‘রহিম উদ্দিনের কম্বল ছিনতাই’
পিয়ারুল ইসলাম হুমায়ুন
প্রিন্টঅঅ-অ+
‘মুইও একটা মানুষ বাহে, মোর গায়ের কম্বল ছিনতাই হয়া যায়। এটা ক্যামন দুনিয়া অ্যালো। মুই এখন কি দিয়ে ঠাণ্ডা দূর করিম। এই ঠাণ্ডাত কেমন করি রাত কাটাম। মোর কম্বল গাওত থাকি টান মারি ছিনতাই করি নিয়া যায়। মোর কষ্টের কতা চোরও বোঝে না বাহে। তাই সারা রাত একান কম্বল গাওত দিয়া বসি থাকোম’।
কনকনে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকা রহিম উদ্দিন গভীর রাতে মানুষের পায়ের শব্দে উঠে এই কথাগুলো বললেন।
তখন রাত সাড়ে ১২টা। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া বৃদ্ধ রহিম উদ্দনের গায়ের দুইটা কম্বল ছিনতাই হয়ে গেছে। তখন তার চোখে ঘুমঘুম ভাব আর পেটের ক্ষুধা। তিনি তিনটা কম্বল গায়ে দিয়ে তন্দ্রা হতেই কে যেন তার গায়ের দুটি কম্বল হেঁচকা টান দিয়ে দৌড়। আর পায় কোথায়, বুড়ো রহিম উদ্দিনের চিৎকারের আগেই চম্পট! সেই থেকে রহিম উদ্দিন এই কনকনে ঠাণ্ডায় একটি কম্বল আর ছেড়া চাঁদর গায়ে দিয়ে রাত কাটাচ্ছে।
পাঠক বলছিলাম, গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি বন্দরের কড়াইবাড়ি গ্রামের রহিম উদ্দিনের কথা। এক সময় জমি, বাড়িভিটা সবই ছিলো তার। পুকুর ভরা মাছ আর সুখের সংসারের কথা মনে হলে রহিম উদ্দিন হাউ-মাউ করে ডুকড়ে কেঁদে ওঠে। এখন বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন তিনি। মনে পড়ে ১৯৮০ সালের দিকে তার ঘরবাড়ি জমিজমা সব নদী গর্ভে চলে যায়। তিনবার নদী ভেঙ্গে নিঃশ্ব হয়ে গেছেন তিনি।
চার ছেলে রশিদ, নজু, সামসুল, শাহাদুল আর এক মেয়ে উর্মিকে নিয়ে ঠাই হয় ব্রহ্মপুত্রের বাঁধে। কিন্তু একে একে চার ছেলেরা বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যায়। মেয়ে উর্মিও একদিন বাবাকে ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমান। বাধ্য হয়েই রহিম উদ্দিনকে এক কাপড়ে বের হতে হয় নদীর বাঁধ ছেড়ে। এখন কিচ্ছু নাই তার। কেউ দিলে খায়, না দিলে উপোষ। এমনিভাবে জীবন চলছে বৃদ্ধ রহিম উদ্দিনের।
কাজ না করলে পেটে খাবার জুটবে কিভাবে। ধান কাটা কাঁচি নিয়ে কাজের সন্ধ্যানে বের হয় রহিম উদ্দিন। বয়সের কারণে কেউ তাকে কাজে নেয় না। সে কারণে এক সময় তাকে চলে আসতে হয় গ্রাম ছেড়ে। ৬ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমায় তিনি। আর থাকার জায়গা হয় শহরের বিভিন্ন মানুষের বারান্দায় (মেঝে) অথবা গাইবান্ধা পৌর পার্কের চারপাশে খোলা একটি বিনোদন কক্ষে। তাও আবার দিনের বেলায় নয়, রাতের বেলা।
পৌর এলাকায় চার পাশে লাল-নীল বিভিন্ন বাঁতি জ্বলছে। নিচে পুকুরের নানা জাতের মাছের সমারোহ। পুকুরের এক কোনে চারপাশের খোলা বিনোদনের ঘর। শহর যখন ঘুমিয়ে পরে তখন রহিম উদ্দিন ঠাই নেয় খোলা ঘরে। সাথে একটা নানা সামগ্রীর বস্তা। ওই বস্তার মধ্যে তার পুরো সংসার।
কয়েকদিন হলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রহিম উদ্দিনের অবস্থা যায় যায়। শুয়ে ছিলেন পার্কের খোলা জায়গায়। দয়া করে কে যেনো ঘুমন্ত অবস্থায় তার গায়ে দুটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়ে যায়। আর আগের একটি। এই তিন কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি।
কিন্তু নিয়তি হঠাৎ গত দু’দিন আগের রাতে, কে যেন তার গায়ের দুটি কম্বল নিয়ে দৌড়ে পালায়। কনকনে ঠাণ্ডায় একটি কম্বল আর ছেড়া চাঁদরে এখন তার রাত কাটে পৌর পার্কের খোলা ওই ঘরে।
রহিম উদ্দিনকে প্রশ্ন করতে না করতেই দু’চোখ জলে ভিজে কান্না জরিত কণ্ঠে বলেন, ‘মুইও একটা মানুষ বাহে, মোর গায়ের কম্বল ছিনতাই হয়া যায়’। চোরও বোঝে না মোর কষ্ট।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।