কিশোরগঞ্জ ঢাক-ঢোলের হাট
প্রায় ৫শ বছরের পুরানো ঢাক-ঢোলের হাট কিশোরগঞ্জ। বাঙালির উৎসব-পার্বণে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢাক-ঢোলের জুড়ি নেই। আর দুর্গোৎসব তো ঢাক-ঢোল ছাড়া ভাবাই যায় না। ঢাক ও ঢোলের কানফাটানো শব্দের মাঝে মণ্ডপে মণ্ডপে নাচ-গান-আরতি আর দেবী বন্দনা দুর্গাপূজার প্রধান। তাইতো কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে বসেছে দেশের সবচেয়ে বড় ঢাক-ঢোলের হাট শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে। ঢাক-ঢোলের এ হাটে যেনো দুর্গার আগাম আবাহন।
১৯ অক্টোবর সোমবার থেকে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দূর্গাপুজা। এই উৎসবকে ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঢাকঢোলের হাট বসেছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পূজারী আর বাদ্যযন্ত্রীদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে ৫’শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এই ঢাক-ঢোলের হাট।
বাহারি রং আর আকারের ঢাক-ঢোল, বাঁশি, খোলসহ অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের পশরা সাজিয়ে বসা যন্ত্রিরা এসেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। অপেক্ষা করছেন যন্ত্রসহ নিজেদের ভাড়া দেওয়ার জন্য।
রীতি অনুযায়ী দুর্গাপূজা উপলক্ষে পূজার আগেরদিন ও শুরুর দিন বসে এ হাট। গত প্রায় ৫শ বছর ধরে এভাবেই ঢাকের হাট বসছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদরের পুরান বাজারে। এ দুইদিন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পুঁজা মণ্ডপ, এলাকায় ও বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র বাজান তারা। সারা বছর তাদের তেমন কদর না থাকলেও ঢাকি ও বংশীবাদকদের চাহিদা এ সময়ে থাকে তুঙ্গে। হাটে সুশান দুর্গাপুর থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নিজেদের ভাড়া দেওয়ার জন্য এই হাটে ছুটে এসেছেন যন্ত্রীরা।
ঢাকের হাটের আয়োজকদের দাবি, বাংলাদেশে আর কোথাও এ ধরনের হাট বসে না। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে হাটটি এখন গর্ব ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে উঠেছে। এদিকে, হাটে আসা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ঢাকি ও বংশীবাদকরা বাজনা বাজিয়ে, নেচে ও নানা ঢংয়ে অঙ্গ-ভঙ্গি প্রদর্শন করছেন।
যন্ত্রীরা জানান, ক্রেতারা কাউকে পছন্দ করার পর চলে দর কষাকষি। সাধারণত দলভিত্তিক চুক্তি হয়ে থাকে। হাটে বাদ্যযন্ত্র বিক্রি হচ্ছে ভালো। আর হাতের নাগালে পছন্দের বাদ্যটি পেয়ে আকৃষ্ট হচ্ছেন ক্রেতারাও। যন্ত্রিসহ একেকটি ঢাক ১০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকার উপরে ভাড়া হচ্ছে।
গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে আসা ঢাকি বিজয় রায় জানান, এ হাটে তারা প্রতি বছর আসেন। তাদের ৭ জনের দলে ঢাক-ঢোল, বাঁশিসহ ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা ভাড়ায় যাওয়ার কথা বললেন তিনি। এখানকার ঢাক-ঢোলের হাটটিই দেশের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় বাদ্যযন্ত্রের হাট। তবে, ঢাকের হাটের পুরান বাজারে এসে ভিড় করলেও তাদের নেই কোনো থাকার ব্যবস্থা। তাই বাদকদের স্থানীয় আখড়াগুলোতে অবস্থান নিতে হয়।
ঢাকিদের থাকার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবের কথা স্বীকার করে ঢাকের হাটের প্রধান আয়োজক ও কটিয়াদী পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শীতল কুমার সাহা জানান, ঢাকিদের অনেকেই আমার বাজারের পুরান বিল্ডিংয়ে রাত্রীযাপন করেন। স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। ঢাকিদের জন্য একটি টিনসেড ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক সমস্যাই সমাধান হবে বলে জানান তিনি।
জনশ্রুতি আছে, প্রায় ৫শ বছর আগে ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা নবরঙ্গ রায় কটিয়াদীর চারিপাড়ায় তার রাজপ্রাসাদে প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। রাজবাড়ির পূজায় ঢাক, ঢোল ও বাঁশিসহ অংশ নিতে খবর পাঠানো হয়, বিক্রমপুর পরগনায় যন্ত্রীদের কাছে। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতীরের কটিয়াদীর যাত্রাঘাট নামক স্থানে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে প্রতি বছর হাট বসছে কটিয়াদীর আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে কটিয়াদী পুরান বাজারে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।