেরোসিনের চুলা, এই লোকের দেখা যাচ্ছে মাটির চুলা। মাটির চুলা যে বাংলাদেশে আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
ছেলেটা ভুরু কুচকে বলল, 'চা খাইতে চাইলে ওয়েট করেন। চা দিরং হইব। চুলা ভিজা।'
বলতে বলতে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার হাফপ্যান্টের চেইন খোলা। ভেতর দিয়ে সব দেখা যাচ্ছে।
আমি বললাম, 'ব্যাটা, আগে প্যান্টের চেইন লাগা। লজ্জা শরম নেই? তোর কাদের মোল্লা তো দেখা যাচ্ছে।'
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।