- হোম
- >
- লাইফ স্টাইল
- >
- টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম যার নাম শুনলেই জিভে পানি আসে। টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ির চমচমের অতুলীয় স্বাদ আর গন্ধের কারণে দেশে ব্যাপক সুনাম রয়েছে। পোড়া ইটের মতো রঙের এই বিখ্যাত সুস্বাদু চমচমের কড়া মিষ্টির আবরণের ভিতরে রয়েছে গোলাপী আভাযুক্ত নরম অংশ।
মিষ্টি জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বি ঐতিহ্যবাহী এই চমচম বৃটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইলকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি করেছে।
পোড়াবাড়ির চমচম প্রথম কে তৈরি করেন তা সঠিক কেউ বলতে পারে না। তবে অনেকের মতে গৌড় নামে এক ব্যক্তি সর্ব প্রথম পোড়াবাড়িতে এ চমচম তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন।
চমচম ব্যবসায়ী স্বপন ঘোষের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, জেলা শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে এই পোড়াবাড়িতে এক সময় লঞ্চঘাট ছিল। বৃটিশ আমলে ধলেশ্বরী নদীর ঢালান ঘাটে ভিড়তো স্টিমার আর মালবাহী জাহাজ। এ সময় দেশ বিদেশের মানুষ নামতেন পোড়াবাড়িতে। দেশে বিদেশের মানুষের আগমনে পোড়াবাড়ি ছিল জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র। তখন আসাম থেকে আগত দশরথ গৌড় মতান্তরে অজ্ঞাতনামা একজন ঠাকুর ধলেশ্বরীর সুস্বাদু পানি ও এখানকার গাঢ় দুধ থেকে প্রথম চমচম নামের এই মিষ্টি তৈরি করেন।
টাঙ্গাইলের চমচমের স্বাদ মূলতঃ পানির উপর নির্ভরশীল। পোড়াবাড়ি পানির মধ্যে এ মিষ্টি তৈরির মূল রহস্য নিহিত।
বাংলাদেশের অনেক জায়গায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি থেকে কারিগর নিয়ে চমচম তৈরির চেষ্টা করেও কেউ সফল হতে পারেনি। অপূর্ব স্বাদের ফলে এ চমচম সারা ভারতবর্ষে সুখ্যাতি লাভ করে। পূর্বে লঞ্চ, স্টিমার করে পোড়াবাড়ির চমচম ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যেত। প্রতিদিন ২শ থেকে ৩শ মণ চমচম তৈরি করা হতো। পোড়াবাড়ির বিভিন্ন চমচম কারখানায়।
যমুনার কোলে প্রবল স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদীর সুস্বাদু পানি, গাভীর ঘন দুধ ও কারিগরদের অভিজ্ঞতার ছোঁয়ায় পোড়াবাড়ির চমচম ‘মিষ্টির রাজা’ হিসেবে সুনাম অর্জন করে। ব্যাপক সাফল্যের কারণে তখন পোড়াবাড়িতে ৩৫/৪০টি চমচম তৈরির দোকান গড়ে উঠে। চমচম তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় ২ শতাধিক পরিবার। চমচমের স্রষ্টা দশরথ গৌড়ের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রাজারাম গৌড়, নারায়ণ কোকন হালুই, মোদন গৌড়, শিব শংকর ও কুশাই দেবের নাম উল্লেখযোগ্য।
টাঙ্গাইলের একজন প্রবীণ চমচম ব্যবসায়ী গৌর ঘোষ জানান, উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিক থেকেই পোড়াবাড়িতে প্রথম চমচম তৈরি শুরু হয়। এ সময় দুধ ছিল খুবই সস্তা। দুধের কোনো মাপ ছিল না। এক ঘটি দুধের দাম ছির তিন পয়সা থেকে পাঁচ পয়সা। প্রতি সের চমচম বিক্রি হতো সাত আনা থেকে আট আনায়। চল্লিশের দশকে চমচম বিক্রি হতো ১ টাকা সের। বর্তমানে ১৪০/২৫০ টাকায় এক কেজি মিষ্টি বিক্রি করে লাভ হয় ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা। আর তখন এক সের চমচম ৫ সিকিতে বিক্রি করে আট আনা মুনাফা হতো।
বহু দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা পোড়াবাড়ির চমচমের ভক্ত ছিলেন। এর মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যাদু সম্রাট পিসি সরকার, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম উল্লেখযোগ্য।
জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব আলী চৌধুরী, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, প্রথম নাথ চৌধুরীসহ অনেক ব্যক্তিত্বের পদচারণায় পোড়াবাড়ি ধন্য হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পোড়াবাড়ি মদন লালের মিষ্টি ঘরে বসতেন। চমচম নিয়ে আপ্যায়ন করতেন রাজনৈতিক শিষ্য ও ভক্তদের।
ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরিসহ ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে পাঁচআনী বাজার মিষ্টিপট্টি নামে পরিচিতি হয়ে আছে।
১৯৬০ সালের পর টাঙ্গাইল মহকুমার টাঙ্গাইল সদরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এ সময় ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠে অসংখ্য চর। যে ধলেশ্বরী তার বুকের যৌবন সুধা ফেলে দিয়েছিল চমচমের উপর, পরবর্তীতে গুটিয়ে নেয় তার ব্যপ্তি। বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ির লঞ্চ ও স্টিমার ঘাট। জনবহুল পোড়াবাড়ি এক সময় জনশূন্য হয়ে যায়। কারিগর-শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। তারা পরে অন্য পেশায় চলে যায়।
বর্তমানে পোড়াবাড়ির অবস্থা করুণ। নানা সমস্যায় জর্জরিত ছোট একটি বাজারে মাত্র ৪/৫টি ভাঙাচোরা মিষ্টির দোকান ঐতিহ্যকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাজারের আশেপাশের ৬/৭টি বাড়িতে এখনো মিষ্টি তৈরি হয় এবং তারা ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করছে।
এছাড়াও শহরের পাঁচআনী বাজারে কয়েকজন মিষ্টি ব্যবসায়ী ঢাকার শতাধিক দোকানসহ প্রায় দেশের ৫ শতাধিক ব্যবসায়ীদের এই মিষ্টি সরবরাহ করে থাকে।
অপরদিকে, কিছু কিছু অসাধু মিষ্টি ব্যবসায়ী টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের নাম করে বড় বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় মিষ্টির দোকান গড়ে তুলেছে। এসব দোকান থেকে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। আসল নকল চমচম চেনা বড় দায় হয়ে পড়েছে। পোড়াবাড়ির আসল চমচমের কারিগররা অর্থের অভাবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পোড়াবাড়ির নাম ভাঙিয়ে ভেজাল চমচম বিক্রি করে দুর্নীতিরবাজরা অর্থ কামাচ্ছে। পোড়াবাড়ির চমচম ঐতিহ্যবাহী গৌরব হারিয়ে ফেলছে। প্রকৃত কারিগর ও ব্যবসায়রা আর্থিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। প্রতিযোগিতার মধ্যে যারা টিকে আছেন, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়ে তারাও আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির এ গৌরবময় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসীদের অত্যাচার প্রতিরোধ ও ভেজাল চমচম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে সেই প্রবাদ বাক্যের খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন, চমচম ও জার্মুকীর সন্দেশ আর চাপড়া বিলের কই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভেজাল নকল চমচমের ভিড়ে আসল চমচম আর ভেসে উঠবে না। ঐতিহ্য আর গৌরব হারিয়ে যাবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।