- হোম
- >
- ধর্ম ও জীবন
- >
- শুভ বড়দিন
শুভ বড়দিন
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫
প্রিন্টঅঅ-অ+
বড়দিন একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা জানা যায় না। আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু। সম্ভবত, এই হিসাব অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ ধরা হয়। অন্যমতে একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব অথবা উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসের অনুষঙ্গেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মজয়ন্তী পালনের প্রথাটির সূত্রপাত হয়।বড়দিন বড়দিনের ছুটির কেন্দ্রীয় দিন এবং খ্রিষ্টধর্মে বারো দিনব্যাপী খ্রিষ্টমাসটাইড অনুষ্ঠানের সূচনাদিবস।
প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে বড়দিন উৎসব পালন করে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসবের আয়োজনে প্রাক-খ্রিষ্টীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ভাবনার সমাবেশও দেখা যায়। উপহার প্রদান, সংগীত, খ্রিষ্টমাস কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ, এবং খ্রিষ্টমাস বৃক্ষ, আলোকসজ্জা, মালা, মিসলটো, যিশুর জন্মদৃশ্য, এবং হলি সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদযাপনের অঙ্গ। কোনো কোনো দেশে ফাদার খ্রিষ্টমাস (উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডে সান্টাক্লজ) কর্তৃক ছোটোদের জন্য বড়দিনে উপহার আনার উপকথাটি বেশ জনপ্রিয়।
উপহার প্রদানের রীতিটি সহ বড়দিন উৎসবের নানা অনুষঙ্গ খ্রিষ্টান ও অ-খ্রিষ্টানদের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসব উপলক্ষ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ মরসুম চলে। বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে দেখে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশে বড়দিন একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
ব্যুৎপত্তি
ইংরেজি খ্রিস্টমাস (Christmas) শব্দটি "খ্রিস্টের মাস (উৎসব)" শব্দবন্ধটির যুগ্ম অর্থ থেকে উৎসারিত। শব্দটির ব্যুৎপত্তি ঘটে মধ্য ইংরেজি Christemasse ও আদি ইংরেজি Cristes mæsse শব্দ থেকে। শেষোক্ত শব্দটির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৩৮ সালের একটি রচনায়। "Cristes" শব্দটি আবার গ্রিক Christos এবং "mæsse" শব্দটি লাতিন missa (পবিত্র উৎসব) শব্দ থেকে উদগত। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Χ (চি) হল Christ বা খ্রিষ্ট শব্দের প্রথম অক্ষর। এই অক্ষরটি লাতিন অক্ষর X-এর সমরূপ। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তাই এই অক্ষরটি খ্রিষ্ট শব্দের নামসংক্ষেপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়।এই কারণে খ্রিষ্টমাসের নামসংক্ষেপ হিসেবে এক্সমাস কথাটি চালু হয়।
বাংলা অভিধানে যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব খ্রিষ্টমাস উৎসবটিকে বাংলায় বড়দিন আখ্যা দেওয়ার কারণটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে: "২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড়ো এবং রাত ছোটো হতে আরম্ভ করে"।
উদযাপন
বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই বড়দিন একটি প্রধান উৎসব তথা সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এমনকি অ-খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশেও মহাসমারোহে বড়দিন উদযাপিত হতে দেখা যায়। কয়েকটি অ-খ্রিষ্টান দেশে পূর্বতন ঔপনিবেশিক শাসনকালে বড়দিন উদযাপনের সূত্রপাত ঘটেছিল। অন্যান্য দেশগুলিতে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান জনসাধারণ অথবা বৈদেশিক সংস্কৃতির প্রভাবে বড়দিন উদযাপন শুরু হয়। তবে চীন (হংকং ও ম্যাকাও বাদে), জাপান, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, ইরান, তুরস্ক ও উত্তর কোরিয়ার মতো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশে বড়দিন সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় না।
অধিকাংশ দেশে প্রতি বছর বড়দিন পালিত হয় ২৫ ডিসেম্বর তারিখে। তবে রাশিয়া, জর্জিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়ার মতো কয়েকটি ইস্টার্ন ন্যাশানাল চার্চ ৭ জানুয়ারি তারিখে বড়দিন পালন করে থাকে। কারণ এই সকল চার্চ ঐতিহ্যশালী জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকে; জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ২৫ ডিসেম্বর প্রামাণ্য জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের ৭ জানুয়ারি তারিখে পড়ে।
সারা বিশ্বে, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐতিহ্যগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বড়দিন উৎসব উদযাপনের রূপটিও ভিন্ন হয়ে থাকে। জাপান ও কোরিয়ার মতো দেশে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে কম হলেও বড়দিন একটি জনপ্রিয় উৎসব। এই সব দেশে উপহার প্রদান, সাজসজ্জা, ও খ্রিষ্টমাস বৃক্ষের মতো বড়দিনের ধর্মনিরপেক্ষ দিকগুলি গৃহীত হয়েছে।
যিশুর জন্মোৎসব
খ্রিষ্টধর্মে খ্রিষ্টমাস বা বড়দিন হল যিশুর জন্মোৎসব। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি বাইবেলর ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত একাধিক ভবিষ্যদবাণীতে বলা হয়েছে যে কুমারী মেরির গর্ভে তাঁদের মসিহা বা ত্রাণকর্তার জন্ম হবে। নূতন নিয়ম বা নূতন বাইবেলের মথিলিখিত সুসমাচার (মথি ১: ১৮ – ২: ১২) এবং লূকলিখিত সুসমাচার (লূক ১: ২৬ – ২: ৪০)-এ বর্ণিত যিশুর জন্মকাহিনী খ্রিষ্টমাস উৎসবের মূলভিত্তি। এই উপাখ্যান অনুসারে, স্বামী জোসেফের সাহচর্যে বেথলেহেম শহরে উপস্থিত হয়ে মেরি যিশুর জন্ম দেন। জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী, একটি আস্তাবলে গবাদি পশু পরিবৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যিশু। যদিও বাইবেলের উপাখ্যানে আস্তাবল বা গবাদি পশুর কোনো উল্লেখই নেই।শুভ বড়দিন যদিও লূকলিখিত সুসমাচারে (লূক ২: ৭) একটি যাবপাত্রের উল্লেখ আছে: "আর তিনি আপনার প্রথমজাত পুত্র প্রসব করিলেন, এবং তাঁহাকে কাপড়ে জড়াইয়া যাবপাত্রে শোয়াইয়া রাখিলেন, কারণ পান্থশালায় তাঁহাদের জন্য স্থান ছিল না।" যিশুর জন্ম-সংক্রান্ত প্রথম দিকের চিত্রগুলিতে গবাদি পশু ও যাবপাত্র পরিবৃত একটি গুহায় যিশুর জন্মদৃশ্য দর্শানো হয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এটি বেথলেহেমের চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির অভ্যন্তরে। এক স্বর্গদূত বেথলেহেমের চারিপার্শ্বস্থ মাঠের মেষপালকদের যিশুর জন্ম সম্বন্ধে অবহিত করেন। এই কারণে তাঁরাই সেই দিব্য শিশুকে প্রথম দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
অনেক খ্রিষ্টানই মনে করেন, যিশুর জন্ম আদি বাইবেলের ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত ভবিষ্যদবাণীগুলিকে পূর্ণতা দেয়। মথিলিখিত সুসমাচার অনুসারে, কয়েকজন ম্যাজাই (জ্যোতিষী) স্বর্ণ, গন্ধতৈল ও ধূপ নিয়ে শিশুটিকে দর্শন করতে যান। কথিত আছে, একটি রহস্যময় তারা তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সাধারণভাবে বেথলেহেমের তারা নামে পরিচিত এই তারাটি ছিল প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে ইহুদিদের রাজার জন্মবার্তার ঘোষক। ম্যাজাইদের আগমনের স্মরণে পালিত হয় ৬ জানুয়ারির এপিফেনি উৎসব। কোনো কোনো চার্চে এই ৬ জানুয়ারিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে বড়দিন উৎসব সমাপ্ত হয়।
খ্রিষ্টানরা নানাভাবে বড়দিন উদযাপন করে থাকে। এগুলির মধ্যে বর্তমানে গির্জার উপাসনায় যোগ দেওয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম জনপ্রিয় প্রথা বলে বিবেচিত হয়। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি ও জনপ্রিয় রীতিনীতি। বড়দিনের পূর্বে যিশুর জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ নেটিভিটি উপবাস পালন করে থাকে; অন্যদিকে পাশ্চাত্য খ্রিষ্টধর্মে অধিকাংশ চার্চে অ্যাডভেন্ট পালন করা হয়। বড়দিনের সর্বশেষ প্রস্তুতিটি নেওয়া হয় খ্রিষ্টমাস পূর্বসন্ধ্যায়।
বড়দিন উৎসব পর্বের অন্যতম অঙ্গ হল গৃহসজ্জা ও উপহার আদানপ্রদান। কোনো কোনো খ্রিষ্টীয় শাখাসম্প্রদায়ে ছোটো ছেলেমেয়েদের দ্বারা খ্রিষ্টের জন্মসংক্রান্ত নাটক অভিনয় এবং ক্যারোল গাওয়ার প্রথা বিদ্যমান। আবার খ্রিষ্টানদের কেউ কেউ তাঁদের গৃহে পুতুল সাজিয়ে খ্রিষ্টের জন্মদৃশ্যের ছোটো প্রদর্শনী করে থাকেন। এই দৃশ্যকে নেটিভিটি দৃশ্য বা ক্রিব বলে। এই ধরনের প্রদর্শনী উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও লাইভ নেটিভিটি দৃশ্য ও ট্যাবলো ভাইভ্যান্টও অনুষ্ঠিত হয়; এই জাতীয় অনুষ্ঠানে অভিনেতা ও জন্তুজানোয়ারের সাহায্যে যিশুর জন্মদৃশ্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়।
চিত্রশিল্পে যিশুর জন্মদৃশ্য ফুটিয়ে তোলার ঐতিহ্যটি সুদীর্ঘ। এই সকল দৃশ্যে মেরি, জোসেফ, শিশু যিশু, স্বর্গদূত, মেষপালক এবং যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের তারার সাহায্যে পথ চিনে তাঁকে দর্শন করতে আসা বালথাজার, মেলকোয়ার ও ক্যাসপার নামক তিন জ্ঞানী ব্যক্তির চিত্র অঙ্কন করা হয়।
বিভিন্ন সংস্কার
যে সকল দেশে খ্রিষ্টান সংস্কার প্রবল, সেখানে দেশজ আঞ্চলিক ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিলনের ফলে বড়দিন উদযাপনে নানা বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। অনেক খ্রিষ্টানের কাছে ধর্মীয় উপাসনায় অংশ নেওয়া এই উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। উল্লেখ্য, বড়দিন ও ইস্টারের মরসুমেই গির্জায় জনসমাগম হয় সর্বাধিক।
অনেক ক্যাথলিক দেশে খ্রিষ্টমাসের পূর্বদিন ধর্মীয় শোভাযাত্রা বা কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়।
অন্যান্য দেশে সান্টাক্লজ ও অন্যান্য মরসুমি চরিত্রদের নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই মরসুমের অন্যতম বহুলপ্রচলিত বৈশিষ্ট্য হল পারিবারিক সম্মেলন ও উপহার আদানপ্রদান। অধিকাংশ দেশেই বড়দিন উপলক্ষ্যে উপহার আদানপ্রদান হয়; আবার কোনো কোনো দেশে এই প্রথাটির জন্য বেছে নেওয়া হয় ৬ ডিসেম্বরের সেন্ট নিকোলাস ডে বা ৬ জানুয়ারির এপিফেনির দিনগুলি।
সঙ্গীত ও ক্যারোল
প্রাচীনতম যে বিশেষ খ্রিষ্টমাস স্তোত্রবন্দনাগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর রোমে। মিলানের আর্কবিশপ অ্যামব্রোস রচিত Veni redemptor gentium ইত্যাদি লাতিন স্তোত্রগুলি এরিয়ানিজম বিরোধী যিশুর অবতারবাদের ধর্মীয় তত্ত্বকথার পবিত্র ভাষ্য। স্প্যানিশ কবি প্রুডেন্টিয়াস (মৃত্যু ৪১৩ খ্রি.) রচিত Corde natus ex Parentis (Of the Father's love begotten) স্তোত্রটি আজও কোনো কোনো গির্জায় গীত হয়।
নবম ও দশম শতাব্দীতে উত্তর ইউরোপের খ্রিষ্টীয় মঠগুলিতে বার্নার্ড অফ ক্লেয়ারভক্স কর্তৃক ছন্দায়িত স্তবকে সজ্জিত হয়ে খ্রিষ্টমাস "সিকোয়েন্স" বা "প্রোজ" প্রচলিত হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে পেরিসিয়ান সন্ন্যাসী অ্যাডাম অফ সেন্ট ভিক্টর জনপ্রিয় গানগুলি থেকে সুর আহরণ করে প্রথাগত খ্রিষ্টমাস ক্যারোলের মতো এক প্রকার সঙ্গীত সৃষ্টি করেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স, জার্মানি, এবং বিশেষ করে ফ্রান্সিস অফ আসিসির প্রভাবাধীন ইতালিতে আঞ্চলিক ভাষায় জনপ্রিয় খ্রিষ্টমাস সঙ্গীতের একটি শক্তিশালী প্রথা গড়ে ওঠে। ইংরেজি ভাষায় প্রথম খ্রিষ্টমাস ক্যারোল পাওয়া যায় শ্রপশায়ারের চ্যাপলেইন জন অডেলের রচনায়। তাঁর তালিকাভুক্ত পঁচিশটি "ক্যারোলস অফ ক্রিসমাস" ওয়েসেলারদের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে গেয়ে শোনাত। যে গানগুলিকে আমরা খ্রিষ্টমাস ক্যারোল বলে জানি, আসলে সেগুলি ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকসংগীত। বড়দিন ছাড়াও "হারভেস্ট টাইড" উৎসবেও সেগুলি গাওয়া হত। পরবর্তীকালে গির্জায় ক্যারোল গাওয়ার সূচনা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে ক্যারোল মধ্যযুগীয় কর্ড প্যাটার্নে সুরারোপিত হয়ে থাকে। এই কারণে এই গানগুলির সুর বেশ স্বতন্ত্র ধরনের হয়ে থাকে। "Personent hodie", "Good King Wenceslas", এবং "The Holly and the Ivy" ক্যারোলগুলি মধ্যযুগের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত। এখনও গীত হয় এমন প্রাচীনতম গানগুলির অন্যতম এগুলি। Adeste Fidelis (O Come all ye faithful) ক্যারোলটি তার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে; যদিও গানটির কথা সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রচনা।
উত্তর ইউরোপে প্রোটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলনের পর সাময়িকভাবে ক্যারোলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। যদিও মার্টিন লুথারের মতো কোনো কোনো সংস্কারক ক্যারোল রচনা করতেন এবং উপাসনায় ক্যারোল ব্যবহারকে উৎসাহিতও করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জনপ্রিয় সঙ্গীতের আকারে পুণরুজ্জীবনের পূর্বে ক্যারোল সাধারণ গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ সংস্কারক চার্লস উইজলি উপাসনায় সঙ্গীতের প্রয়োজনীতা অনুধাবন করেন। তিনি একাধিক সামে সুরারোপ করেছিলেন। এগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাজাগরণে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
এছাড়াও তিনি অন্তত তিনটি খ্রিষ্টমাস ক্যারোলের বাণী রচনা করেন। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ক্যারোলটির আদি শিরোনাম ছিল "Hark! How All the Welkin Rings"; বর্তমানে গানটির শিরোনাম "Hark! the Herald Angels Sing". ফেলিক্স মেন্ডেলসন উইজলির কথার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ একটি সুরও রচনা করেছিলেন। ১৮১৮ সালে অস্ট্রিয়ায় মোর ও গ্রুবার এই সংগীতধারায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ওবার্নডর্ফের সেন্ট নিকোলাস চার্চের জন্য তাঁরা রচনা করেছিলেন "Silent Night" ক্যারোলটি। উইলিয়াম বি. স্যান্ডিজ রচিত ক্রিসমাস ক্যারোল এনসিয়েন্ট অ্যান্ড মডার্ন (১৮৩৩) গ্রন্থে একাধিক নব্য-ধ্রুপদি ইংরেজি ক্যারোল প্রথম প্রকাশিত হয়। এগুলি ভিক্টোরিয়ান যুগের মধ্যভাগে উৎসবের পুনরুজ্জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ খ্রিষ্টমাস ঋতুসঙ্গীতের উদ্ভব ঘটে। ১৭৮৪ সালে রচিত হয় "ডেক দ্য হলস"। আমেরিকান "জিঙ্গল বেলস" গানটির মেধাসত্ত্ব ১৮৫৭ সালের। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকান আমেরিকানদের সংস্কৃতি ও ধর্মচেতনায় সমৃদ্ধ তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সঙ্গীত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিংশ শতাব্দীতে মরসুমি ছুটির দিনের গান বাণিজ্যিকভাবে গাওয়া হতে থাকে। এই জাতীয় গানগুলির মধ্যে জ্যাজ ও ব্লুজ জাতীয় গানের নানা রূপ পরিলক্ষিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সঙ্গীতের পুনরুজ্জীবনেও আগ্রহ দেখা যেতে থাকে। গাওয়া হতে থাকে দ্য রিভেলস-এর মতো লোকসঙ্গীত এবং আদি মধ্যযুগীয় ও ধ্রুপদি সংগীতও।
সান্টাক্লজ ও অন্যান্য উপহার প্রদানকারী
অনেক দেশেই বড়দিন বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উপহার আদান প্রদানের মরসুম। বড়দিন ও উপহার আদান প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক খ্রিষ্টীয় ও পৌরাণিক চরিত্রের উদ্ভবের সঙ্গেও বড়দিন উৎসব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এঁরা হলেন ফাদার খ্রিষ্টমাস বা সান্টাক্লজ, পেরে নোয়েল, ও ওয়েনাকসম্যান; সেন্ট নিকোলাস বা সিন্টারক্লাস; ক্রাইস্টকাইন্ড; ক্রিস ক্রিঙ্গল; জৌলুপুক্কি; বাব্বো নাতালে; সেন্ট বাসিল; এবং ফাদার ফরেস্ট।
শুভ বড়দিন
আধুনিককালে এই চরিত্রগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হল লাল পোষাক পরিহিত পৌরাণিক উপহার প্রদানকারী সান্টাক্লজ। সান্টাক্লজের উৎস একাধিক। সান্টাক্লজ নামটি ডাচ সিন্টারক্লাস নামের অপভ্রংশ; যার সাধারণ অর্থ সেন্ট নিকোলাস। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর নিকোলাস ছিলেন অধুনা তুরস্কের মিরার বিশপ। অন্যান্য সন্তসুলভ অবদানগুলির পাশাপাশি শিশুদের পরিচর্যা, দয়া ও উপহার প্রদানের জন্য তিনি খ্যাতনামা ছিলেন। অনেক দেশে তাঁর সম্মানে ৬ ডিসেম্বর উপহার আদানপ্রদানের মাধ্যমে উৎসব পালিত হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বিশপের পোষাক পরিহিত নিকোলাস তাঁর সহকারীদের সহায়তায় বিগত এক বছরে শিশুদের আচরণের খোঁজখবর নিতেন; তারপর স্থির করতেন সেই শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য কিনা। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সেন্ট নিকোলাসের নাম নেদারল্যান্ডে পরিচিতি লাভ করে এবং মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপে তাঁর নামে উপহার আদানপ্রদানের ঐতিহ্য চালু হয়ে যায়। সংস্কার আন্দোলনের সময় অনেক প্রোটেস্টান্ট উপহার প্রদানকারীর চিরাচরিত চরিত্রটি বর্জন করে শিশু খ্রিষ্ট (Christ Child) বা Christkindl (ইংরেজি অপভ্রংশে ক্রিস ক্রিঙ্গল) চরিত্রটির আমদানি করেন এবং উপহার প্রদানের তারিখটি ৬ ডিসেম্বর থেকে বদলে হয় খ্রিষ্টমাস পূর্বসন্ধ্যা।
যদিও সান্টাক্লজের আধুনিক রূপকল্পটির সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। এই রূপান্তরের পশ্চাতে ছয়জন মুখ্য অবদানকারী ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ওয়াশিংটন আরভিং এবং জার্মান-আমেরিকান কার্টুনিস্ট টমাস ন্যাস্ট (১৮৪০–১৯০২)। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর নিউ ইয়র্কের অধিবাসীরা শহরের অ-ইংরেজ অতীতের কিছু প্রতীক ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে নিউ ইয়র্ক শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ডাচ ঔপনিবেশিক শহর নিউ আমস্টারডাম নামে এবং ডাচ সিন্টারক্লাস ঐতিহ্যটি সেন্ট নিকোলাস নামে সেখানে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল।
১৮০৯ সালে নিউ ইয়র্ক হিস্টোরিকাল সোসাইটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিহাস স্মরণ করে Sancte Claus-কে নিউ ইয়র্ক শহরের ডাচ নাম নিউ আমস্টারডামের পৃষ্ঠপোষক সন্ত বা প্যাট্রন সেন্ট ঘোষণা করেন। ১৮১০ সালের প্রথম আমেরিকান উপস্থিতিতে সান্টাক্লজকে বিশপের আলখাল্লায় অঙ্কন করা হয়েছিল। যদিও নতুন শিল্পীরা তাঁর চিত্রাঙ্কনের ভার নিলে, সান্টাক্লজের পোষাকেও ধর্মনিরপেক্ষতার স্পর্শ লাগে। ১৮৬৩ সাল থেকে ন্যাস্ট প্রতি বছর সান্টাক্লজের ছবি আঁকতেন। ১৮৮০-এর দশকে ন্যাস্টের সান্টা তার আধুনিক রূপটি পরিগ্রহ করে। এই রূপটি সম্ভবত ইংরেজ ফাদার খ্রিষ্টমাসের আদলে আঁকা হয়েছিল। ১৯২০-এর দশকে বিজ্ঞাপননির্মাতাদের সৌজন্যে এই রূপটিই স্থায়িত্ব লাভ করে।
সান্টাক্লজ চরিত্রটির পূর্বসূরি ফাদার খ্রিষ্টমাস হাস্যরসিক, নাদুসনুদুস ও দাড়িওয়ালা ব্যক্তি। তিনি বড়দিনের শুভ চেতনার প্রতীক। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগের ইংল্যান্ডে ফাদার খ্রিষ্টমাসে লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য সে সময় ছেলেমেয়েদের উপহার প্রদানের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি সংযুক্ত ছিলেন বড়দিনের আমোদপ্রমোদ ও মাতলামির সঙ্গে। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে সান্টার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তাঁর চরিত্রটি পুনঃসৃজিত হয়। এই পথে ফ্রান্সে গড়ে ওঠে পেরে নোয়েল চরিত্রটিও। ইতালিতে সান্টাক্লজের ভূমিকাটি পালন করে বাব্বো নাতালে; এদেশে উপহার প্রদানকারী চরিত্রটি হলেন লে বাফানা। তিনি এপিফেনির পূর্বসন্ধ্যায় উপহার নিয়ে আসেন। কথিত আছে, লা বেফানা শিশু যিশুর জন্য উপহার আনতে বেরিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। এখন তিনি সব শিশুর জন্যই উপহার নিয়ে আসেন। কোনো কোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে সান্টাক্লজের সঙ্গী হলেন নেচ রুপরেক বা কালো পিটার। অন্যান্য গল্প অনুসারে, এলফেরা উপহার প্রস্তুত করে। সান্টাক্লজের স্ত্রীর নাম দেওয়া হয়েছে মিসেস ক্লজ।
সেন্ট নিকোলাসের সান্টায় রূপান্তরিত হওয়ার আমেরিকান কাহিনিটির কিছু বিরোধিতাও ধ্বনিত হতে শোনা যায়। দাবি করা হয় সেন্ট নিকোলাস সোসাইটি ১৮৩৫ সালের পূর্বে স্থাপিত হয়নি; যা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্তত পঞ্চাশ বছর পরের ঘটনা।সর্বোপরি, চার্লস জোনস কৃত নিউ আমস্টারডামের "শিশুসাহিত্য পুস্তক, সাময়িকপত্র ও পত্রিকা"র গবেষণায় সেন্ট নিকোলাস বা সিন্টারক্লাসের কোনো উল্লেখ নেই।যদিও ১৯৭৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত জোনসের গবেষণার প্রতি সকল বিশেষজ্ঞ আস্থা রাখেন না। নিউ ব্রানসউইক থিওলজিক্যাল সেমিনারির হাওয়ার্ড জি. হেজম্যান হাডসন ভ্যালির আদি বসতির সিন্টারক্লাস সংস্কৃতির আদলে নিউ ইয়র্কের সিন্টারক্লাস সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার মতো কিছু লাতিন আমেরিকান দেশের সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে, সান্টা খেলনা প্রস্তুত করে যিশুকে তা দেন; যিশুই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলেমেয়েদের সেই খেলনা উপহার দিয়ে যান। এই বিশ্বাস ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত সান্টা সংস্কৃতির এক মেলবন্ধনের প্রয়াস।
অল্টো আদিগে/সাদতিরোল (ইতালি), অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, দক্ষিণ জার্মানি, হাঙ্গেরি, লেচেনস্টেইন, স্লোভাকিয়া ও সুইজারল্যান্ডে ক্রাইস্টকাইন্ড (চেক ভাষায় Ježíšek, হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় Jézuska, স্লোভাক ভাষায় Ježiško) উপহার প্রদান করেন। জার্মান সেন্ট নিকোলাউস ও ওয়েনাকসম্যান চরিত্রদুটি এক নয়। ওয়েনাকসম্যান আধুনিক সান্টার জার্মান সংস্করণ। সেন্ট নিকোলাউস নেচ রুপরেকের সহযোগিতায় ৬ ডিসেম্বর ক্যান্ডি, নাটবাদাম ও ফলের মতো ছোটো ছোটো উপহার নিয়ে আসেন। সারা বিশ্বেই পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সান্টাক্লজ ও অন্যান্য উপহার প্রদানকারীদের সম্পর্কে শিক্ষা দিলেও, কেউ কেউ এগুলি কুসংস্কার বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।