বিভিন্ন ধর্মে প্রাণী কুরবানি/বলিদান/উৎসর্গ
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আচার-পদ্ধতির অন্যতম অঙ্গ বলিদান এবং নৈবেদ্য নিবেদন। দর্শন ভিত্তিক ধর্ম (যেমন বুদ্ধ ধর্ম) বাদে প্রায় সবগুলো ধর্মেই মোটামুটি প্রাণী কুরবানি বিষয়টা আছে।
আদিম ধর্মে নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিল। আফ্রিকার উগান্ডায় দলপতির পুত্রসন্তান জন্মালে তাকে দেবতার উদ্দেশ্য হত্যা করা হত।আফ্রিকার অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে নরবলি প্রথা ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে গণ্য হত।
প্যালেস্টাইনে ইসরাইলি অধিকার স্থাপিত হওয়ার আগে শিশুসন্তানকে দেবতার পীঠে বলি দেওয়া হত। ভারতবর্ষে নাগাদের মধ্যে বহুদিন পর্যন্ত নরবলি প্রথা চালু ছিল। নিকট অতীত পর্যন্ত আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার আদিবাসী সমাজে রাজাকে বলিদানের নিয়ম ছিল। রাজার রাজত্বকাল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হত। এই নির্দিষ্ট রাজত্বকাল অতিবাহিত হল রাজাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যা করা হত। যে সমাজে রাজার রাজত্বকাল নির্দিষ্ট ছিলনা, সেখানে রাজা বৃদ্ধ কলে কিংবা কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তাকে হত্যা করা হত। পরবর্তীকালে অনেক সমাজে রাজাকে হত্যা না করে তার বদলে অন্য কাউকে হত্যা করার প্রথা প্রচলিত হয়।
মেক্সিকোর এজটেক সমাজে একটি সুস্থ সবল বন্দি যুবককে কৃত্রিম রাজা বলে জাহির করা হত এবং এক বছর এই কৃত্রিম রাজা আসল রাজার বদলে রাজত্ব করত। বছর শেষ হয়ে গেলে আসল রাজার বদলে এই নকল রাজাকে বলি দেওয়া হত। তবে সভ্যতার বিকাশের ফলে নরবলি প্রায় লোপ পেয়েছে এবং পশুবলি প্রথা তার স্থান গ্রহণ করেছে।
প্রাচীন রোমান ধর্মে বিভিন্ন পশুবলির প্রথা প্রচলিত ছিল। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল “দ্য অক্টোবর হর্স” । ১৫ই অক্টোবর যুদ্ধের দেবতা মার্স এর প্রতি ঘোড়ার রেস পরিচালনার শেষে বিজয়ী ঘোড়া বলি দেওয়া হতো । ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে আরেকটি বলি উৎসব পালিত হতো। প্রাচীন গ্রীসের ধর্মে পশু বলি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার প্রচলন ছিল। গ্রীসের প্রাচীন কিছু সাহিত্যে পাওয়া যায়, জবাই-কৃত পশুর উৎকৃষ্ট অংশ দেবতার উদ্দেশ্যে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হতো আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পশুই আগুনে পুড়িয়ে ফেলে দেবতাকে নৈবেদ্য দেওয়া হতো।
সনাতন (হিন্দু) ধর্মে উৎসর্গ:
দাতাকর্ণের নাম আমরা অনেকেই জানি।হিন্দু পুরাণ (মহাভারত, রামায়ণ ও কর্ণবেদ) থেকে জানা যায়, সূর্য দেবতার ঔরসে ও কুন্তী দেবীর গর্ভে কর্ণের জন্ম।তিনি খুব বড় একজন দাতা ছিলেন, সবসময় কথা দিয়ে কথা রাখতেন।মানুষের প্রতি ছিল তার পগার মমতা, ভালবাসা।তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক, সবসময় ভগবানকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন।তিনি মানুষকে খাবার খাওয়াতে ভালবাসতেন।
কর্ণের দানশীলতা পরীক্ষা করার জন্য একদা ভগবান কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অতিথি হয়ে আসেন কর্ণের বাড়ীতে।অতিথি ব্রাহ্মণ জাতের হওয়ায় ধার্মিক কর্ণের কাছ থেকে পান অতিরিক্ত সমাদর।ভগবান এসে আহার করার জন্য কর্ণের কাছে তার ছেলে বৃষকেতুর মাংস চান যা কর্ণের স্ত্রী পদ্মাবতীর নিজ হাতে রান্না করা অর্থাৎ মায়ের হাতে ছেলের রান্না করা মাংস হতে হবে।অগত্যা কি আর করা, কর্ণ তাঁর পুত্র বৃষকেতুকে হত্যা করে তার মাংস রান্না করে ব্রাহ্মণকে আহার করতে দেন।ভগবান কর্ণের এই ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে পুনরায় তার সন্তানের জীবন দান করে আবার জীবিত করে তাদের উপহার দেন।
নেপালে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গাধীমাই উৎসব নামে গাধীমাই দেবীর প্রতি লক্ষ লক্ষ পশু বলি দেওয়া হয়। প্রায় ৯০০ বছর আগে ভগবান চৌধুরী নামক বারিয়াপুরের এক বাসিন্দাকে স্বপ্নযোগে গাধীমাই দেবী ৫ টি নরবলির নির্দেশ দেন, তিনি এতে অপারগ হয়ে প্রতি ৫ বছর অন্তর একটি ইঁদুর, একটি শুকর, একটি মোরগ, একটি ছাগল এবং একটি মহিষ বলি দেওয়া শুরু করেন। সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে।
আব্রাহামিক ধর্মে উৎসর্গ:
ইহুদি, খৃষ্টান ও ইসলাম, আব্রাহামিক এই তিনটি ধর্মের ইতিহাস মূলত একই হলেও কুরবানির নিয়মে পার্থক্য রয়েছে। মহাপ্লাবনের পর নোয়া (নূহ নবী) নৌকা থেকে নেমে কুরবানি করেন। মোজেস (মুসা নবী) এর কুরবানিরও একাধিক বর্ণনা রয়েছে হিব্রু বাইবেলে। তাদের সবার কুরবানির নিয়ম ছিল কুরবানি করা পশু আগুনে পুড়িয়ে ফেলা। ইহুদিরা বর্তমানে সেই প্রথা পালন করে থাকে। মোজেস এর নিয়ম অনুসারে জেসাস (ঈসা নবী) এর কুরবানির কথা বাইবেলের নতুন নিয়মে দেখা যায়।
ইসলাম ধর্ম মতে, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা নবী ইব্রাহিমের কাছে তার প্রিয় ছেলেকে কুরবানি করতে ইঙ্গিত করলেন।আল্লাহকে খুশি করতে আল্লাহর প্রিয় ধার্মিক বান্দা ইব্রাহিম নিজের ছেলেকে হত্যা করতে উদ্যত হন।আল্লাহ খুশি হয়ে পুত্রকে জীবন দান করে। তার পরিবর্তে একটি পশু (দুম্বা) কুরবানি করেন নবী ইব্রাহিম।তার অনুসারীরা বছরে একটি দিন (ঈদুল আজহা) পশু কুরবানি করে থাকে।
তথ্যসূত্র:
ক. বিজ্ঞানের দর্শন – প্রথম খণ্ড – শহিদুল ইসলাম
খ. বাইবেল, কোরান ও হাদিস গ্রন্থসমূহ
গ. উইকিপিডিয়া
ঘ. ইন্টারনেট
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।