মুত্রপায়ীর বিজয়! আর না, আর না
প্রায় ২০ বছর আগের কথা। প্রতিবেশী অতুলদা এসএসসিতে ফেল করার পর তার কঠিন অবস্থা।বাবা বাড়িতে যায়গা দিচ্ছেনা। মা লুকিয়ে ভাত দেয়; বাবা দেখলেই পেন্টি (হালের বলদকে পেটানোর জন্য বাসের কঞ্চি দিয়ে বানানো ছড়ি) নিয়ে ধাওয়া করে। গোপনে বাড়ি আসে, গোপনে বেরিয়ে যায়। এসময় ডিসি অফিসের এক কর্মকর্তাকে ধর্মবাবা বানিয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় পায় অতুল।
সেই অতুলের বিয়ের আলোচনা হচ্ছে। সে এখন সুপাত্র। বেশ কয়েকবছর ম্যাজিষ্ট্রেটের উমেদারী করার পর ডিসি অফিসে পিয়নের চাকরি হয়েছে। বাবার সাথেও মিমাংসা হয়ে গেছে। সরকারী চাকুরেকে মেয়ে দেয়ার জন্য অনেক পিতাই ঘটক পাঠাচ্ছেন। আমি তখন এলাকায় নেতাগীরি করি। চাকরী বাকরী করিনা। একটা সামাজিক অবস্থান থাকলেও সুপাত্র হিসেবে কোনও মেয়ের বাবা আমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন বলে মনে পড়েনা।
পাত্রপক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অতুলদার বিয়ের আলোচনায় আমার ডাক পড়ল। পাত্রীপক্ষের একজন জানতে চাইল, ছেলে কত বেতন পায়। সে সময় অতুলদার বেতন কত ছিল আমার ঠিক মনে নেই। ১২ থেকে ১৪শ’ মত হবে। তবে ছেলের বাবা সগর্বে যে কথা বললেন তা শুনে চমকে উঠলাম। ভরা আসরে তিনি বলে দিলেন, “বেতন যাই হোক, উপরি ইনকাম ভাল।” এটা শুনে পাত্রপক্ষের একজন হিসেবে আমি যখন মুখ লুকানোর যায়গা খুজছি, উভয়পক্ষ তখন পাত্রের এই অতিরিক্ত যোগ্যতার প্রশংসায় গদগদ।
অতুলের বাবাসহ চৌদ্দ পুরুষের সবাই কৃষিজীবি। তারা মাটি খুরে ফসল ফলিয়েছেন। ঘুষ-দুর্ণীতি করার প্রশ্নই ওঠেনা। যে বাবা নিজে কখনও ঘুষ খাননি, সেই বাবা বিয়ের আলোচনায় ছেলের দুর্ণীতির কথা সগর্বে প্রকাশ করলেন। এতে পাত্রের কদর বাড়ল বই কমলনা। আমি প্রথম বুঝলাম, ঘুষের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আছে।
বাংলাদেশ যেবার দ্বিতীয়বারের মত দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হল তখন টিআইবি’র মধ্যমণি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। রিপোর্ট প্রকাশের পর তোপের মুখে পরেছিল টিআইবি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, টিআইবি ভূল রিপোর্ট দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ দুর্ণীতি ভালবাসে। সরকারের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সর্বোত্র দুর্ণীতি। প্রেস কনফারেন্সের পর প্রেসক্লাবের ব্যালকনীতে মোজাফ্ফর স্যারের সাথে আমার কথা হচ্ছিল। তাকে উপরের কাহিনীটা বলেছিলাম। শোনার পর তিনি বলেছিলেন, “আমাদের সময় দারোগার ছেলের সাথে মানুষ মেয়ে বিয়ে দিতে চাইতনা। এখন উল্টো।”
এটাও তখনকার কথা। রংপুরের ডিসি অফিসে একটা কাজের জন্য গিয়েছিলাম। যার কাছে কাজ, তিনি তখন নামাজ পড়ছেন। নামাজরত দেখে আমরা পেছনে সোফায় বসলাম। নামাজ শেষে তিনি জায়নামাজ গোটাচ্ছেন আর আমাদের বলছেন, “টাকাটা এনেছেন?” আগের দিন আমার সঙ্গি ভদ্রলোকের সাথে তার একটা চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির টাকা। কে বলবে আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ নয়? কি হিন্দু, কি মুসলমান -ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায় সবাই সহী।
আচ্ছা, যে দেশের মানুষ ধর্ম নিয়ে বেশী মাথা ঘামায় না তারা কেমন? তারাও কি এরকম দুর্ণীতি প্রবণ? ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ সম্পর্কে দূর থেকে যা জেনেছি তাতে তারা ঘোর বিধর্মী। মানুষের স্বাধীনতার মূল্য সেখানে অনেক বেশী। রাষ্ট্রের কাছেও বেশী, সমাজের কাছেও বেশী। ধর্ম, রাষ্ট্র বা সমাজ কোনও কিছুই ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বাধা দিতে পারেনা। যৌন সিদ্ধান্তের প্রশ্নেও ব্যক্তি সেখানে স্বাধীন। রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যক্তির পছন্দে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেনা -যতক্ষণ তাদের কাজ অন্যের স্বাধীনতায় বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। আমাদের ধর্মীয় রাষ্ট্রেও যৌন সিদ্ধান্তের প্রশ্নে ব্যক্তিমানুষ যথেষ্ট বিপ্লবী। এরা গোপন বিপ্লবী; প্রকাশ্যে নয়। ধর্ম-রাষ্ট্র-সমাজবিধি, গোপনে সবকিছুই লংঘন করে। কি গ্রাম, কি শহর - সর্বোত্র গোপন যৌনতা। আমি বিবাহ বহির্ভুত যৌনতার কথাই বলছি। প্রকাশ্যে সবাই এসবের সমালোচক। অথচ শিক্ষিত বা মুর্খ অধিকাংশ মানুষ যৌন বিকৃতির রোগী। বিকৃত যৌনবৃত্তির মুক্ত প্রকাশ তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, কথোপকথনে ও আচরণে। ধার্মিক মানুষের মুক্তবুদ্ধি চর্চার সর্বোচ্চ প্রকাশ ফেসবুকে অশ্লীল গালাগালির মধ্যেই দৃশ্যমান। ইভ টিজিং ও ইস ঠিস ছেলে/বুড়া সবাই করে। এরা সবাই ধার্মিক ও দুর্ণীতিগ্রস্ত।
আপনার ১০ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোনটি হারিয়ে গেছে? ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ফিফটি ফিফটি? মোটেই না। ৯০ পার্সেন্ট সম্ভাবনা হল, আপনি মোবাইলটি আর ফিরে পাবেন না। ১০ পার্সেন্ট ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যিনি মোবাইলটি কুরিয়ে পেয়েছেন তিনি ইচ্ছা করলেই তা আপনার কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু করবেননা। মানুষের মধ্যে চৌর্যবৃত্তি অত্যন্ত প্রবল। যে সমাজের অধিকাংশ মানুষের মনোজগতে এক একটি চোর বাস করে, সেই দেশ দুর্ণীতিতে দুই নম্বর হবে কেন?
বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। এ পরিমাণ অর্থ সাম্প্রতিক সময়ের দুটি জাতীয় বাজেটের আকারের সমান। দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে তারচেয়ে দ্বিগুণ অর্থ দেশ থেকে পাচার হচ্ছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক যুগে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ১৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৯০৩ কোটি ডলার বা ৭২ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ এফডিআই দেশে এসেছে তার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১২টি ব্যাংকের মাধ্যমে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে তিনগুণ হলে মানুষ বুঝে নেয়, দুর্ণীতি হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদী হয় না। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়ার সংবাদ অল্প কিছু মানুষকে উৎকন্ঠিত করে। কিছু মানুষ প্রতিবাদ করে। অধিকাংশ মানুষ দুর্ণীতি করার সুযোগ না পেয়ে হাহুতাশ করে।
দেশে এখনও কিছু পরিক্ষিত মানুষ আছে -যারা দুর্ণীতি করে নাই, করে না। প্রলোভনকে পায়ে দলেছেন - এরকম শক্ত চরিত্রের মানুষও আছেন। ক্ষমতার লোভ, মন্ত্রীত্বের লোভ - কোনও কিছুই যাদের চরিত্রকে বিকৃতির পথে টানতে পারেনি এমন মানুষ দেখেছি। দুর্ভাগ্যের যে, এসব বলিষ্ঠ চরিত্রের মানুষকেও মানুষ শ্রদ্ধা করতে ভূলে গেছে। আপন অসততা, বিকৃতি ও সুবিধাবাদকে যায়েজ করার জন্য মহৎ ব্যক্তিদেরও খাটো করা হয়। যে দুর্নীতি করে না, কিংবা দুর্ণীতি করার চরিত্র বৈশিষ্ট যার মধ্যে নেই তার সম্পর্কে বলা হয়, “দুর্ণীতি করার সুযোগ পায়নি বলেই করেনি।” বলা হয়, “দুণীতি করতেও যোগ্যতা লাগে।” বলা হয়, “ঘুষ খায়না! কত টাকা খায়না?” যারা দুর্ণীতি করতে পারেনা তারা আজ সমাজের কাছে ব্যর্থ মানুষ।
৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুরে আওয়ামীলীগসহ ১৫-দলের প্রার্থী ছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা মোহাম্মদ আফজাল। দীর্ঘ কয়েক দশক যাবৎ তিনি রংপুরের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন। রংপুর পৌরসভায় তিনি একাধিকবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সৎ ও নীতিবান মানুষ হিসেবে তিনি সর্বজনবিদীত। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে এক বিশাল নির্বাচনী জনসভায় তিনি বক্তৃতা করছিলেন। বক্তৃতার মধ্যে কোনও একজন মওলানার একটি ফতোয়া উদ্ধৃত করে তিনি বললেন, “এক টাকা ঘুষ খাওয়া, সত্তুরটা উঠের পোশ্রাব খাওয়ার সমান।” এবং তিনবার বললেন, “যে শালা ঘুষ খায়, সে শালা মুত খায়; যে শালা ঘুষ খায়, সে শালা মুত খায়; যে শালা ঘুষ খায়, সে শালা মুত খায়।” স্পষ্টত: তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী পতিত স্বৈরশাসক হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের প্রতি ঈঙ্গিত করে কথাগুলো বলছিলেন। কিন্তু দেখা গেল মাঠে উপস্থিত অনেকেরই মুখাবয়ব লাল হয়ে গেছে। কাসেম ভাই (গণতন্ত্রী পার্টির একজন নিবেদিত কর্মী) আর আমি জনসভার পিছন দিকে দাঁড়িয়ে আফজাল ভাইয়ের বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলে উঠলেন, “আফজাল সাব আজ বহু মানুষকে মুত খাওয়ায়া ছাড়লরে। এরা কেউ ভোট দেবেনা। এই ভোটে হারতে হবে।”
কাশেম ভাইয়ের কথা সত্য হয়েছিল। মানুষের জন্য সর্বত্যাগী, মহত্ত ও সততার জীবন্ত দৃষ্টান্ত, সংগ্রামী নেতা মোহাম্মদ আফজাল মানুষের ভোটে হেরেছিলেন। অনেক ঘুষ-দুণীতি মামলায় অভিযু্ক্ত এরশাদ জয়ী হয়েছিলেন। শুধু ঐ বক্তব্যের কারণেই আফজাল ভাই হেরেছেন -এটা হয়তো সঠিক নয়। বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতিবাজকে গ্রহণ করে, একথাও মিথ্যা নয়।
তবুও আশাবাদ দিয়ে শেষ করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।” মানুষের উপর বিশ্বাস রাখছি। বিশ্বাস রাখার কারণও আছে। বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে গেলে দুর্ণীতি করেনা। কষ্টের শ্রম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। প্রবাসে বাঙালিরা দুর্ণীতি করলে বাংলাদেশ থেকে কোনও দেশই শ্রমিক নিতে রাজী হতনা। বাংলাদেশে দুর্ণীতিটাই সিস্টেম হয়ে গেছে বলেই হয়তো মানুষ দুর্ণীতি করে। এই সিস্টেম ভাঙতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে। আবারও গণজাগরণ হবে; শাহবাগ হবে। সেটা হবে দুর্ণীতির বিরুদ্ধে। বাঙালীর অসমাপ্ত লড়াই দুর্ণীতি ও দুর্ণীতিবাজের বিরুদ্ধে। সে লড়াইয়ে মানুষ জয়ী হবে। প্রচলিত মূল্যবোধ ভেঙ্গে একটি দুর্ণীতি বিরোধী মূল্যবোধ গড়ে উঠবে। জয় মানুষ।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।