- হোম
- >
- মুক্তিযুদ্ধ
- >
- ময়মনসিংহ ও মুক্তাগাছা মুক্ত দিবস আজ
ময়মনসিংহ ও মুক্তাগাছা মুক্ত দিবস আজ
আজ ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ ও মুক্তাগাছা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিবাহিনী স্বাধীনতাবিরোধী, আল বদর, আল সামস, পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে ময়মনসিংহ জেলা ও মুক্তাগাছাকে মুক্ত করে। অর্জন করে আনে স্বাধীনতা।
ময়মনসিংহ : ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথ্যভাবে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে ময়মনসিংহ জেলাকে মুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
ময়মনসিংহের সমৃদ্ধ এই জনপদ লড়াই-সংগ্রাম আন্দোলনে ঐতিহাসিকভাবেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকার দাবিদার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে টংক, তেভাগা, হাতিখেদা, নীলকর, খেলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনের মতো নানা আন্দোলনে ময়মনসিংহের মানুষের বিপ্লবী গাঁথা অনন্য। সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের তৎকালীন উপনিবেশিক অপশাসনের বিরুদ্ধে, সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৬৬-এর ছয় দফা, ‘৬৮-এর ১১ দফাভিত্তিক ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তির লড়াইয়ে।
ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে রক্তের বিনিময়ে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্ত করে ময়মনসিংহকে। সেই স্মৃতি আজও অম্লান ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া ১১ নম্বর সেক্টরের এফজে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ময়মনসিংহ অঞ্চলে অবস্থানরত পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওই দিনই ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিংয়ের অধীনে বেশ কয়েকটি মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি জেলার সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট দিয়ে মরণজয়ী যুদ্ধ শুরু করে। সে দিন মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর ওপর একের পর এক আক্রমণ হানার পাশাপাশি আকাশ যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের বাংকারগুলো লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে পাকহানাদার বাহিনী পিছু হঠতে শুরু করে। পরদিন ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ভারতীয় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট শত্রু মুক্ত করে। এতে পাকহানাদার বাহিনী আরো পিছু হটে পাশ্ববর্তী ফুলপুর, তারাকান্দা ও ময়মনসিংহ সদরের শম্ভূগঞ্জ এসে জড়ো হতে শুরু করে। তারা যুদ্ধের কৌশল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা স্থল পথে যাতে তাদের কাছে না আসতে পারে তার জন্য ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়কের ব্রিজ ও কালভার্টগুলোতে মাইন পুঁতে রাখে। কিন্তু পাকহানাদার বাহিনীর এমন রণকৌশল সত্বেও মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা অতি সাবধানতা অবলম্বন করে স্থল পথে পাকহানাদার বাহিনীর আস্তানার দিকে এগুতে শুরু করে এবং অত্যন্ত সফলভাবে হানাদারদের প্রতি আঘাত হানতে সক্ষম হন। পরিস্থিতে সামাল দিতে না পেরে ৯ ডিসেম্বর পাকাহানাদার বাহিনী পর্যায়ক্রমে ফুলপুর, তারাকান্দা, শম্ভূগঞ্জ ও ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে টাঙ্গাইল জেলার ভেতর দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যেতে শুরু করে। আর পালিয়ে যাওয়ার সময় শম্ভূগঞ্জ ব্রিজটি ধ্বংস করে দিয়ে যায়।
পাকহানাদার বাহিনী ১০ ডিসেম্বর ভোর রাতের মধ্যে তাদের সর্বস্ব নিয়ে ময়মনসিংহ শহর থেকে পালিয়ে যায়। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী শহরবাসীর মধ্যে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। সর্বস্তরের জনতা মুক্তির আনন্দ মিছিল নিয়ে একযোগে স্থানীয় সার্কিট হাউজ মাঠে জড়ো হতে থাকে। সেখানেই ওড়ানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় লাল-সবুজ পতাকা।
মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাম সিং বাবাজি, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মুক্তিযুদের সংগঠক ঢালু ক্যাম্প প্রধান বর্তমানে ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহাম্মেদসহ আরো অনেকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধারা বিজয়ের পতাকা হাতে মিছিল করে শহরে প্রবেশ করেন। এ সময় উৎফুল জনতা রাস্তার দুই পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানান।
মুক্তাগাছা : ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় মুক্তাগাছা। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তাগাছা শত্রুমুক্ত হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্বর পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মুক্তাগাছার জনপদ। মুক্তিকামী জনতার সকল বাধা অতিক্রম করে পাকবাহিনী ‘৭১ এর ২৩ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে জিপ ও ট্রাকের এক বহর নিয়ে জামালপুর থেকে ময়মনসিংহে যাওয়া পথে দখল করে নেয় মুক্তাগাছা। মুক্তাগাছায় প্রবেশ করার সময় রাস্তার দুই পাশের জনবসতির ওপর পাকবাহিনী অবিরাম গুলিবর্ষণ করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন অনেকেই।
২৩ এপ্রিলের আগে ‘৭০-এর নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে গড়ে তুলেন প্রতিরোধের দুর্গ। সামরিক সজ্জায় বলিয়ান না হলেও স্থানীয়ভাবে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। খাদ্যের যোগান দেন ময়মনসিংহ ইপিআর কেম্পে অবস্থানরত বাঙ্গালী জওয়ানদের।
ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন থেকে ৫০টি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ সংগ্রহ করে প্রথমে তার নিজ বাড়ি নন্দীবাড়িতে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেন। এ সময় তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন শিশির কুমার রক্ষিত, সুভাষ চন্দ্র রক্ষিত, ফজলুল হক দুদু, আবদুল হাই আকন্দ, শ্রমিক নেতা হায়াতুল্লাহ ফকির, মহিউদ্দিন আহম্মদ, হুলাস চান আগরওয়ালা, রহিম খান বাদশা, আবুল কাসেম, বছির উদ্দিন, হাবিবুর রহমানসহ আরো অনেকে। এর মধ্যে অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই।
২৯ মার্চ মেজর শফিউল্লাহ (পরে জেনারেল ও সেনাপ্রধান) তার বাহিনীসহ মুক্তাগাছায় এসে মহাবিদ্যালয়ে স্থাপন করেন অস্থায়ী ক্যাম্প। সেই সঙ্গে চালু হয় অস্থায়ী প্রশিক্ষণ শিবির। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক আবু রুশদ। পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার রফিজ উদ্দিন রেফাজ ও সুবেদার আবদুল হামিদ।
এই শিবির থেকে বাছাই করা হয় ২৭ জন দু:সাহসী তরুণদের একটি দল। পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ১০ এপ্রিল মধুপুরে অবস্থানরত অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয় এই দল। অবশেষে খোন্দকার আবদুল মালেক শহিদুল্লাহসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও সহযোগী লোকজন হালুয়াঘাট সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের জন্য পাঠান এ অঞ্চলে।
২ আগস্ট স্থানীয় দালাল রাজাকার আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনী মুক্তাগাছার ১০টি গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যাচালিয়ে তিন শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। শহরের জমিদার বাড়ির ইদারা (কূপ), ময়লাখানা মাঝিপাড়া, মুজাটি, মহেশপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা সংগঠিত হয়। বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধও সংগঠিত হয়। ভিটিবাড়ি গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ ছিল সবচাইতে দুঃসাহসিক।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তাণ্ডবে ৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে টাঙ্গাইলের পথে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী জনতা মুক্তির পতাকা প্রকম্পিত করে তুলে। হানাদার মুক্ত হয় মুক্তাগাছা।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।