- হোম
- >
- আইন-মানবাধিকার
- >
- সাঈদীর আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
সাঈদীর আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫
প্রিন্টঅঅ-অ+
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে ৬১৪ পৃষ্ঠার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে।
এর আগে রায়ে স্বাক্ষর করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনসহ আপিল মামলার রায় প্রদানকারী পাঁচ বিচারপতি। অন্য ৪ বিচারপতি হচ্ছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সংক্ষিপ্তাকারে সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত এ রায় দেন আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর মৃত্যুদণ্ডাদেশের সাজা কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১শ’ থেকে ১শ’৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার মত ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিলো ট্রাইব্যুনালে।
এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দু’টি অপরাধে অর্থাৎ ৮ ও ১০নং অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত অন্য ৬টি অর্থাৎ ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগে আলাদাভাবে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল।
আর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৫টি অভিযোগ। এর মধ্যে ২টিতে অর্থাৎ ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে আমৃত্যু, একটিতে অর্থাৎ ১০ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন, একটিতে অর্থাৎ ৮ নম্বর অভিযোগে ১২ বছর ও একটিতে অর্থাৎ ৭ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে সাঈদীকে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সর্বোচ্চ সাজা পুনর্বহালের আরজিতে রিভিউ আবেদন জানাবেন বলে জানিয়ে রেখেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
সাঈদীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
প্রথম অভিযোগ- ১৯৭১ সালের ৪ মে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নেতৃত্বাধীন দলের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়ে পিরোজপুর সদর এলাকার মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে নিয়ে যান। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে জড়ো করা ২০ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ-৪ মে ১৯৭১ সালে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী লুট করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গুলি করে ১৩ জনকে হত্যা করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগ-৪ মে একাত্তর সালে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে মাসিমপুরের হিন্দুপাড়ায় মনীন্দ্রনাথ মিস্ত্রি ও সুরেশ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি লুট করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।
চতুর্থ অভিযোগ-৪ মে সাঈদী ও তার রাজাকার বাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ধোপাবাড়ির সামনে এবং পিরোজপুর সদর পুলিশ স্টেশনের এলজিইডি ভবনের পেছনের হিন্দুপাড়ায় দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারি ও মুকুন্দ বালা নামে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ।
পঞ্চম অভিযোগ-সাঈদীর উপস্থিতিতে তার সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য মন্নাফসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্য ১৯৭১ সালের ৫ মে পিরোজপুর হাসপাতাল থেকে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে বলেশ্বর নদীতে ফেলে দেয়।
ষষ্ঠ অভিযোগ-১৯৭১ সালের ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিয়ে পারেরহাট বাজারের আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায়সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বাড়িঘর ও দোকানে লুটপাট করে। এ সময় মাখন লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রুপা লুট করা হয়।
সপ্তম অভিযোগ-একাত্তর সালের ৮ মে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খান ও শহীদুল ইসলামকে ধরিয়ে দেয়া এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অষ্টম অভিযোগ-৮ মে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা চিথলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়ি লুট এবং ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা।
নবম অভিযোগ-১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল ৯টায় সাঈদী ও তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানির নলবুনিয়া গ্রামের আবদুল হালিম বাবুলের বাড়ির মূল্যবান জিনিস লুট এবং অগ্নিসংযোগ করে।
দশম অভিযোগ-একাত্তর সালের ২ জুন সকাল ১০টায় সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন দেয়া এবং সাঈদীর ইন্ধনে বিশা বালী নামে একজনকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা।
এগারোতম অভিযোগ-এ মামলার বাদী মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে আগুন দেয়া এবং তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে নির্যাতন।
১২তম অভিযোগ-সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র দল পারেরহাট বাজারের ১৪ জন হিন্দুকে ধরে নিয়ে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
১৩তম অভিযোগ-যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন মাস পর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে নির্যাতন করা হয় এবং সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।
১৪তম অভিযোগ-মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় যায়। সেখানে মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকাররা ধর্ষণ করে।
১৫তম অভিযোগ-মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের ১০ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
১৬তম অভিযোগ-সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা রানীকে ধরে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
১৭তম অভিযোগ-সাঈদী ও তার নেতৃত্বের রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পারেরহাটের বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে তার বাড়িতে আটকে নিয়মিত ধর্ষণ করেন।
১৮তম অভিযোগ-ভাগীরথী নামে একজন নারীকে নির্যাতন করে হত্যা।
১৯তম অভিযোগ-সাঈদীর বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ। পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ জন হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে নামাজ পড়তে বাধ্য করা।
২০তম অভিযোগ-নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সাঈদী সংবাদ পান যে, হাজার খানেক মানুষ জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো একদিন সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে হামলা করে ৮৫ ব্যক্তিকে আটক করেন, সেখানে ব্যাপক লুটপাট চালায়। পরে আটকদের নিয়ে আসা হয় স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে। সেখান থেকে ফজলুল হক নামে এক রাজাকারের মধ্যস্থতায় ঘুষের বিনিময়ে ১০-১২ জন ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে আটক পুরুষদের নির্যাতন এবং খগেন্দ্রনাথ সাহার মেয়ে দীপালি, স্ত্রী নিভারাণী, রাজবল্লভ সাহার মেয়ে মায়ারানীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়, যারা ক্যাম্পে ধর্ষণের শিকার হন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।