দস্যি ছেলের সাহসী অভিযান
মা বলে- ছেলেবেলা থেকে’ই আমি ভিষম দুরন্ত আর ডানপিটে ছেলে। রাস্তায় হুংকার করে ছুটে আসা চেয়ারম্যানের সিডিআর মটরসাইকেল, পুকুরে ভেসে থাকা হাঁসেদের দল, সুতা কেটে অচিনদেশে উড়ে যাওয়া ঘুড়ি, কিংবা বিকট শব্দে উড়ে চলা বিমান, সবকিছুকেই তাড়া করে হার মানিয়েছে আমার দুরন্তপনা শৈশব। বারংবার সবকিছুতে চ্যালেঞ্জ লড়ে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করা যেনো আমার রক্তে মিশে গেছে। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবকে পরিণত হলেও আমার স্বভাবে পরিবর্তন আসেনি সামান্যতমও। আমি বিশ্বাস করি ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অসাধ্য সাধনের মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। বিজয়গুলোই জীবনের গল্প হয়ে থাকে, বাকিটা শুধুই ক্লান্তির নোনা জলে ডুবে যাওয়া।
চা’য়ের আড্ডায় বন্ধুদের সাথে সাইকেল চালিয়ে ২০ দিনে সারাদেশের ৬৪ জেলায় ভ্রমণ করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিলাম। পকেটে মাত্র ৭ হাজার টাকা আর ক্যামেরাটা ব্যাগে নিয়ে সাইকেলে চড়ে বসলাম। কতো অচেনা মানুষের সাথে পরিচয়, অচেনা বাড়িতে রাত্রীযাপন, নানান রকমের বিশ্বাস আর সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছি। চেনা মানুষ অচেনা হতে যতটা সময় লাগে, অচেনা মানুষ সুযোগ পেলে তারচেয়ে কম সময়ে চেনা মানুষে পরিণত হয়। সারাদেশে ঘুরে আসতে আমাকে ২০ দিন সময় দেওয়া হলেও লেগেছে ১৭ দিন। এখন যদি আবার সাইকেল নিয়ে বের হই তবে ১০ দিনেই বাংলাদেশের সবকটি জেলা ঘুরে আসতে পারবো বলেই মনে হয়।
আজ আমার সাইকেল চালিয়ে ৬৪ জেলায় ভ্রমণের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘটনার কথা বলব। ঘটনাটি গল্প নয়, তবু গল্পের মতোই। ভুল করে ভুল রাস্তাকে সঠিক মনে করে ভুল জায়গায় চলে যাওয়ার দু-একটা ঘটনাতো ভ্রমনের ক্ষেত্রে ঘটতেই পারে। কাজের মধ্যে ভুল করেও যেমন কোন আনন্দ খুঁজে নিলে বিরক্তি বা ক্লান্তি আসে না, কাজটি আবার সঠিকভাবে সম্পন্ন করে নেওয়া যায়। আমার এ ভুলে বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর অনেক মুহূর্তের মধ্যেও একটি বড় অনন্দময় ঘটনা আছে। সিলেট শহর থেকে ময়মনসিংহ যাচ্ছি, সময় একদিন। সুনামগঞ্জ জেলায় হাসন রাজার বাড়ি ঘুরে সুরমা নদী পার হয়ে নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বেশ ভালো রাস্তা, সাইকেল চলছে অন্তত ২৫ কি.মি গতিতে। দূর আকাশে কালো মেঘ দেখে সাইকেল চালানো থামিয়ে ভাবছি সামনে যাবো, নাকি থেমে যাবো। ঝড় আছড়ে পড়তে পারে ভেবেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম। আরো তিন কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিয়ে বুঝতে পারলাম পাহাড়কে ভুল করে কালো মেঘ ভেবে ঝড়ের দুশ্চিন্তা করেছি। দুনিয়ার সকল ভাবনা ছেড়ে কিছুক্ষণ পাহাড় দেখলাম। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করি আমার বিশালতাকে যেনো কেউ নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। কে বড়- আমি, নাকি পাহাড়!
হঠাৎ মাথায় এলো আমার যাত্রাপথে এরকম পাহাড় থাকার কথা নয়। আমি কী তবে একটি নয়, দুটি ভুল করলাম! একজনের কাছে জানতে চাইলাম পাহাড়ের ওই স্থানটার নাম কী? তিনি জানালেন- ওই’ডা ইন্ডিয়া! উনার কথা শুনে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় যেনো আমার মাথার ওপর ভেঙে পড়তে চাইলো। ঠিক তখনই মাথায় নতুন প্রশ্নের উদয় হলো- পাহাড় কী সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকে, নাকি লম্বা কিংবা কাত হয়ে শুয়ে থাকে? উদ্ভট এ প্রশ্ন পাহাড়কে না করলেও পাহাড় বোধহয় তার বিশাল কান দিয়ে আমার মনের কথা শুনে ফেলেছে। তাই হাসতে হাসতে আমার ওপর ভেঙে পড়ার কথা ভুলেই গেলো! আমি একা নই, পাহাড়ও ভুল করে তাহলে?
ওই ভদ্রলোক জানালেন আমি পশ্চিম ভেবে উত্তর দিকে চলে এসেছি। সবুজ ঘাসের উপর মাথা ঠা-া করে বসলাম। প্রায় ৫০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে এসে একই পথে পেছনে যাওয়াটা বিরক্তিকর। এতোক্ষণে আমি নেত্রকোনা শহরে পৌঁছে যাওয়ার কথা। এসব ভাবলে বরং বিরক্তি এসে মনের শক্তিটাকে দূর্বল করে দিবে। তাই পেছনের ভাবনা পেছনে ফেলে সামনের পরিকল্পনা করতে লাগলাম। এলাকাটার নাম ‘বিশম্ভর’, এখান থেকে তাহেরপুর ২০-২২ কিলোমিটারের পথ। পেছনে ফিরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে তাহেরপুর হয়ে নেত্রকোনা পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রায় তিন কিলোমিটারের পথ পাড়ি দেওয়ার পর সামনে পড়লো ছোট নদী। আকারে ছোট হলেও আমার সামনে যাওয়ার পথে এই নদী বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। ছোট এ নদী পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ভারতের দিকে চলে গেছে। নদীটি পাড়ি দিতে হলে দরকার একটি ছোট নৌকা। পাহাড় আর নদী পাড়ের এই চমৎকার দৃশ্য আরো বেশি উপভোগ্য হতে পারতো যদি ছোট একটি নৌকা পাওয়া যেতো। এ নদী পার হতে ১০ টাকা দেওয়ার জন্য আমি রাজি থাকলেও রাজি ছিলো না কোনো নৌকা। বিকেল ৫টার পরে এখানে পাহাড়ি জংলি, ডাকাতের ভয়। নদী পার হতে হলে আমাকে সকাল ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঈদের সময় ট্রেনের টিকেট আর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলার টিকেট সংগ্রহ করার জন্য মানুষ একদিন আগে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু এখানে কোন লাইন নেই, নেই কারো নদী পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষা। একইভাবে এখানে পরিচিত কেউ নেই, নেই কোন থাকা-খাওয়ার হোটেল। এতো ‘নেই’ এর মাঝেও আছে ‘বৃষ্টি’। বারান্দা কিংবা ছাদে যে বৃষ্টির দেখা মেলে তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বৃষ্টি নিয়ে তখন অনুভূতি কেমন ছিলো তা আর না বলি। অনেকের কাছে বৃষ্টি প্রেমিকার চেয়েও বেশি প্রিয়! এখানেই অজানা একজনকে নিজের বর্তমান পরিস্থিতির কথা শুনিয়ে দিলাম। এতে দুটো লাভ হলো- একটু হালকা হলাম, থাকার একটা জায়গাও তিনি ঠিক করে দিলেন।
সকালে অল্প বৃষ্টি হচ্ছিলো, রেইনকোট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ছোট নদীটি পার হলাম, এবার এলো ছোট পাহাড়! আচ্ছা বুলেট, সুই, পিঁপড়া, ট্যাবলেট কেনো ছোট হয়? সাইকেলটা নিজের কাঁধে চড়িয়ে পাহাড়টা পার হয়ে তাহেরপুর যাওয়ার জন্য যে রাস্তাটি খুঁজে পেলাম তাতে সাইকেল চালানো একেবারেই অসম্ভব। পুরো রাস্তাজুড়ে কাদা। আমার কষ্টে আকাশের কান্নার পরিমানটাও বেড়েছে অনেক। এদিকের গ্রামগুলোতে আধুনিকতার ছোঁয়া না লাগলেও মানুষগুলো অনেক ভালো। এখানেই এক গ্রামে বাবা-মায়ের মুখে শুনলাম অনেক দিন আগে ঘুরতে আসা মানুষদের গল্প। এখানকার সহজসরল মানুষগুলোর পেশা কৃষিকাজ, মাছ ধরা, আর গল্প করা। এভাবেই ৩৬ ঘণ্টায় আমি পাড়ি দিলাম মাত্র ২০ কিলোমিটার।
আজ এখানে শেষ করলেও আমার ভ্রমণের সব গল্প শেষ হয়নি। আবার হাজির হবো অন্য জেলার গল্প নিয়ে। ভ্রমণের গল্প শেষ হলে আসবো টেনিস খেলার গল্প নিয়ে। আপতত এই টেনিস নিয়েই আমার জীবনের গল্প এগিয়ে চলছে।
মাইজুর রহমান খান সাগর
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।