৩,৩৩৬ নির্যাতনের শিকার, খুন ৮৮৭
বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালটি ছিল আলোচনায় ভরপুর। বছরজুড়ে রাজনৈতিক উত্তাপ, নানামাত্রিক ঘটনা-দুর্ঘটনাসহ আলোচনা-সমালোচনায় মুখরিত ছিল বছরটি। একটির পর আরেকটি ঘটনার জন্ম হয়েছে আর এতে ধামাচাপা পড়েছে আগের ঘটনা। বছর শেষে হিসাবের খাতা খুললেই দেখা যায় পুরো সময়ের ভয়াবহতা। প্রতি বছরই দেশ ও দেশের বাইরে অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণ-হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাও বাড়ছে। বাংলাদেশও এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায় পিছিয়ে নেই!
এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে মাইক্রোবাসে আদিবাসী নারীকে গণধর্ষণ এবং উত্তরার একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের নারীকর্মী ধর্ষণের ঘটনাগুলো ছিল বেশ আলোচিত। এ ছাড়াও বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও হত্যাকাণ্ডের খবর মিডিয়ার উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৩ হাজার ৩৩৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৭৫৫ জন। এর মধ্যে ৫৯৭ জন শুধু ধর্ষণ এবং ১৫৮ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। তা ছাড়া ধর্ষণ-চেষ্টার শিকার হয়েছেন মোট ১১১ জন নারী ও কন্যাশিশু।
ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন মোট ৭১ জন এবং স্বামীর বাড়িতে যৌতুকের কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন ১৬১ জন নারী। এ ছাড়া আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের, রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ১১০ জনের এবং বিভিন্ন কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন আরো ৫০০ নারী।
একই সঙ্গে বাসা-বাড়িতে কাজ (গৃহকর্মী) করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ২৮ জন। সব মিলিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৮৮৭ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ৩৬ জন নারীকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
প্রেম প্রত্যাখ্যান ও অন্যান্য কারণে অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন ২৯ জন নারী। এ ছাড়া অগ্নিদগ্ধ হয়েছে আরো ২৮ জন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বাংলামেইলকে বলেন, ‘গ্যাং রেপ (গণধর্ষণ) হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। এ বছর মোট নির্যাতিতের মধ্যে ৭৮ শতাংশ নারী নিজের ঘরে আপনজনদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ব্রুটাল টর্চারের (পাশবিক নির্যাতন) মাত্রাও বেড়ে গেছে অনেক।’
গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। সবচে’ সমালোচিত ঘটনাটি হচ্ছে জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদত হোসেনের বাসায় গৃহকর্মী নির্যাতন। মাহফুজা আক্তার হ্যাপী নামের ওই গৃহকর্মীকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছিল। এ ঘটনায় শাহাদত ও তার স্ত্রীকে আসামি করে মিরপুর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন এক সাংবাদিক।
বছরের বিভিন্ন সময় মোট ৩২ জন গৃহকর্মী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া স্বামীর সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে নির্যাতিত হয়েছেন আরো ৭ জন গৃহবধূ।
নারী অপহরণ, বিদেশে পাচার এবং পতিতালয়ে বিক্রির তথ্যও জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সেই তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন। ৪৬ জনের ক্ষেত্রে পাচারের ঘটনা ঘটেছে এবং ১৫ জনকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে।
এ ছাড়া উক্ত সময়ে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৭৯ জন নারী। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৭ জন নারী। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২২২ জন, প্রেম প্রত্যাখানের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন ৬ জন, উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন ২৯৩ জন, ফতোয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৭ জন, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৫ জন, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪১ জন, বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন ৬৭ জন, জোরপূর্বক বিয়ের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫ জন এবং অন্যান্য কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরো ১৫৭ জন নারী ও কন্যাশিশু।
অপরদিকে নির্যাতন বা লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন মোট ২৩১ জন নারী। আত্মহত্যা-চেষ্টা করেছেন ১০ জন এবং আত্মহত্যার প্ররোচণার শিকার হয়েছেন আরো ৭ নারী।
সরকার, প্রসাশন, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন কিংবা নারীবাদী সংগঠনগুলোর একক কিংবা সম্মিলিত উদ্যোগের পরও দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বেড়ে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, দেশের প্রচলিত আইনে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন, পাচার, ধর্ষণ কিংবা হত্যার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডসহ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড থাকলেও নারীরা ক্রমাগত নির্যাতন এবং সহিংসতার শিকার হচ্ছেই। নারী নির্যাতন বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে সুশিক্ষার অভাব এবং বিকৃত মানসিকতাকেই দায়ী করেছেন তারা।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম এ বিষয়ে বলেন, ‘নির্যাতিত নারীর সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব কেইসে কেউ মুখ খুলতে চায় না। তাছাড়া বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় খরচের কথা চিন্তা করে ভিকটিমের পরিবার মামলা কন্টিনিউ করে না।’
ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমরা বহুবার বলেছি। বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের উচিত বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপন করা।’
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।