মাদ্রাসার ছাদ থেকে ছাত্র উধাও
গত পয়লা আগস্ট রাজধানীর শান্তিনগরের পীরেরবাগে লাওহে মাহফুয ক্যাডেট হিফয মাদ্রাসার ৫ তলার ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে অঞ্জু নিখোঁজ হন। তিন মাস পার হতে চলেছে। স্বজনরা থানা-পুলিশ ও আদালতের শরণাপন্ন হয়েও অঞ্জুর হসিদ পায়নি। সাংবাদিকদের এ কথাগুলি জানান হারিয়ে যাওয়া অঞ্জুর মা নাসিমা বেগম (৪৫)।
নাসিমা বেগম বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করে । নাসিমা বেগমের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে শফিকুল সবার ছোট। টাকা পয়সার অভাবে অন্য ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া না করাতে পারলেও শফিকুলকে নিয়ে তার ছিল বুকভরা স্বপ্ন। তার ছেলে কোরআনে হাফেজ হবেন। সেই স্বপ্ন নিয়েই তিন বছর বয়সে সন্তানকে শান্তিনগরের পীরেরবাগের লাওহে মাহফুয ক্যাডেট হিফয মাদ্রাসায় ভর্তি করান। মাদ্রাসার মাসিক বেতন তিন হাজার টাকা। স্বামী শহিদুল ইসলাম রিকশা চালিয়ে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাদের, সেখানে মাদ্রাসার বেতন তো দূরের কথা! তাইতো অন্যের বাড়ি কাজ করে খেয়ে-না খেয়ে টাকা জমিয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে মাসিক তিন হাজার টাকা বেতন পরিশোধ করতেন নাসিমা। শুধু তিন হাজার টাকাই সীমাবদ্ধ নয়, বোর্ডিং ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ আরও দুই হাজার টাকা শফিকুলের পেছনে ব্যয় হতো।
দীর্ঘ ৮ বছর সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিছু দিনের মধ্যেই তার সন্তান কোরআনের হাফেজ হয়ে ঘরে ফিরবে। শফিকুল ইতোমধ্যে ২৬ পারা কোরআন শরিফ মুখস্থ করেছে। বাকিগুলোও তার আয়ত্বে, শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। কিন্তু ৫ আগস্ট একটি ফোন কল নাসিমার সব স্বপ্ন এলোমেলো করে দেয়।
নাসিমা বেগমের বর্ণনায়, রমজানের ঈদের ছুটি শেষে ১ আগস্ট অঞ্জুকে তিনি নিজে লাওহে মাহফুয ক্যাডেট হিফয মাদ্রাসার বড় হজুর এইচএম নুরুল করীমের কাছে রেখে আসেন। কিন্তু ৪ দিন পর তাকে ফোন দিয়ে হুজুর জানান, অঞ্জুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হুজুর তাকে বলেন, ‘অঞ্জুকে মাদ্রাসার পাঁচতলার ছাদে কাপড় শুকানোর জন্য পাঠানো হলে সে আর ফিরে আসেনি।’ এ দিন বড় হুজুর বিষয়টি পুলিশকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। আর তাকে ধৈর্য ধরতে বলেন। দু’দিন পর নাকি অঞ্জু ফিরে আসবে। কিন্তু তিন মাস অতিবাহিত হতে চললেও তার সন্তান ফিরে আসেনি।
নাসিমার অভিযোগ, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তার সন্তানকে মেরে ফেলেছে। হয়তো কোথাও বিক্রি করে দিয়েছে। তা না হলে তার ছেলে ছাদ থেকে কোথায় বা যাবে?
সরেজমিন মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, ১২৭, মরিয়ম ভিলার পাঁচতলা ব্লিডিংয়ের টপ ফ্লরে মাদ্রাসা অবস্থিত। মাদ্রাসার (ফ্ল্যাটে) প্রবেশ মুখে কলাপসিবল গেট। তাতে একটি বড় তালাও ঝুলানো রয়েছে। কলিং বেল চেপে কতক্ষণ অপেক্ষার পর একজন শিক্ষক এলেন এবং পরিচয় জেনে ভেতরে ঢোকার সুযোগ দিলেন। তবে বড় হজুর (অধ্যক্ষ) মাদ্রাসায় না থাকায় কেউই শফিকুলের বিষয়ে কথা বলতে নারাজ।
পরবর্তীতে ফোনে মাদ্রাসার বড় হুজুর বলেন, ‘অঞ্জু কাপড় শুকাতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সে মাঝে মধ্যেই মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যেত। আমার মনে হয়, সে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। আমরা তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
নাসিমার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের অভিযোগ মিথ্যা। পুলিশও তদন্ত করছে, আপনারাও তদন্ত করে দেখেন, তার সন্তানকে বিক্রি করেছি নাকি মেরে ফেলেছি।’
মাদ্রাসার ছাত্রদের বরাত দিয়ে অঞ্জুর বড় ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যে দিন থেকে আমার ভাই নিখোঁজ, সে দিনই ওই মাদ্রাসার হুজুর হাফেজ মো. সিরাজুল ইসলাম ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অঞ্জুকে পিটিয়েছিল। পেটানোর সময় অঞ্জু বেশ কয়েকবার চিৎকারও দিয়েছে। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সিরাজুল ইসলাম পালিয়ে যায়। এখনো তিনি পলাতক।’
শিক্ষকের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি কেন পালিয়েছেন, সেটা বলতে পারব না। তবে শুনেছি অঞ্জুকে তিনি ১০ বার কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন। সেই ভয়ে নাকি পালিয়েছেন। তবে আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’
এদিকে সন্তাকে ফিরে না পেয়ে নাসিমা বেগম পল্টন থানায় মামলা করতে গেলেও মামলা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে। অনেকবার থানায় ধরনা দিয়ে শেষমেশ সাধারণ ডায়েরি করা সম্ভব হয় (যার নম্বর ৬৫৩)। থানায় মামলা না নেওয়ায় পর বাধ্য হয়ে তিনি আদালতে মামলা করেন। আদালত পল্টন থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেন। বর্তমান ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুনসুর আহম্মেদ মামলাটি তদন্ত করছেন।
অশ্রুশিক্ত চোখে নাসিমা আক্তার বলেন, ‘আমার পোলাডা হারানোর পর থেইক্কা গত দুই মাস ধরে থানায় ঘুরতেছি। কিন্তু থানায় কেসটাও (মামলা) নেয়নি। থানার বড় স্যারে হাতে ধরছি, পায়ে ধরছি, যে আমার কেসটা নেন। তবুও কেসটা নিল না। ওসি স্যারের পাও ধরছি। ওসি আমাকে কয় ধৈর্য ধরতে বলেন। আর বারবার সময় দেয়। কিন্তু আমার পোলাডারে খুঁজে দেয়নি। পরে বাধ্য হয়ে কোর্টে গিয়ে কেস করছি।’
তবে নাসিমার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাদের যথাযথ আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। মামলা নেয়নি, এটা ঠিক নয়। তারা তো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে। সাধারণ ডায়েরি পর আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।’
তদন্তকারী অফিসার ও পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুনসুর আহম্মেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি। উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।