- হোম
- >
- বাংলা ও বাঙালি
- >
- ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’
‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’
ফাহাদ মশিউর রহমান
প্রিন্টঅঅ-অ+
উপমহাদেশের অসামান্য দেশপ্রেমিক বাঙালি বীর স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন আজ। যিনি ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গড়ে তুলে ভারতবর্ষকে ইংরেজ উপনিবেশের নিগড় থেকে মুক্তির লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ তার মুক্তিমন্ত্রে জেগে উঠেছিল সমগ্র উপমহাদেশ। কিন্তু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অবাঙালি নেতাদের কারণে তিনি উপলব্ধি করেন, দেশে থেকে স্বাধীনতা আনা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি বিদেশে পাড়ি জমান।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার জন্য যে সকল মহান ব্যক্তি, বিপ্লবী, লড়াকু যোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অহিংসায় নয়, উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রকে ধারণ করে যিনি আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। ভারত উপমহাদেশে সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংগঠক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে বিপ্লবী যোদ্ধারা তাঁকে নেতাজী বলে সম্বোধন করতেন। তিনি এ উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেরও অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বাস্তববাদি এবং আজন্ম আশাবাদী একজন মানুষ যে কারণে মোহনদাস গান্ধী, জওহরলাল নেহরুসহ অনেক অবাঙালি নেতার সঙ্গে তার মতের মিল ছিল না।
তিনি পরপর দুবার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধির সাথে রাজনৈতিক মতাদর্শগত মতভেদের কারণে ও কংগ্রেসের অনাস্থার ফলে এই পদ থেকে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। নেতাজী বিশ্বাস করতেন, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি স্বাধীনতা আদায়ে জন্য যথেষ্ট নয়। তাই তিনি সশস্ত্র বিপ্লববাদী প্রতিরোধের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি অল-ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের অবসান ঘটানোর জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। এজন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারো বার কারারুদ্ধ করেছিল।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে ২৩ জনুয়ারি। উড়িষার কটক শহরে এক বাঙালি পরিবারে। তার জন্ম কলকাতায় হলেও তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রামে। নেতাজীর বাবা জানকীনাথ বসু। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশ ছেড়ে কটকে চলে যান। সেখানে তিনি অইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ পেশায় তিনি অল্পদিনের মধ্যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। তিনি জ্ঞানী ও সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সরকারি দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কটক মিউনিসিপ্যালিটি ও কটক জেলা বোর্ডের সভাপতির পদে ছিলেন। নেতাজীর মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। কলকাতার হাটখোলার প্রসিদ্ধ দত্ত বংশসম্ভূতা। নেতাজী ছিলেন পিতা-মাতার নবম সন্তান ও যষ্ঠ পুত্র।
১৯০২ সালে পাঁচ বৎসর বয়সের সময় সুভাষ বসু খ্রীষ্টান পাদ্রীদের পরিচালিত কটক প্রোটেষ্ট্যাণ্ট ইউরোপীয়ান স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি ৭ বছর পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এই স্কুলে বাঙলা ছাড়া অন্য সকল বিষয় পড়ানো হতো। ছেলেবেলা থেকে তিনি মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। এজন্য শিক্ষকগণ তাকে খুব পছন্দ করতেন এবং ভালবাসতেন
১৯০৮ সালে তিনি কটকের রাভ্যেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ফোর্থ ক্লাসে ভর্তি হন। এই স্কুলে পড়াশুনাকালে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা নিজ উদ্যোগে খুব ভাল করে শিখে নেন। পড়াশুনা করার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা করতেন।
এই সময় বেণীমাধব দাস নামক এক পণ্ডিত রাভ্যেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার সরল অমায়িক ব্যবহারে ছাত্ররা তাকে শ্রদ্ধ করত। এই শিক্ষকের প্রভাব সুভাষ চন্দ্রের উপর পড়ে। সুভাষ চন্দ্র আত্মজীবনীতে বলেছেন যে, প্রথম দর্শনেই তার প্রখর ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স বারোর কিছু বেশি হবে। এর আগে আর কাউকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করেছি বলে মনে পড়ে না। বেণীমাধব দাসকে দেখবার পর শ্রদ্ধা কাকে বলে মনে প্রাণে অনুভব করলাম। কেন যে তাঁকে দেখলে মনে শ্রদ্ধা জাগতো তা বোঝবার মত বয়স তখনো আমার হয়নি। শুধু বুঝতে পারতাম, তিনি সাধারণ শিক্ষকের পর্যায়ে পড়েন না। মনে মনে ভাবতাম, মানুষের মতো মানুষ হতে হলে তার আদর্শেই নিজেকে গড়তে হবে। মা প্রভাবতী দেবী এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষক বেণীমাধব দাসের নৈতিক আদর্শ তার পরবর্তীকালের জীবন কাঠামোটি সুন্দরভাবে তৈরী করে দেয়।
নেতাজীর বয়স যখন ১৩/১৪ বছর তখন তাদের এক আত্মীয় কটকে বেড়াতে আসেন। তিনি নেতাজীর বাড়ীর নিকটেই থাকতেন। নেতাজী একদিন তার সাথে দেখা করেন এবং তার ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের কতগুলি বই দেখতে পান। স্বামীজীর বইগুলা তিনি তার নিকট হতে এনে পাঠ করেন। এভাবে নেতাজী স্বামী বিবেকানন্দ ও তার গুরুদেব শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্বামীজীর বক্তৃতা ও চিঠিপত্রগুলি তাকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষ করে স্বামীজীর, বল ভারতবাসী-ভারতবাসী আমার ভাই, বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই-তুমিও একটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া স্বদর্পে ডাকিয়া বল ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার বার্দ্ধক্যের বারাণসী, আর বল দিনরাত হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে আমার কাপুরুষতা, দুর্বলতা দূর কর আমায় মানুষ কর প্রভৃতি কথাগুলি পড়ে তিনি যে আদর্শ খুঁজতেছিলেন, যেন ঠিক তা পেয়ে গেলেন।
এই সম্বন্ধে নেতাজী বলছেন, বিবেকানন্দের আদর্শকে যে সময়ে জীবনে গ্রহণ করলাম তখন আমার বয়স বছর পনেরও হবে কি না সন্দেহ। বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। চেহারায় এবং ব্যক্তিত্বে আমার কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ পুরুষ। তাঁর মধ্যে আমার মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম।
নেতাজী মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সকলেই আশা করেছিলেন যে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করবেন। কিন্তু পরীক্ষা নিকটবর্তী দেখেও তার পড়াশুনায় গাফিলতি দেখে সকলেই নিরুৎসাহী হয়ে গেলেন। সুভাষচন্দ্র তখন শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী জীব শিব এবং স্বামী বিবেকানন্দের বাণী সেবা ধর্মকেই তার জীবনের সার বলে গ্রহণ করেছেন। পড়াশুনা তার কাছে তুচ্ছ।
১৯১৩ সালে নেতাজী প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। সকলে তার রেজাল্ট দেখে অবাক হলেন। ভাল রেজাল্ট করার কারণে তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পান। এই বৃত্তির টাকা তিনি দীন দুঃখীর সেবায় দান করেন।
১৯১৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়াশুনাকালেও তিনি স্বামী বিবেকানন্দের ১৯১৫ সালে তিনি আই.এ পরীক্ষায় মেধাস্থান অর্জন করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ওই বছরই তিনি দর্শনে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে "অধ্যাপক ওটেন" বাঙালি ছাত্রদের প্রতি অপমানজনক ব্যবহার করায় তিনি তাঁর ওপর সাংঘাতিক বিক্ষিপ্ত হন এবং "অধ্যাপক ওটেন"কে প্রহার করেন। এই ঘটনার জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কার হন। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজ পরিত্যাগ করতে হয়। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ গভীরভাবে বিকশিত হতে থাকে।
অবশেষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের (স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষ) সহযোগিতায় তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে তিনি ডিস্টিংশনসহ দর্শন শাস্ত্রে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেন (১৯১৯ সাল) এবং ওই পরীক্ষায় কলেজে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯২০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এ-পরীক্ষা দেন এবং চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ওই বছর তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগ দেন। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান দেন। ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য তিনি তৎকালীন সময়ের সরকারি চাকুরি তিনি ত্যগ করেছিলেন। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আইন অমান্য আন্দোলনের অভিযোগে চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজীকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্র্রেফতার করে। ১৯২২ সালে মুক্তি পান।
গান্ধিজির সাথে সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না। গান্ধিজিকে ছেড়ে তিনি আসেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নিকট। তার সান্নিধ্য থেকে তিনি নিজেকে রাজনীতিতে আরো পরিপক্ক করে গড়ে তুলেন। এরপর থেকে নেতাজী স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন দাসের সাথে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯২৪ সালে এপ্রিল মাসে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন। চিত্তরঞ্জন দাস তখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। যদিও সুভাষ চন্দ্রের বেতন ছিল মাসে ৩০০০ টাকা, তিনি সিদ্ধান্ত নেন মাসে ১৫০০ টাকা বেতন নেওয়ার। ওই বছর অক্টোবর মাসে নেতাজীকে স্বদেশী বিপ্লবীদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ব্রিটিশরা তাকে বার্মার কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ১৯২৫-২৭ সাল পর্যন্ত তিনি মান্দালয়সহ বিভিন্ন কারাগারে ছিলেন। ১৯২৭ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯২৮ সালে তিনি কলকাতায় সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়েন। যার চরিত্র ছিল সামরিক।। "হিন্দুস্থান সেবক দল" নামে আরেকটি বাহিনী সেসময় তৈরী হয়েছিল। কিন্তু সে দলের সাথে এ দলের পার্থক্য হল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয় এ বাহিনী প্রতিটি সদস্যকে। পরবর্তী কালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ার ক্ষেত্রে নেতাজী এই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বাহিনী থেকে প্রেরণা পান। ১৯২৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে তিনি ও বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি একটি প্যরালাল সরকার গঠন করার প্রস্তাব করেন। এ ভাবে তিনি বিপ্লবীদের স্বজন হয়ে উঠেন।
১৯৩০ সালে ২৩ জানুয়ারি তিনি ব্রিটিশ আইনের বিরুদ্ধে এক পদযাত্রায় প্রধান ভূমিকা পালন করার জন্য তাকে আবার আটক করা হয়। ওই বছর জেল থেকে বেরিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতার মেয়র হিসাবে নিযুক্ত হন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের মহিরুহে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৩১ সালে নেতাজীর নেতৃত্বে কলকাতায় শোভাযাত্রা চলাকালে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে আবার গ্রফতার করে। এসময় তিনি ৬ মাস পর মুক্তি পান। মুক্তির পরও বিপ্লববাদী শসস্ত্র আন্দোলনের জন্য ব্রিটিশ সরকার নেতাজীকে তার বাড়িতেই নজর বন্দি করে রাখে। ১৯৩২ সালে তিনি আইন অমান্যে আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে ওই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি হয়ে উঠেন। এসময়ও তাকে আবার ব্রিটিশ সরকার কারাগারে প্রেরণ করে। কিন্তু জনতার আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বারবার কারা নির্যাতনের কারণে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন।
১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে ইউরোপে চলে জান। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি ইউরোপের বহু রাজনৈতিক নেতা ও মহান ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন। কারণ তিনি উপলব্দি করতেন, ভারতমাতাকে ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে স্বাধীন করতে হলে বাইরের দেশের সেনা ও রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা দরকার হবে। এ সময় তিনি সমগ্র ইউরোপ ঘুড়ে বেড়ান এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য তীব্র প্রচার চালান।
তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রাগে, বার্লিনে, মিলানে, মিউনিখে, সোফিয়া ও রোমে সভা সমাবেশ করেন। ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সংগ্রহ করেন এবং ভারতীয়দের সংগঠিত করেন। ১৯৩৬ সালের ৮ এপ্রিল দেশে আসার পর ব্রিটিশ সরকার তাকে আবার গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে নিখিল ভারত সুভাষ দিবস পালন করে। ১৯৩৭ তিনি মুক্তি পান। ওই বছর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এমিলিকে সহধর্মীনী করেন। ১৯৪২ সালে তাদের কন্যা সন্তান অনিতার জন্ম হয়। ১৯৩৮ সালে তাকে ভারতবাসী কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ড নির্বাচিত করে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষ চন্দ্র গান্ধীজীর অহিংস নীতির বিরোধিতা করে ইংরেজ সরকারকে ৬ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা প্রদানের জন্য এক চরমপত্র পাঠানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস সহিংস সংগ্রাম শুরু করার পক্ষে ছিলেন না। গান্ধীজী ওই বিপদের সময় ইংরেজ সরকারকে বিব্রত করতে চাননি। এ প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিলে সুভাষ বোস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামে আরেকটি দল গঠন করেন। কলকাতায় প্রবল জনমত সৃষ্টি করলে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে ১৯৪০ সালের ২ জুলাই নেতাজি কে গ্রেফতার করা হয় এবং কোলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তাকে আটকে রাখা হ্য়। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গৃহ বন্দি অবস্থায় পলায়ন করেন এবং তিনি আফগানিস্থানের পথে রাশিয়ার পথে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি ভারত স্বাধিনের জন্য সোভিয়েত শক্তির সমর্থন চান। কিন্তু স্টালিন বোসের আবেদন প্রতাক্ষাণ করেন।
সুভাষ বোস সরকারি গোয়েন্দা নজরদারি এড়ানোর জন্য মৌনব্রত ও নির্জনবাসের ঘোষণা দেন ও তার ভাতিজা অমিয় বোসের অনুমোদন ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করতেন না। ওই সুযোগে তিনি মৌলভী জিয়াউদ্দীনের মতো দাড়ি রাখেন ও তার মতোই পোশাক পরে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ পালিয়ে আফগানিস্তান ও মস্কো হয়ে জার্মানির বার্লিন পৌছেন। তিনি জার্মান থেকে সাবমেরিনযোগে জাপান পৌছেন। সেখানে বার্মা ফ্রন্টের ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে এর সর্বাধিনায়ক হন।
১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার ফরওয়ার্ড ব্লক দলকে বেআইনি ঘোষণা করে। সমগ্র ভারত যুড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক দলের সব পার্টি অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৩ সালে নেতাজি জাপানে যান।
১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু দাঁড়িয়ে সভায় একজন চমৎকার নতুন অতিথি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেইসঙ্গে লীগের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নিজের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি সকলকে অবহিত করেন যে, ইতিমধ্যে টোকিওতে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং তিনি দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে বর্তমান পদ তাঁর পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান। এই কথা বলার পর সভার সকল নেতৃবৃন্দ এবং সদস্য প্রাণবন্ত করতালি দিয়ে সুভাষ বসুকে স্বাগত জানায়। প্রবাসে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বমান্য সম্মানিত পরিচালক নির্বাচিত হওয়ার কারণে রাসবিহারী বসু তখন তাঁকে ‘নেতাজি’ উপাধি ঘোষণা করেন। নেতাজি রাসবিহারী বসুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুঘন্টাব্যাপী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
এ সম্মেলনে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। বস্তুত ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনে রাসবিহারি বসুর অবদান অপরিসীম। পরে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত হন। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হলে সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন রাসবিহারি বসু।
১৯৪৪ সালের ২১ মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপি ছড়িয় পড়ে। তখন রাসবিহারি বসু খুবই আনন্দিত হন। কিন্তু ১৯৪৫ সালের শুরুতে জাপান আজাদ হিন্দ ফৌজ-কে যে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা প্রত্যাখান করে নেয়।
সুভাষ চন্দ্র বোস আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আই.এন.এর হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যাক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আই.এন.এতে যোগ দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হল না। বরং যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথে জাপান তার সৈন্যদের আই.এন.এ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। এবং জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পন এর সাথে সাথে আই.এন.এ ও আত্মসমর্পন করে।
ধারণা করা হয়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ১৯৪৫ সালের ১৯ আগষ্ট টোকিও যাবার পথে, তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তবে তার মৃত্যুর সঠিক তারিখ ও স্থান সম্পর্কে এখনো বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তাঁর দেহাবশেষ কোনোদিনও উদ্ধার করা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক' আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।" আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাঁকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: "নেতাজি ভবন" (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও "নেতাজি" (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া, বিপ্লবিদের কথা
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।