- হোম
- >
- ধর্ম ও জীবন
- >
- নারী নির্যাতন রোধে ইসলামের নির্দেশনা
নারী নির্যাতন রোধে ইসলামের নির্দেশনা
নারী-পুরুষের যুগলযাত্রার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে খোদায়ী খেলাফতের শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল। সে যাত্রায় আদম ও হাওয়া (আ.) ছিলেন সহযাত্রী। তাঁদের ভালোবাসায় ভরা সেই ছোট্ট সংসারই পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি, সৌন্দর্য আর উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তু তাঁদের সন্তান হিসেবে আমরা সাংসারিক জীবনের আদর্শকে ধরে রাখতে পারিনি। তাই পৃথিবী সীমাহীন জৌলুসের মধ্যেও তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে, সংসার হয়ে উঠছে আগ্নেয়গিরি। নারী-পুরুষের আন্তরিক সম্পর্ক যেখানে খোদার ধরণীকে প্রেমপূর্ণ ও শান্তিময় করে তোলার কথা, সেখানে বিদ্বেষী ভাব আজ লেলিহান শিখার মতো জ্বলছে। মহান আল্লাহর কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করে নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৬৫৪টি। আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ৪৮৮টি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে স্বামীর নির্যাতনে নিহত হয়েছে ২৬২ জন আর স্বামীর পরিবারের নির্যাতনে নিহত হয়েছে ৭৯ জন।
৪৮৮টি ঘটনার মধ্যে মাত্র ২৬১টি কেস ফাইল হয়েছে। ইসলামে নারী নির্যাতন অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং এর প্রতিকারের উপযুক্ত বিধান রয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত নারী নির্যাতনের ধরন ও এর প্রতিকারে ইসলামের ব্যবস্থা নিয়ে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি রচিত হলো।
শারীরিক নির্যাতন : আমাদের সমাজে নারী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হলেও শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি বেশি প্রকাশ পায়। তা ছাড়া শারীরিক নির্যাতন ধারাবাহিক নির্যাতনের শেষ পর্যায়ে এসে আরম্ভ হয় অথবা একাধিক নির্যাতন একই সঙ্গে চলে কোনো কোনো নারীর জীবনে। প্রথম পর্যায়ে চলে তির্যক কথা, তারপর ঠিকমতো খেতে না দেওয়া, পরিধানের কাপড় না দেওয়া, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, অতঃপর শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানোÑএমনটিই হয়ে থাকে। শারীরিক নির্যাতনের ধরন আবার বিভিন্ন। কেউ চুলের মুঠি ধরে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, লাথি মেরে স্ত্রীদের নির্যাতন করে। আবার কেউ লাঠি দিয়ে প্রহার করে। আবার কেউ জ্বলন্ত সিগারেট, গরম খুন্তি অথবা উত্তপ্ত কোনো ধাতব পদার্থ দিয়ে সেঁকা দিয়ে অসহায় নারীর দেহে চিহ্ন এঁকে দেয়। কোনো কোনো পাষণ্ড পুরুষ আবার এসিড দিয়ে নির্যাতিতার শরীর একেবারে ঝলসে দিয়ে তাকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেয়। এরা আসলে পুরুষ তো নয়ই, মানুষও নয়। কোনো মুসলমান এমন কাজ করতে পারে না। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘পুরুষরা নারীদের দায়িত্বশীল।’ (সুরা নিসা : ৩৪) পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁর নিদর্শনগুলোর অন্যতম একটি এই যে তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আর-রুম : ২১) পবিত্র কোরআনের ভাষ্য থেকে প্রমাণিত হয়, সাংসারিক জীবনে নারী-পুরুষের সহযাত্রায় পুরুষই হবে নারীর জন্য নিশ্চিত ভরসার স্থান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলো সে, যে তার স্ত্রীর কাছে অধিক উত্তম।
আমি আমার স্ত্রীর কাছে সবার চেয়ে বেশি উত্তম।’ (তিরমিজি) নারীদের ওপর যেসব কারণে নির্যাতন করা হয়, সেগুলো কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যেমন যৌতুকের দাবি না মেটানো, স্বামীর মা-বাবা, ভাইবোন, আÍীয়স্বজনের সেবায় ত্র“টি করা, তরকারিতে লবণ বা তেল কম-বেশি হওয়া ইত্যাদি। শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীদের জন্য এ ধরনের কার্যকলাপ মুসলিম পরিচয়ের অযোগ্যতা প্রমাণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে অপমানিত করতে পারে না, তাকে অন্যের কাছে হেয় করতে পারে না। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘তাকওয়া এখানে’ বলে তিনবার নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করেন। তারপর রাসুল (সা.) বলেন, একজন মুসলমানের কাছে অন্য মুসলমানের জীবন, সম্মান ও সম্পদ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।’ (সহিহ মুসলিম) মানসিক নির্যাতন : মানসিক নির্যাতন আমাদের সমাজের সব নারীর ওপরই হয় বললে ভুল বলা হবে না। কারণ পরিবারের সবাইকে সন্তুষ্ট করা একজন নববধূর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্বামীর সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখলে, ‘বেহায়া মেয়ে কোথাকার, লজ্জা-শরম কিছুই নাই’ ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করা হয়। আবার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটু তিক্ততা দৃশ্যমান হলে, ‘একটা ডাইনি এসে উঠেছে ঘরে, ছেলের জীবনটাই গেল’ বলে নারীদের মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়।।
খাবার টেবিলে আগে এলে, ‘রাক্ষুসী কোথাকার, সারা দিন খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নাই’ বলে নারীদের অপমান করা হয়। ইত্যাকার মানসিক নির্যাতনে অনেক সময় নির্যাতিত নারী আÍহত্যার পথ বেছে নেয়। অথচ অমূলক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে এ ধরনের আচরণ করাকে ইসলাম অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ ও হারাম বলে ঘোষণা করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা অধিকাংশ অমূলক ধারণা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখো। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা গুনাহের কারণ। আর তোমরা কারো পশ্চাতে তার দোষ সন্ধান কোরো না এবং পশ্চাতে তোমরা একে অন্যের দোষ চর্চা কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করে? বস্তুত তোমরা সবাই তো তা অপছন্দ করো। আল্লাহকে ভয় করো! নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়। (সুরা আল-হুজুরাত : ১২) যৌন নির্যাতন : নারীর ওপর যৌন নির্যাতন সবচেয়ে মারাÍক পরিণতি বয়ে আনে। বিষয়টি গোপনীয় ও লজ্জাজনক হওয়ায় অধিকাংশ নারীকেই মুখ বুজে সারা জীবন এ নির্যাতন সহ্য করে যেতে হয়। দৈবাৎ কেউ মুখ খুলে ফেললে চরিত্রহীনতার অপবাদ চাপে তার ঘাড়ে। ফলে কেউ অপবাদ নিয়ে আবার কেউ নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে আÍহত্যার মাধ্যমে নিজের নিষ্কৃতির পথ খোঁজে। যৌন নির্যাতন আবার বহুমুখী ও বিভিন্ন ধরনের। আমাদের সমাজে কিছু নারী স্বামীর বিকৃত যৌন লালসার শিকার হয়ে নির্যাতিত হলেও অধিকাংশ নারীই স্বামীর যৌন অক্ষমতার কারণে সারা জীবন তার যৌন অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আর এটি একটি বড় ধরনের নির্যাতন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক পুরুষের এ ধারণাই নেই যে যৌনতা স্বামীর কাছে স্ত্রীর একটা প্রাপ্য অধিকার। আর এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘রোজার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রীদের সঙ্গে যৌনকর্ম বৈধ করা হলো। তোমরা তাদের জন্য পরিধেয় ও তারা তোমাদের জন্য পরিধেয়’ (সুরা আল-বাকারা : ১৮৭)। আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সেই মহান সত্তা যে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে আর তার থেকে তৈরি করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে সে স্বস্তি পেতে পারে। অতঃপর পুরুষ যখন নারীকে আবৃত করল, সে তখন গর্ভবতী হলো ...। (সুরা আল আরাফ : ১৮৯) উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ের প্রতি লক্ষ করলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে যৌন অধিকারেও নারী-পুরুষ একে অপরের সমান।
কিন্তু আমাদের সমাজের অধিকাংশ পুরুষই যৌনকর্ম সম্পাদন করে স্ত্রীকে অতৃপ্ত রেখে ও চরম ক্ষুধার্ত রেখে। এর ফলে নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা সমস্যায় ভুগতে থাকে। কোনো কোনো নারী যৌন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পরকীয়ার পথ বেছে নেয়। কেউ কখনো স্বামীর অক্ষমতার কথা প্রকাশ করে দিলে, তাকে চরিত্রহীন আখ্যায়িত করে নির্যাতন করা হয়। সালিসের নামে তাকে সামাজিকভাবে মারাÍক পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। যা কোনো কোনো নারীকে আÍহত্যা করতে বাধ্য করে। অথচ রাসুলে কারিম (সা.) আর্থিক অথবা যৌন অক্ষম পুরুষদের বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে সক্ষমতা রাখে, সে যেন বিবাহ করে। কারণ তার চক্ষুকে অবনত রাখার ও তার লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করার সর্বোত্তম পন্থা এটি। আর যে সক্ষমতা না রাখে, সে যেন রোজা রাখে। (সহিহ বুখারি) অন্যদের দ্বারা যৌন নির্যাতন : একসময় আমাদের সমাজে দেবরকে দ্বিতীয় স্বামী ভাবা হতো। তাই দেবরের সঙ্গে ভাবির যৌন সম্পর্ক সে সময়ে কিছুটা সামাজিক স্বীকৃতি নিয়েই হতো বলা চলে। দেবর ছাড়াও ভাশুর, স্বামীর বোনদের স্বামী, তার চাচাতো-খালাতো-মামাতো ভাই ও পাড়ার যুবক ছেলেদের দ্বারা অনেক নারীই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। আর যদি কোনো গরিব যুবকের ঘরের বউ হয়ে কোনো সুন্দরী নারী আসে, তাহলে তার যন্ত্রণার শেষ নেই। তার আর কোনো বাবা-চাচা থাকে না, ছোট-বড় সবারই সে ভাবি।
একটা গ্রাম্য প্রবাদ আছেÑ‘গরিবের সুন্দরী বউ সবার ভাবি।’ তার ওপর চালানো যৌন নির্যাতনকে আশীর্বাদ বলেই মেনে নিতে হয়। ইসলাম নারীর সম্ভ্রমকে শুধু একটি নারীর অধিকার হিসেবেই দেখে না; বরং একজন নারীর সতীত্বকে পুরো মানবসমাজের পবিত্র সম্পদ হিসেবে দেখে ও তা রক্ষা করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে। কারণ নারী হলো মানবসমাজের সূতিকাগার। নারীই জš§ দেয় সমাজের শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সব কারিগর ও বিধায়ককে। তাই নারীর সম্ভ্রম নষ্টকারী তথা নারীর প্রতি অবৈধ যৌন নির্যাতনকারীর জন্য ইসলাম সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারী পুরুষ ও নারী; তাদের উভয়কে এক শটি বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো।
আর মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সুরা আন-নুর : ২) হজরত মায়েজ (রা.)-এর ওপর ব্যভিচারের দায়ে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জামানায়। যা অনেক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যদিও একজন সাহাবি হয়েও অনৈতিক অপরাধের দায়ে তাঁর ওপর সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা হয়েছিল; কিন্তু হজরত মায়েজ (রা.)-এর তওবা মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার ঘোষণা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) দিয়েছিলেন। এখানেই ইসলামের স্বাতন্ত্র্য যে একজন মর্যাদাপূর্ণ সাহাবি হওয়া সত্তে¡ও তাঁকে বিচারিক দণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। আর সে কারণেই রাসুলের যুগ ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগ পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর অধিকার সুরক্ষায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।