- হোম
- >
- বাংলা ও বাঙালি
- >
- বন্ধ্যা সমাজের অকরুণ পরিবেশে শুকিয়ে যাওয়া ফুল শহীদ সাবের
বন্ধ্যা সমাজের অকরুণ পরিবেশে শুকিয়ে যাওয়া ফুল শহীদ সাবের
রিপন আচার্য্য শিশির
প্রিন্টঅঅ-অ+
ছবি : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক, সাহিত্যিক সাবের
১৯৩০ সাল। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ভারতবর্ষ। একদিকে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন আর অন্যদিকে সূর্যসেন-ভগৎ সিংদের সশস্ত্র আন্দোলন। ভারতের আকাশে-বাতাসে জ্বলছে বিস্ফোরণের দাবানল। স্বাধীনতা সংগ্রামে সারা দেশ-জাতি যখন উন্মুখ হয়ে আছে তখন কক্সবাজার জেলার অখ্যাত গ্রাম ঈদগাঁর এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল নানাবাড়িতে জন্ম হয় আগামি দিনের বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, শহীদ সাবের। পোশাকী নাম এ. কে. এম শহীদুল্লাহ। তাঁর মাতা শফিকা খাতুন ছিলেন জমিদার বংশের কন্যা। আর পিতা পটিয়া ও আনোয়ারা জেলার সীমান্তে অবস্থিত দিয়াং এলাকার অধিবাসি সালামতউল্লাহ ছিলেন পেশায় চাকরিজীবী। সরকারি চাকরি সূত্রেই সারামতউল্লাহকে ঘুরে বেড়াতে হত বিভিন্ন জায়গায়। ফলে ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক আবহের এবং পিতামাতার একত্রস্নেহের সম্পূর্ণতা থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। আবার ৭ বছর বয়সে পিতার সঙ্গে যখন তাকে কলকাতায় চলে আসতে হয় তখন মায়ের কলকাতা না যাওয়ার স্বাধীন সিদ্ধান্তের কারণে পরবর্তী সময়ে তিনি হয়েছিলেন মাতৃস্নেহ বঞ্চিত। অর্থাৎ তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবন কেটেছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং পিতামাতার সম্পর্কের টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে , তার ওপর ছিল সৎমায়ের অবহেলা-অনাদর। লেখক সফেদ ফরাজি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘পারিবারিক দিক থেকে যে জীবনটা গড়ে উঠতে পারত প্রশস্ত রাজপথের মতো সোজা সহজ, সেটা হয়ে উঠেছিল আঁকাবাঁকা।’
ছেলেবেলায় নানাবাড়িতে ঈদগাঁর প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পরার পর সাবেরকে তাঁর পিতা কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং ভর্তি করিয়ে দেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র সাবের স্কুলজীবন থেকেই সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ‘ছোটদের আসর’ ও ‘কিশোর সংঘ’ নামে দুটি সংগঠনের সাথে তাঁর গড়ে ওঠে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। ‘ছোটদের আসর’ সংগঠনটির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন, আর এই সুযোগের কারণে তার হাতে এসে পড়ে ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’র মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই। অপরদিকে কিশোর সংঘ ‘ছন্দশিখা’ নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করত যার সম্পাদনার দায়িত্বভার পড়ে শহীদ সাবেরের উপর। এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার প্রচ।চদ এঁকেছিলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন।
সাবেরের লেখা গল্প সেসময়কার বিখ্যাত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেহাদে যখন প্রকাশিত হয় তখন পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবিব। সাবের সম্পর্কে আহসান হাবিবের মন্তব্য ছিল, ‘এমন সপ্রতিভ ছেলে আমার চোখে পড়ে নি। বয়সের তুলনায় তাঁর মানসিক পরিপক্বতা ছিল অনেক বেশি।’
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সপরিবারে তারা ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তিনি মুকুল ফৌজ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং লেখার ক্ষমতা, অনায়াসে বক্তৃতা দানের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে খুব অল্প সময়েই সবার কাছে প্রিয়মুখ হয়ে উঠেন। ১৯৪৯ সালে এই স্কুল থেকেই তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন এবং পরে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ঐ বছরেই তিনি বছরেই তিনি বামপন্থি মতাদর্শের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হন এবং আমার মনে হয় এ সংগঠনটির সাথে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতকালের সাবেরের নবজন্ম হয়। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ফেডারেশনের এক সমাবেশে বক্তৃতা করা অবস্থায় সাবের গ্রেফতার হন এবং নিরাপত্তাবন্দি হিসেবে তাঁকে প্রথমে চট্টগ্রাম জেলে এবং পরে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়। সরদার ফজলুল করিমও সেসময় রাজশাহী জেলে রাজবন্দী হিসেবে ছিলেন। সাবের ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দি। রাজশাহী জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ১৯৫১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নেশ বিভাগে বি.এ. ভর্তি হন। জেলজীবনের কাহিনী নিয়ে এসময় লিখলেন রোজনামচা ‘আরেক দুনিয়া থেকে’। লেখাটি গোপনে কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় পাঠানো হয় এবং ‘জামিল হোসেন’ ছদ্মনামে ছাপানো হয়। এ লেখাটি সেসময় বেশ সাড়া ফেলেছিল। সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায় লেখাটির প্রশংসা করেন এবং নতুন লেখককে স্বাগত জানিয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লেখেন। একই সময়ে সাবের চট্টগ্রামের জেলে বসে সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা কমরেড ইলা মিত্রকে নিয়ে লিখলেন কবিতা ‘শোকার্ত মায়ের প্রতি’।
সাবের ছিলেন শ্রেণি সচেতন সমাজবিপ্লবের কর্মী। এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে জেলে থাকাকালীন সময়ে পিটতাপুত্রের কথোপকথনে। সাবের পিতার এক কথার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘এই সরকার আমাদের জাতীয় সরকার নয়। এ সরকার ইস্পাহানী-হারুনদের, পীরদের-মীরদের, বড় বড় ধনীদের, তারা জাতি নয়। তাদের বাইরে রয়েছে মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি শোষিত শ্রেণি। বর্তমান সরকার তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না।’ শ্রেণি ও জাতি যে এক নয় এবং তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যে তাদের শ্রেণিসত্ত্বাটিকে আড়াল করার জন্য জাতি গঠনের হট্টগোল করছেন তা তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল সেই কিশোর বয়সেই। জেলে তাঁকে দেখতে গিয়ে বারবার মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার কথা বলতেন তাঁর পিতা। কিন্তু বারবার অনমনীয় দৃঢ়তায় তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করতেন। শেষ পর্যন্ত বিনা বিচারে চার বছর আটক থাকার পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় রাজবন্দীদের মুক্তির মধ্য দিয়ে তিনিও বের হয়ে আসেন।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আজিমপুরে কলোনিতে তিনি বাবার সংসারে চলে আসেন। তাঁর পিতা সেসময় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাই পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর ওপর। তিনি প্রথমে আজিমপুর ওয়েস্ট অ্যাণ্ড হাইস্কুলে যোগ দেন সহকারি শিক্ষক পদে। কথাশিল্পী মাহমুদুল হক ছিলেন তাঁর ছাত্র। এরপর ১৯৫৫ সালের স্নাতক পাশ করে যোগ দেন সহকারি সম্পাদক হিসেবে ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায়। তিনি সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতারও সম্পাদনা করতেন। তাঁর লিখিত সম্পাদকীয় উপস্থাপনায় ও প্রকাশভঙ্গিতে মুন্সিয়ানা ছিল লক্ষণীয়। সংবাদে কর্মরত থাকা অবস্থায় সাবের প্রথমে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের (সিএসএস) অন্তর্গত সিএসপি পরীক্ষায় বসেন; লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায়ও হন উত্তীর্ণ। চোখের সমস্যার অজুহাতে নিশ্চিত সরকারি চাকরি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। তবে এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘শহীদ সাবেরকে যেন ভুলে না যাই’ শীর্ষক এক লেখায় বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিসের (সিএসএস) জন্য পরীক্ষা দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন, কিন্তু চোখের রোগের দরুন অযোগ্য বিবেচিত হবেন মনে করে পরীক্ষা দিলেন না।’ এরপর ফেডারেল ইনফরমেশন সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে পুরো পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন জেলখাটা কমিউনিস্ট। তাই পুলিশ রিপোর্ট সন্তোষজনক ছিল না। এ কারণে তাঁকে নিয়োগপত্র দেয়া হয় নি। পরে তখনকার পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এ ব্যাপারে এক ওভাররুল করে নিয়োগপত্র প্রদানের সরকারি নির্দেশের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর রাতেই মার্শাল ল’ জারি করে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। ফলে সাবেরের আকাক্সক্ষা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতন্ত্র একেবারে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে যায়।
দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় থাকাকালীন সময়ে এক জমিদার কন্যার সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পত্রিকা অফিসের টেলিফোনে কখনও কখনও একটি নারীকণ্ঠ ভেসে আসত এবং কখনো বা নীলখামের চিঠি আসত বলে সাবের প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকে বলেন। কিন্তু সে প্রেমও টেকে নি। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। ১৯৫৯ সালের প্রথম দিকে ময়মনসিংহে তাঁর মামাতো বোনের বাড়িতে রাতের বেলা সেই চিঠিগুলো তিনি পুড়িয়ে ফেলেন। লেখক ফেরদৌস আরা আলীম খুব দুঃখ নিয়ে বলেন, ‘যাঁর স্বজন-আপন জনেরা তাঁর দায়িত্ব নিতে পারে নি, প্রেমিকা নেবে তাঁর ভার? না নিক, তাঁর দুর্বহ জীবনে বোঝা বাড়ানোর কোনও অধিকার এ নারীরও ছিল না’।
একদিকে ব্যাক্তিগত জীবনের বিপর্যয় আর অন্যদিকে রাজনৈতিক জীবনের শূণ্যতা একেবারে আশাহত করে ফেলে সাবেরকে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লেখেন, ‘জেলখানায় যে তরুণ নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন নি, জেলের বাইরে এসে তিনি কিন্তু দেখেন ভিন্ন অবস্থা। রাজনৈতিক আন্দোলন তখন দেশে নেই। হ্যাঁ, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় হয়তো তাঁর মুক্তিকে সম্ভব করেছে, কিন্তু যুক্তফ্রন্ট তো টেকে নি, খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেছে; দেশে সামরিক শাসন চলে এসেছে। আত্মগোপনে চলে গেছেন কমিউনিস্টরা…’।
এভাবে বাস্তব জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত সাবের ১৯৫৮ সালের শেষদিকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাঁর সেই মানসিক বিপর্যয়কালে সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষে রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে পাবনা মানসিক হাসাপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসার কিছুটা সুস্থ হলেও চিকিৎসার ধারাবাহিকতার অভাবে সেই সুস্থতা বজায় থাকে নি। পরে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। বেগম সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক ও সনজিদা খাতুন তাঁকে পরিচ্ছন্ন জীবনে ফিরিয়ে আনতে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেয়েও বেশিদিন রাখতে পারেন নি। তাঁর এ সময়কার অবস্থা সম্পর্কে লেখক মযহারুল ইসলাম বাবলা বলেন, ‘বংশালের সংবাদ অফিসই হয়ে উঠেছিল সাবেরের একমাত্র আশ্রয়স্থল। দিনময় উদ্ভ্রান্তর মত ঘুরে রাতে ঘুমাতে যেতেন সংবাদ অফিসে। মেঝে, বারান্দা, হাতলবিহীন চেয়ার ছিল তাঁর ঘুমের স্থান। সংবাদ অফিস থেকে তাকে প্রতিদিন দুই টাকা দেওয়া হতো। প্রেসক্লাবে খাওয়া ফ্রি। ফ্রি খাওয়ার বেলায়ও ছিলেন অনিয়মিত। সিগারেট, একমাত্র সিগারেট খেতেই সবার কাছে হাত পাততেন নির্দ্বিধায়। জীবনের বোঝা বয়ে বয়ে উদ্ভ্রান্ত জীবনে অভ্যস্ত শহীদ সাবের মূলত বন্ধুদের সাহায্যেই বেঁচে ছিলেন মাত্র’।
সাবেরের এমনই অপরিচ্ছন্ন,উদ্ভ্রান্ত জীবনের পেছনের কারণ দার্শনিক ভাষা পাই সরদার ফজলুল করিমের লেখায়: ‘১৯৬৩ সালের দিকে যখন সাবেরকে আবার দেখি তখন তার এক করুণ মূর্তি। এ সাবের আর কথা বলে না। উদ্ভ্রান্ত অবস্থাতেও মাঝে মাঝে কবিতা লেখে। যেন নিজের হারানো সত্তাকে আবার নিজের কবিতায় উদ্ধার করতে চায়। শহীদ সাবেরের এই উদ্ভ্রান্তি আমাদের বন্ধ্যাসমাজের অকরুণ পরিবেশের আঘাতের ফল ছাড়া আর কিছু নয়। দেশ, দেশের মুক্তি আন্দোলনের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও অগ্রসর হয়ে যায়, একথা যেমন সত্য, তেমনি আবার সে আন্দোলনের নিজস্ব আত্মসমালোচনার দিক থাকে। রাজনীতিক কর্মী যেমন একদিকে তার সাহস-ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে, আন্দোলনকে শক্তিশালী করে, তেমনি আন্দোলনেরও দায়িত্ব আছে ব্যক্তি হিসাবে রাজনীতিক কর্মীকে স্নেহে, আত্মীয়তায়, অভয়দানে, তার আকুতির পূরণে তার দুর্বলতাকে জয় করতে সাহায্য করে, তাকে সবল থেকে সবলতর করে তোলার। আমাদের দেশের করুণ কাহিনী এই যে, এখানে আন্দোলন আর আদর্শ ব্যক্তির কাছ থেকে কেবলই দাবি করেছে, গ্রহণ করেছে। কিন্তু ব্যক্তিকে মানুষ হিসাবে বিচার করে তার প্রতি মুহূর্তের দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে তাকে সাহায্য করেছে খুব কমই। এই ব্যর্থতার পরিণামে শহীদ সাবেরের মতো কতো সম্ভাবনাময় তরুণ আদর্শের রোমাঞ্চভরা স্বপ্নভঙ্গে মানসিক স্থৈর্য রক্ষা করতে যে অক্ষম হয়েছে তার হিসাব এখনো কেউ করে নি’।
শহীদ সাবেরের সাহিত্যকাল খুব দীর্ঘ নয়। লেখক সফেদ ফরাজী তাঁর সাহিত্য জীবনকে তিন পর্বে ভাগ করেছেন। কৈশোর থেকে জেলজীবনের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর প্রস্তুতি পর্ব, জেলজীবন থেকে মানসিক সুস্থতা হারানোর পূর্ব পর্যন্ত দ্বিতীয় বা সৃষ্টিশীল পর্ব এবং অপ্রকৃতিস্থ থাকায় গোটা সময়টা তৃতীয় বা সমাপ্তি পর্ব। প্রস্তুতি পর্বে তাঁর কিছু গল্প-কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। কিন্তু পরবর্তীতে তার সবগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ‘দৈনিক ইত্তেহাদে’ একটি গল্প ছাপা হয়। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সীমান্ত’ নামের একটি পত্রিকার প্রথম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যায় ছাপা হয় তাঁর ‘আবেগ’ গল্পটি। দ্বিতীয় পর্ব বা সৃষ্টিশীল পর্বে সাবের আত্মপ্রকাশ করেন প্রধানত একজন প্রতিশ্রুতিশীল শ্রেণিসচেতন গল্পকার, অনুবাদক ও কবি হিসেবে। এ পর্বে লিখেছেন ছোটগল্পের বই ‘এক টুকরো মেঘ’ (১৯৫৫) ও কিশোরদের উপযোগী গল্প ‘ক্ষুদে গোয়েন্দাদের অভিযান’ (১৯৫৮)। অনুবাদ করেছেন পুশকিনের ‘ইস্কাপনের বিবি’, ‘গোগলের পাগলের ডায়েরি’ ক্যাথারিন ওয়েন্স পিয়ারের ‘কালো মেয়ের স্বপ্ন’। এই তিনটি অনুবাদ নিয়ে বেরিয়েছিল গ্রন্থ ‘কালো মেয়ের স্বপ্ন’ (১৯৫৮)। তৃতীয় বা শেষ পর্বে তিনি মূলত কবিতা লিখেছেন। কিছু গানও লিখেছিলেন। সেগুলো অনুষ্ঠানে গাওয়াও হয়েছিল। তখন মানসিক বৈকল্যে ভুগছিলেন। যখনই একটু সুস্থবোধ করেছেন তখনই কবিতা লিখেছেন।
শিল্পীসংগ্রামী রণেশ দাশগুপ্ত সাবেরকে সত্যিকারের একজন ‘জাতশিল্পী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পকে রণেশ দাশগুপ্ত বলেছে ‘জাপানি ছবির মত সুষম ও ছিমছাম’ এবং কবিতা প্রসঙ্গে বলেন, “মুক্তোর মালার মতো কবিতাই ছিল তাঁর শেষ দিকের লেখার মূল রূপালী সজিব ধারা- ক্ষীণাঙ্গ হলেও অব্যাহত। প্রতীক ও রূপ কে ঝোঁক, সেকারণেই প্রায়শ সংক্ষিপ্ত- প্রধানত গীতধর্মী, গদ্যছন্দে হলেও”।
ছাত্রজীবনে মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে দীক্ষিত হওয়ায় তাঁর সাহিত্যকর্মেও সমাজ সম্পর্কে শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি প্রবলভাবে এসেছে। দেয়াল নামক গল্পে দেখা যায় জেলের দুই দেয়ালের মিলনস্থলে পাহারাদার কয়েদী এবং সরকারি পোশাকসজ্জিত অস্ত্রধারী এক সান্ত্রী। সান্ত্রীর পায়চারির এক পর্যায়ে ওদের দৃষ্টি বিনিময় হয়, কথা আকুলি বিকুলি করে বুকের মধ্যে কিন্তু মুখ খোলে না কারও। অসুস্থ হয়ে দু’জন যখন হাসপাতালে তখন চেনাজানা হয়, কথা হয়, প্রশংসা বিনিময় হয়। পাহারাদার ভবিষ্যত বন্ধুত্বের স্বপ্ন নিয়ে আগের জায়গায় বসে কিন্তু কথা আর হয় না। সরকারি পোশাক ও অস্ত্র দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যায় দু’জনের মধ্যে। গল্পের অন্তর্গত শিরায় ফলগুধারার মতো বয়ে যায় শ্রেণি চেতনা।
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ। শহরের বুকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক চলছে দানবের মত চিৎকার করতে করতে। একসময় কয়েকটি ট্যাঙ্ক ছুটে এল তৎকালীন প্রগতিশীল পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’ অফিসের দিকে। তারপর আগুন ধরিয়ে দিল। চারদিক থেকে পুড়তে লাগল সংবাদ অফিস। আর তখনো প্রতিদিনকার মতো সংবাদ অফিসের ভেতর ঘুমিয়েছিলেন একজন মানুষ। সেই নিষ্ঠুর আগুনের লেলিহান শিখায় আর সবকিছুর সঙ্গে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান সাবের। জীবনের চোরাবালি কিংবা কৃষ্ণগহ্বরে সাবেরের জীবন হারিয়ে গেলেও এই অভিমানী, ব্যাথাতুর লেখক আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির জন্য।
নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাংলা একাডেমী তাঁকে ছোটগল্পের জন্য মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান করে। সমাজ-রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কাজটি(পুরস্কার প্রদান) খুবই যথার্থ হয়েছিল বটে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকলে রাষ্ট্র কি পারত আগের রাষ্ট্রের কৃতকর্মের চিহ্নগুলো মুছে ফেলে শহীদ সাবেরের জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্তকরণসহ তাঁকে পুনর্বাসিত করতে? মনে হয় না পারত। কেননা, রাষ্ট্র ততটা বদলায়নি, যতটা বদলাবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। বদলানোর দায়িত্বটা অবশ্য সেই সব ছেলেমেয়েরই, যারা কেবল নিজ নিজ পরিবারেরই সদস্য নয়, সদস্য সমাজেরও।
লেখক: সাংস্কৃতিক কর্মী
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।