সিডর : এক প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর
১৫ নভেম্বর ২০০৭। বৃহস্পতিবার। বিকেল থেকেই আকাশ ভারি। অন্ধকারের হাতছানি।
যদিও বন্যা, জলোচ্ছাস, ঝড়, অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির মতো প্রকৃতির বিচিত্র খেলার সঙ্গে খুব পরিচিত উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষ। আকাশে মেঘের দেখা মিললেই যে কেউ বলে দিতে পারতো বৃষ্টির ধরন কি হবে, কিংবা বাতাসের জোর হবে কতখানি। সেদিনও অনেকেই হয়তো ভেবেছিল এ আর নতুন কি। বাতাস না হয় একটু বেশি জোরেই বইবে, না হয় হলোই জলের প্রলোভনে ডাঙ্গার দখল খানিকটা।
তখন সন্ধ্যা। কিন্তু মনে হচ্ছিল অমাবশ্যার রাত। ১৯৭৫ সালে চীনে রহস্যময় নিনার অতর্কিত হামলার আগে যেমন থমকে গিয়েছিল সাংহাই নদী। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ধীরে, চুপিসারে এসেই ঘন্টাকয়েক ঘাপটি মেরে বসে থাকা নিনার ছোবল এত ভয়ংকর হতে পারে, তা বুঝে ওঠার আগেই হাভাতের মতো গ্রাস করেছিল পৌনে ২ লাখ মানুষ। তেমনি থমথমে উপকুল। তেমনি রহস্যময় নদীর গতি। বাতাসে-বৃষ্টিতে বিরতিহীন চলছে লড়াই। সময় যত গড়িয়ে যায়, প্রকৃতির অনুষঙ্গের টিকে থাকার লড়াইও তীব্র হতে থাকে।
বলেশ্বর নদী ফুঁসতে থাকে। সাগরের গর্জনকেও হার মানিয়েছিল শান্ত বলেশ্বরের উত্তাল গর্জন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া ৫ নম্বর সংকেত কিছু সময়ের ব্যবধানে পৌঁছে গেল ৮এ। তারপর ১০। নির্দিষ্ট সীমায় ঘুর্ণিঝড়ের গতি লিপিবদ্ধ করা হলেও তার গতি কোন সীমায় আটকে থাকেনি। অবিরাম, দফায় দফায় বেড়ে চলে বাতাসের আগ্রাসন। একে একে উপকুলের সিংহভাগ সীমান্ত তার দখলে। কৈশোরের বেড়ে ওঠা সবুজের ডালপালা ভেঙে দিয়ে যেতে শুরু করলো তার একেক ঝাপটায়। বয়সের ভারে সংকীর্ণ বৃক্ষ, আর গরীবের খড়ের চাতাল যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ভাসতে লাগলো শুণ্যে।
এক নদী জল বেড়ে যদি তিন নদী জল হয়, আর তা যদি ডাঙ্গায় ভাসায় আয়েশে, থাকে কি ভুমির কিছু? ভাসিয়ে নিয়েছিল ৮৫ লাখ পরিবারের ঘামে ভেজা স্বপ্ন। স্বপ্নের আবাস। চাতাল-চুলা, মাথার উপর থাকা দগ্ধ চালা। মায়ের কোলে থাকা শিশুটিকেও ছাড়েনি সে। কোলহারা মায়ের চোখের নোনাজল তিন নদী জলকে করেছিল দ্বিগুন। এক জন দুজন নয়, হাজারে হাজার প্রাণ নিঃশেষ করেও ক্ষান্ত হয়নি। কয়েক লাখ অবলা পশুও গিলে খেয়েছে সে ঝড়।
১৬ নভেম্বর, ২০০৭।
একসময় সবকিছু অন্ধকার। ঘোর অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন দক্ষিণাঞ্চলের সিংহভাগ। ঘোর কাটেনি তখনো। রাতভর তান্ডবের পর সূর্যোদয়। পৃথিবীতে আলো আসার পর মনে হলো রাতের অন্ধকারই ভালো ছিল। কারো বাড়ির পুকুরে সন্তানের লাশ। কারো উঠোনে গাছের নিচে স্বজনের মৃতদেহ। খালে ভেসে যাচ্ছে পোয়াতি গরুটা। ভাতের হাঁড়ি, লাঙ্গল সবকিছু। যেন পৃথিবীতে আবাদের জন্য চষে বেড়িয়েছে কোন ডাইনোসর।
পুনশ্চ : আজও সেইরাতের কথা মনে পড়লে ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে অনেকে। প্রলয়ংকারী সিডরের ভয়াল রুপ দেখে ভয়ে কেঁপে ওঠে আবার কেউ। হিরোসিমা-নাগাসাকির মতো ইতিহাসের একটি দিন। যাদের গেছে, তাদের অনেকেই আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ত্রাণ, তহবিল, অনুদান কোনকিছুই তাদের দুঃখ ম্লাণ করতে পারেনি আজও।
কিছু তথ্য :
সিডর। সিডর’ হচ্ছে সিংহলি শব্দ। এর অর্থ হল চোখ। এই ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতি প্রায় চোখের আকৃতির মত। ২৪০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড়। ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস। সরকারি মতে সিডর কেড়ে নেয় ৩৩০০ হাজার লোক। কিন্তু রেডক্রস এর মতে মৃত্যের সংখ্যা ২০ হাজারের উপরে। ৫৫ হাজার মানুষ আহত। ৮৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সিডর আঘাত হানে ১ হাজার ৮১১ টি ইউনিয়ন। প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ সিডরের কবলে পড়ে। ৩১টি জেলার ২১০টি উপজেলায় ২০ লক্ষ একর জমির ফসল নষ্ট হয়,সাড়ে ১২ লক্ষ গবাদি পশু মারা যায়। ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৫ কোটি ডলার বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড বাংলাদেশের উপকূলীয় ১১ জেলা। সিডর নামের সেই ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে আঘাত হেনেছিল বাগেরহাটের শরণখোলার বলেশ্বর নদ দিয়ে।
আকবর হোসেন সুমন
সাংবাদিক
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।